যে কারণে কপিরাইট আইন মানায় আগ্রহ কম
দেশে মেধাস্বত্বের কপিরাইট পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক অবস্থায় আসেনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মৌলিক সৃষ্টিকর্মের মালিকানা বা স্বত্ব নিশ্চিত করাই হচ্ছে কপিরাইট। সাহিত্য, শিল্পকর্ম, সংগীত, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, লেকচার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, নকশাসহ যেকোনো ধরনের মৌলিক সৃষ্টিই কপিরাইটের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু সচেতনতার অভাবে দেশে কপিরাইট আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
বাংলাদেশে কপিরাইট আইন রয়েছে ২০০০ সাল থেকে। এরপর ২০০৫ সালে এই আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়। কিন্তু সেই আইনেরও প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট নির্মাতারা। তবে, সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র আর সংগীতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কপিরাইট লঙ্ঘিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস জাফর রাজা চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সাহিত্য, শিল্পকর্ম, সংগীত, চলচ্চিত্র, সফ্টওয়্যার ইত্যাদি স্রষ্টা বা রচয়িতার অনুমতি ছাড়া কপি, পুনরুৎপাদন, অনুবাদ, রূপান্তর বা অধিযোজন করা কপিরাইট ধারণা, আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি, দেশীয় আইন, নৈতিকতা ও ইতিবাচক বোধের চরম পরিপন্থী। একটি কোম্পানির বিভিন্ন পণ্য বা সার্ভিস যদি আইনগতভাবে সংরক্ষিত না থাকে, তাহলে সেগুলো যে কেউ ইচ্ছামতো তৈরি করতে পারবে। ফলে সে কোম্পানির ব্যবসা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ পরিস্থিতি ঠেকাতে দরকার হয় ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি আইনের প্রয়োগ।’
দেশে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ও কপিরাইট আইনের ভূমিকা:
বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) সদস্য। এ সংস্থাটির সাধারণ নিয়মকানুন তাই আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর ধারাবাহিকতায়—The Penal Code of Bangladesh। যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ওপর হস্তক্ষেপ রোধ নিশ্চিত করে। তবে, বিভিন্ন শিল্প-ব্যবসায় ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ও কপিরাইট আইনের প্রয়োগ তুলনামূলকভাবে নতুন।
ঝুলে আছে আইনের সর্বশেষ সংশোধনী:
২০১৭ সালে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত কপিরাইট অফিসের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি কমিটির মাধ্যমে প্রায় দুই বছর ধরে কপিরাইট আইনটি সংশোধন করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে মন্ত্রণালয়ে সংশোধনী জমা দেওয়ার পর কিছুটা গতি হারায়। পরিমার্জন করা আইনসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই ঘুরপাক খায় অনেক দিন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন থেকে এটি ভেন্ডিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয়ে এখনো বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রস্তাবিত নতুন কপিরাইট আইনটি কেন গুরুত্বপূর্ণ তা এতে সংযোজিত নানা বিষয়ের দিকে তাকালেই অনুধাবন করা যায়। এতে কপিরাইটের একটি সহজ সংজ্ঞা সংযোজন করা হয়েছে। সময়ের দাবি অনুসারে বেশ কিছু উপধারা (সংজ্ঞা) যেমন, নৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রিলেটেড রাইটস, পাবলিক ডোমেইন, সংকলক প্রভৃতি সংযোজন করা হয়েছে। শিল্পকর্মের সংজ্ঞাসহ বেশ কিছু উপধারা আধুনিকায়ন করা হয়েছে। রেজিস্ট্রারের আদেশের রিভিউ করার বিধান রাখা হয়েছে। কপিরাইট টাস্কফোর্সকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কয়েকটি জটিল ধারা ভেঙে বিভিন্ন উপধারায় বিভক্ত করে সহজীকরণ করা হয়েছে। কপিরাইট লঙ্ঘনজনিত মামলা দায়রা জজ ছাড়াও দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে বিশেষ আদালত বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারবেন। এ সংশ্লিষ্ট একটি বিধান রাখা হয়েছে। লোকজ্ঞান ও লোক-সংস্কৃতির অধিকার সুরক্ষা পাবে প্রস্তাবিত এই আইনে। বিদ্যমান আইনের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে সচেতনতার অভাব। এ লক্ষ্যে কপিরাইট বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করতে প্রদত্ত আইনে নানা পদক্ষেপ আছে। ডিজিটাল মিডিয়ার সুযোগে ইউটিউবসহ নানা গান, নাটক, ইত্যাদির উপার্জনে প্রণেতাকে উপেক্ষা করা হয়। প্রস্তাবিত আইনে উল্লিখিত মাধ্যম থেকে অর্জিত আয়ে প্রণেতার অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ছাপানো হরফে যেকোনো বই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়ার উপযোগী নয়, সেগুলো ডিজিটাল টকিং বই, ব্রেইল বই, অ্যাকসেসিবল ইলেকট্রনিক টেক্সট অথবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য পাঠযোগ্য করার ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কপিরাইট আইনের এই সামান্য পরিবর্তন এসডিজি গোল সবার জন্য একীভূত শিক্ষা অর্জনে সহায়ক হতে পারে।
কপিরাইটবিষয়ক রেগুলেটরি হিসেবে কপিরাইট অফিসকে আগের অবস্থা থেকে আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন প্রয়োগের ক্ষেত্র কার্যকারিতা বাড়তে শাস্তি ও জরিমানা বাড়ানো, টাস্কফোর্স গঠন ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৯৩ ধারায় পুলিশ যেন কাউকে অহেতুক হয়রানি বা কেউ হটকারী আচরণের শিকার না হয়, সেই লক্ষ্যে ‘রেজিস্ট্রার বা উপযুক্ত প্রতিনিধি দ্বারা অবহিত’ এমন শব্দ সংযোজন করা হয়েছে। এই সংযোজনীতে বলা হয়েছে, ‘সাব-ইন্সপেক্টরের নিম্নতর পদাধিকারী নহেন, এমন যেকোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি এই মর্মে রেজিস্ট্রার বা উপযুক্ত প্রতিনিধি দ্বারা অবহিত হন যে, ধারা ৮২-এর অধীনে কোনো কর্মের বা ধারা ৮৪-এর অধীনে কোনো কম্পিউটার কর্মের কপিরাইট লঙ্ঘনজনিত কোনো অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে, হইতেছে বা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাহা হইলে তিনি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই কর্মটির সব অনুলিপি লঙ্ঘনকারী অনুলিপি তৈরি, বিতরণ, প্রদর্শন ও বহনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সব প্লেট, সামগ্রী, উপকরণ যেখানেই পাওয়া যাক, তাহা জব্দ করিতে পারিবেন।’
নতুন আইনে কপিরাইটের আওতা, প্রণেতার আর্থিক অর্জন সুসংহতকরণ ও এ বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত উদ্যোগের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।
নতুন আইনের খসড়ার ৮৩ ধারায় সংযোজন করে বলা হয়েছে, কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে শাস্তি ৩ বছরের জায়গায় ৫ বছর এবং অন্যূন ৬ মাসের পরিবর্তে একবছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ‘বাংলাদেশে কপিরাইট আইন-২০০০’ (২০০৫ সালে সংশোধিত) কার্যকর আছে। এ আইনে ডিজিটাল সময়ের মেধাসত্ত্বের অনেক কিছুরই সমাধান হচ্ছে না। সে লক্ষ্যে আইনটি সংশোধন করা হলেও তা আলোর মুখ দেখছে না। দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে সংশোধনটি।
আরও পড়ুন :
*কপিরাইট: আইনি সুরক্ষা কোন পথে
*কপিরাইট: পাইরেসি ও চৌর্যবৃত্তি
*কপিরাইট নিয়ে ফটোগ্রাফারদের ভাবনা
এনই/তারা