কর্মপরিবেশ তৈরি না হলে পণ্য বিক্রি বন্ধ: সালমান এফ রহমান
যেসব শিল্প কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হবে না ভবিষ্যতে দেশের বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) চামড়া শিল্প নিয়ে এক অনলাইন আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি। ‘রিভাইভিং দ্য লেদার সেক্টর ইন দ্য আফটারম্যাথ অব কভিড-১৯’ বিষয়ক ভার্চুয়াল এই আলোচনা সভার আয়োজন করে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্স অ্যান্ড পলিসি ইন্ট্রিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)।
ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে তিনটি পৃথক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ (পিআরআই) এর গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক ও র্যাপিড এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. এম আবু ইউছুফ।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক ড. মিজানুর রহমান, ডিটিআইইডব্লিউটিপিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম জাহিদ হাসান ও ট্যানারি ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ।
অনুষ্ঠানে এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ন সচিব জিনাত আরা বক্তব্য রাখেন।
সালমান এফ রহমান বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পের অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের মতো দেশেই বিশেষ তদারকি প্রতিষ্ঠান গঠন করে সব কারখানাকে কমপ্লায়েন্স করা হবে। কমপ্লায়েন্স হওয়ার ক্ষেত্রে কারখানাগুলোকে সরকার দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়ন করতে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের দেশের শিল্প কারখানার বড় সমস্যা কমপ্লায়েন্স। তাজরীন ফ্যাশন ও রানা প্লাজার ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতাদের চাপে তৈরি পোশাক শিল্পে কমপ্লায়েন্স হয়েছে। ব্র্যান্ডগুলোও স্বীকার করছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স। তবে বড় সমস্যা স্থানীয় বাজারের জন্য যারা পণ্য উৎপাদন করেন তাদের। সর্বশেষ সেজান জুস কারখানায় আগুণের ঘটনা তার প্রমাণ। সব আন্তর্জাতিক পত্রিকায় এর শিরোনাম হয়েছে। যা আমাদের জন্য নেতিবাচক।
তিনি বলেন, এখন প্রশ্ন হলো- স্থানীয় শিল্প কারখানাকে কিভাবে কমপ্লায়েন্স করবো। আমি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের মতো কিছু একটা করতে হবে। কমপ্লায়েন্স করার জন্য কারখানাগুলোকে দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়ন করতে হবে। সরকার সেক্ষেত্রে কারখানাগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়ন করবে। ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, যেসব স্থানীয় শিল্প-কারখানার কমপ্লায়েন্স থাকবে না তাদের পণ্য বাজারে বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হবে।
সাভার চামড়া শিল্পনগরী প্রসঙ্গে সালমান এফ রহমান বলেন, আমরা এখনও এটাকে কমপ্লায়েন্স করতে পারিনি। সিইটিপির নকশা যারা করেছিল তারা কাজটি সঠিকভাবে করেনি। আমরা অত্যাধিক মাত্রায় বুয়েট নির্ভর হয়েছি। কিন্তু বুয়েট আমাদের সাংঘাতিকভাবে ভুল পথে হাঁটিয়েছে। বারবার ভুল নকশা করেও তা স্বীকার করেনি। আমাদের ঘুরিয়েছে। তবে যেহেতু একটা অবকাঠামো হয়ে গেছে, তা ভেঙে ফেলা যাবে না। এখন এটাকে সংস্কার করে এগোতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, আমাদের পরিকল্পনা বিদেশি কাউকে দিয়ে সিইটিপির প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষ করা। আমি এরই মধ্যে একটি উদ্যোগ নিয়েছি। একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানিকে বলেছি এর দায়িত্ব নিতে। তাদের বলেছি, এটাকে কিভাবে এডব্লিউজি এর সনদ পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় তা করো। তারা এরই মধ্যে সাভার সিইটিপি নিয়ে কাজ করছে। শিগগিরই তারা আমাকে একটা প্রেজেন্টেশন দেবে। বাণিজ্য মন্ত্রণায়কে বলেছি তারা যেনো বিষয়টি গুরুত্ব নিয়ে দেখে।
গার্মেন্টসের মতোই সব খাতে সুবিধা দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, গার্মেন্টস যে সুবিধা পায় তা পেলে অন্য খাতও ভালো করবে এটা আমরা সবাই বুঝি। এ বিষয়টিতে প্রধানমন্ত্রী একমত। এটার ওপর আমরা শতভাগ সমর্থন দিয়ে কাজ করছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলবো তা নিয়ে যেনো কাজ করা হয়।
ড. আব্দুর রাজ্জাক তার প্রবন্ধে বলেন, করোনায় এই সময়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য ১০ শতাংশ কমলেও চামড়াজাত পণ্যের বাণিজ্য কমেছে ২২ শতাংশ। অর্থাৎ চামড়াজাত পণ্য খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অন্যদিকে বৈশ্বিকভাবেই নন লেদার পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। পাশাপাশি কাঁচামালের দামও বাড়ছে। ফলে চামড়া শিল্পের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে চীন থেকে বড় বড় ব্র্যান্ডের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগটি কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা দারুণ বলে মনে করেন তিনি। এজন্য ট্যানারি শিল্পনগরীকে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলা ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মহাপরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
ড. আবু ইউসুফ বলেন, চামড়াজাত পণ্যের তিনটি আইটেমে (লেদার, লেদারগুডস ও ফুটওয়্যার) গত বছর প্রবৃদ্ধি ছিল। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য সব স্তরে কমপ্লায়েন্স হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। পশু পালন, পশু জবাই, কাঁচা চামড়া প্রস্তুতকরণ ও ট্যানারি কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কমপক্ষে ১৫টি ট্যানারি কারখানাকে এলডব্লিউজির সনদ পাওয়ার ব্যাপার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলছে।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর তার প্রবন্ধে বলেন, গত বছর চামড়াজাত পণ্যে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০১৯ সালের তুলনায় এটি ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। তবে বৈশ্বিক বাজারে বিপুল চাহিদা রয়েছে। বিশ্বে প্রতিদিন ৩০০ মিলিয়ন ডলারের জুতা বিক্রি হয়। এর চাহিদা কমবে না। ব্র্যান্ডগুলো এখনও টেকসই লেদার চায়। তবে লজিস্টিক ও শিপিং ব্যয় বৃদ্ধি আমাদের চামড়া শিল্পের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, গত বছর যে প্রবৃদ্ধি চামড়া শিল্প দেখেছে তা টেকসই করতে হবে। এজন্য একটা মহাপরিকল্পনা নেওয়ার প্রয়োজন। কমপ্লায়েন্স ছাড়া ব্যবসা করা যাবে না, এটা নিশ্চিত করতে হবে।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, আমাদের অনেক কাঁচামাল থাকার পরও চামড়া শিল্প পিছিয়ে থাকার কারণটা বের করতে হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। বলেন, তৈরি পোশাকের মতো এ শিল্পের ক্ষেত্রেও সমান সুযোগ দিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
রপ্তানির ক্ষেত্রে এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি ও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের চুক্তির রয়েছে। ওষুধ শিল্পসহ কয়েকটি খাতে বিদ্যমান সুবিধা ২০২৬ সালের পরও যেনো অব্যাহত থাকে সে আলোচনা চলছে।
আলোচনায় চামড়া শিল্প খাতের উদ্যোক্তা, সরকারের সংশিষ্ট সংস্থার নীতি-নির্ধারক, শ্রমিক প্রতিনিধি, দাতা সংস্থা ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
/হাসনাত/এসবি/