কুয়েট ভিসির পদত্যাগ দাবিতে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ-অনশন
এক দফা দাবিতে আমরণ অনশন করছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগ দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনশন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: কুয়েটে অনশনরত শিক্ষার্থীদের তদন্ত কমিটির ওপর আস্থা রেখে অনশন কর্মসূচি থেকে সরে আসার অনুরোধ করেন শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার। তবে উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়া আমরণ অনশন কর্মসূচি থেকে শিক্ষার্থীরা সরে আসবেন না বলে জানিয়েছেন।
আজ সকাল পৌনে ১০টার দিকে শিক্ষা উপদেষ্টা কুয়েট ক্যাম্পাসে যান। তিনি অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং অনশন ভাঙতে অনুরোধ করেন। তবে ভিসির পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার পরপরই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। সেখানে তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: কুয়েট শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এবং উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ২০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অনশন পালন করছেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার নেতাকর্মীরা।
অনশনের একপর্যায়ে প্রচণ্ড রোদে অসুস্থ হয়ে পড়েন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক মোফাজ্জল হোসেন সাদাত। হিট স্ট্রোক করলে তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাবি শাখার মুখ্য সংগঠক হাসিব আল ইসলাম বলেন, “কুয়েটের উপাচার্যের পদত্যাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: কুয়েট উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদের অপসারণের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। এসময় বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। আজ বিকেল ৩টার মধ্যে তিনি পদত্যাগ না করলে কেন্দ্র ঘোষিত বাংলাদেশ ব্লকেড কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করার হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা।
দুপুর পৌনে ১২টা থেকে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, জাবি শাখার ব্যানারে তারা এ অনশন শুরু করেন।
অনশনরত বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন আয়ান বলেন, “অনশনরত শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে কিন্তু ইন্টেরিমের ঘুম ভাঙছে না। লাশের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় আসা ইন্টেরিম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গাদ্দারি করছে। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, যদি বিকাল ৩টার মধ্যে কুয়েটের দলকানা ভিসিকে না সরালে আমরা সারা দেশে ব্লকেড কর্মসূচি দেব এবং ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে আমরণ অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাবো।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, “ছাত্রজনতার রক্তের ওপর যে ইন্টেরিম সরকার বসে আছে, সেই সরকার শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিতে কর্ণপাত করছে না।”
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়: কুয়েট শিক্ষার্থীদের চলমান আমরণ অনশন কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে ক্লাস বর্জন ও মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা।
সব বর্ষের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জনের পাশাপাশি আজ দুপুর ২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদি চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। যা নগরীর জিরো পয়েন্টে গিয়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ‘ব্লকেড’ কর্মসূচিতে রূপ নেয়। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪তম ব্যাচের পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
খুবি শিক্ষার্থীরা জানান, কুয়েটের ঘটনাবলী শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের বিষয় নয়। এটি দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা ও সম্মানজনক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন।
এক শিক্ষার্থী বলেন, “কুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবি আমাদেরও দাবি। আমরা চাই শিক্ষাঙ্গনে হয়রানি, দমনপীড়ন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অবসান হোক।”
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: কুয়েটের চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও প্রধান সড়ক অবরোধ করেছেন।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে যশোর চৌগাছা মহাসড়ক অবরোধ করে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয় ।
বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা, "ভিসি মাছুদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশন", "দালাল ভিসির বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশন", "কুয়েট তোমার ভয় নাই রাজপথ ছাড়ি নাই", "এক, দুই, তিন,চার ভিসি মাছুদ তুই গদি ছাড়", "দিয়েছি তো রক্ত আরো দেবো রক্ত", "স্বৈরাচারের কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও", "এই মুহূর্তে খবর এলো কুয়েট ভিসি পালিয়ে গেল", "স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশন", "আপস না সংগ্রাম? সংগ্রাম- সংগ্রাম " ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, “জুলাই আন্দোলনের পরে আমরা কুয়েটের উপাচার্য মাছুদের মতো একজন স্বৈরাচার চাই না। কুয়েট প্রশাসন আন্দোলনকারী ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করেছে। যারা এক সময় জুলাই আন্দোলনের সৈনিক ছিল, আজ তারাই অধিকার আদায়ে অনশন করতে বাধ্য হয়েছে। সেখানে তাদের স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে, তারা না খেয়ে দিন পার করছে। কিন্তু তাদের পক্ষে উপাচার্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এরকম উপাচার্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। অবিলম্বে এরকম উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে। যদি আপনি আমাদের ভাইদের দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ না করেন তাহলে আমরা মার্চ ফর কুয়েট কর্মসূচি গ্রহণ করব।” কুয়েট উপাচার্যকে অপসারণ না করা হলে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তারা।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: কুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে অনশনে বসেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে অনশনে বসেন তারা।
শিক্ষার্থীরা বলেন “কুয়েটের উপাচার্য তার নির্লজ্জতার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। শিক্ষার্থীদের রক্তের ওপর দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন। কিন্তু এখন তিনি শিক্ষার্থীদের ওপরেই নানারকম জুলুম নিপীড়িত শুরু করেছেন। শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে তিনি ভ্রুক্ষেপহীন। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারও শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এই উপাচার্য যতক্ষণ না পদত্যাগ করবেন ততক্ষণ আমাদের কর্মসূচি চলমান থাকবে।”
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়: কুয়েট শিক্ষর্থীদের চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে অনশনে বসেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পতাকা স্ট্যান্ডসংলগ্ন আমবাগান এলাকায় শিক্ষার্থীরা অনশনে বসেন।
শেকৃবি শিক্ষার্থীরা জানান, কুয়েট শিক্ষার্থীদের একদফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তারা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেছেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দেন তারা।
শেকৃবির শিক্ষার্থী মো. মফিজ শেখ বলেন, "ভিসি অপসারণের জন্য যে একদফা দাবি করেছে কুয়েট শিক্ষার্থীরা, তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে আমরা আজকে আমাদের সকল একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত করেছি। আমাদের দাবি, কুয়েটের ভিসি আজকের মধ্যেই পদত্যাগ করতে হবে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)
বুধবার (২৩ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৫টায় কুয়েট উপাচার্য মুহাম্মদ মাসুদের পদত্যাগের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেইট সংলগ্ন চট্টগ্রাম-রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন চবি শিক্ষার্থীরা।
এ সময় সড়কের উভয়পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রায় আধঘণ্টা পর বিকাল ৬টায় এ অবরোধ শেষ হয়।
ব্লকেড কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা ‘জুলাইয়ের বাংলাদেশ, ফ্যাসিবাদের হয়নি শেষ’, ‘কুয়েটের সঙ্গে আছে, চবিয়ান চবিয়ান’, ‘ভিসি মাসুদ স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে গদি ছাড়’, ‘কুয়েট তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
কর্মসূচিতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের আশিকুর রহমান বলেন, “জুলাই এখনো শেষ হয়নি। জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশে কোন স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না। কুয়েট ভিসি সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে। আজকের মধ্যে ভিসি মাসুদ পদত্যাগ না করলে আমরা আবার জুলাইয়ের সেই দেশব্যাপী ব্লকেড কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হব।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)
বুধবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে কুবির গোল চত্বরে কুয়েট শিক্ষার্থীদের ‘ভিসি মাসুদ অপসারণ’ দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে গণস্বাক্ষর ও প্রতীকী অনশন কর্মসূচী পালন করা হয়েছে।
অনশনে কুবি শিক্ষার্থী হান্নান রহিম বলেন, “কুয়েট ভিসি নির্লজতার চরম পর্যায়ে চলে গেছে। যেখানে সারাদেশ তার বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার পরও সে নির্লজ্জতার আশ্রয় নিচ্ছে। তার মতে আন্দোলনে তার বিরোধী বেশি শিক্ষার্থী যায়নি। কিন্তু আমরা দেখেছি গতকাল কুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে। তারই ধারাবাহিকতায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণস্বাক্ষর ও প্রতীকী অনশনের ডাক দিয়েছি। আমরা চাই, খুব দ্রুত কুয়েট ভিসি পদত্যাগ করুক। তা না হলে আমরা আরো বড় ধরনের আন্দোলনে যাব।”
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি)
কুয়েটে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন যবিপ্রবির একাধিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা । এছাড়াও তারা বুধবার সকাল থেকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, মানববন্ধন এবং সড়ক অবরোধের মাধ্যমে তাদের সংহতি প্রকাশ করেন।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে এ ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেন।
এ বিষয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী জালিস মাহমুদ বলেন, “কুয়েটে শিক্ষার্থীদের উপরে সন্ত্রাসী হামলা, ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারসহ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিসমূহ না মেনে নিয়ে বর্তমান ভিসি মাসুদ স্বৈরাচারী কায়দায় নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি জাহির করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেখানে একজন উপাচার্যের দায়িত্বই হল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার সমূহের বাস্তবায়ন, বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা ও গবেষণার সূতিকাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষার্থীদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা। সেখানে নিজের শিক্ষার্থীদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে ভাড়াটিয়া গুণ্ডা ও সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কুয়েটের অনশনকৃত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে ‘স্ট্যান্ড উইথ কুয়েট’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্লাস, ল্যাব ও পরীক্ষা বর্জন, মানববন্ধন, প্রতীকী অনশন, ব্লকেড ইত্যাদি বাস্তবায়ন করছে। তারই অংশ হিসেবে আমরা যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা আজকের ক্লাস, ল্যাব ও পরীক্ষা বর্জন করেছি। আমরা এই স্বৈরাচারী ভিসিকে অতিদ্রুত পদত্যাগ কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক তার বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় যবিপ্রবি শিক্ষার্থীরাও সরাসরি কুয়েটে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের কর্মসূচি আরো জোরদার করবে।”
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (গোবিপ্রবি)
কুয়েট শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, ৩৭ জন শিক্ষার্থীর বহিষ্কার এবং চলমান আমরণ অনশন কর্মসূচির প্রেক্ষিতে একদফা দাবির আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন গোবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (২৩ এপ্রিল ২০২৫) দুপুর ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা।
মানববন্ধনে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নিঘাদ রৌদ্র বলেন, “কুয়েটের শিক্ষার্থীরা ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আমরণ অনশনে রয়েছেন। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব। কুয়েটেই নয়, দেশের নানা প্রান্তে শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে—ইন্টারিম সরকার কি অন্ধ?”
ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী ওবায়দুল ইসলাম বলেন, “ভিসি এসিতে বসে থাকেন, আর আমাদের ভাইয়েরা অনশনে থেকে হাসপাতালে ভর্তি হন। হামলার শিকার শিক্ষার্থীদেরই বহিষ্কার করা হয়েছে—এটা অন্যায়। এর বিরুদ্ধে আমরা চুপ থাকতে পারি না। শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কোনো ভিসি দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। আমাদের এই অবস্থান কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির পাশে।”
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)
কুয়েট উপাচার্যের পদত্যাগ ও অপসারণের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন শাবিপ্রবির বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শাবিপ্রবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এই কর্মসূচি শুরু করেন তারা।
অনশনরতরা হলেন—শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের আহ্বায়ক পলাশ বখতিয়ার, গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হাফিজুল ইসলাম (সদস্য সচিব), এবং নগর ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাশিদ আবরার (যুগ্ম সদস্য সচিব)।
সংগঠনের সদস্য সচিব হাফিজুল ইসলাম বলেন, “ইন্টেরিম প্রশাসনকে বলছি, কুয়েট ভিসি পদত্যাগ না করলে তাকে অপসারণ করুন। যে রক্তের ওপর দিয়ে তিনি চেয়ারে বসেছেন, সেই রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবেন না।”
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি)
বুধবার (২৩ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে কুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরণ অনশন বসেছেন হাবিপ্রবির মেকানিক্যাল বিভাগের (২০ ব্যাচের) শিক্ষার্থী মো. বোরহান আহমেদ রাকিব।
‘কুয়েট ভিসি মাস্ট স্টেপ ডাউন’, ‘ইন্টেরিম কি অন্ধ?’, ‘স্ট্যান্ড উইথ কুয়েট’ ইত্যাদি লেখা পোস্টারও সাটিয়েছেন তিনি।
তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, “কুয়েটে বিগত সময়ে বহিরাগতরা এসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। সেখানে উপাচার্য বহিরাগতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাস্পাসও বন্ধ ঘোষণা করেছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে।”
তিনি আরো বলেন, “কুয়েটের শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের একদফা দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন। তাদের এ দাবিকে আমার যৌক্তিক দাবি মনে হয়েছে। আমিও চাই, কুয়েটের উপাচার্য পদত্যাগ করুক, না হলে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। এজন্য আমি কুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরণ অনশনে বসেছি।”
গত ২১ এপ্রিল পূর্বনির্ধারিত ঘোষণা অনুযায়ী কুয়েটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ৩২ জন আমরণ অনশন শুরু করেন। বিকেল ৩টায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের বারান্দার পূর্বদিকে অবস্থান নেন। এরপর সেখানে বিভিন্ন বিভাগের ৩২ জন শিক্ষার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে অনশন শুরু করেন। অনশনরত ৩২ শিক্ষার্থীর মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা।
ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে কমিটি করা হয়। রাতে খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে প্রশাসন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনকে লাল কার্ড দেখান শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তারা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা খুলনা থেকে ঢাকায় এসে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেন। এতে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার, উপাচার্যের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানানো হয়।
এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের ৯৯তম (জরুরি) সভায় সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৮ ফেব্রুয়ারির সংঘর্ষের ঘটনায় প্রকৃত দোষী শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করাসহ পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
এর মধ্যে কুয়েটের ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে নগরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার হোসেন আলী নামের এক ব্যক্তি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালতে মামলা করেন।
আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়ার দাবিতে শিক্ষার্থীরা ১৩ এপ্রিল বিকেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিলে, আন্দোলন আবারও দানা বাঁধতে থাকে।
গত সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে আগামী ২ মে থেকে সব আবাসিক হল শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া ও ৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত হয়।
এর মধ্যে গত ১৫ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের এক দফা দাবির ঘোষণা দেন। ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা কুয়েটের ছেলেদের ছয়টি হলের তালা ভেঙে হলগুলোতে অবস্থান নেন।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারা।
ঢাকা/ইভা/মেহেদী