বাজেট ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার সুপারিশ
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশীয় ব্যাংক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিবর্তে স্বল্প সুদে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।
শনিবার (১১ জুন) রাজধানীর মতিঝিলে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ সুপারিশ করে এফবিসিসিআই। এতে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও বিভিন্ন চেম্বারের সভাপতিরা।
সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআইর সভাপতি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি রাখা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকারকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিতে হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ঋণের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরতা বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এতে দেশীয় শিল্প সম্প্রসারণে বাধার সৃষ্টি হতে পারে।’
মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘যথাযথ বিনিয়োগ ও শিল্পোন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারাকে অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। রাজস্ব নীতিতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি, যাতে বিনিয়োগকারীরা আস্থার সঙ্গে বাবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারেন। মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির মধ্যে সুসমন্বয় রাখা জরুরি।’
লিখিত বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও কাঁচামালের মূল্য এবং শিপিং ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সব ধরনের পণ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা আগামী বাজেট বাস্তবায়নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেটেও মূল্যস্ফীতির বিষয়টিকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনুৎপাদনশীল এবং অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ খরচ কমানোর পাশাপাশি বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু বিলাসী পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়েছে, যা আমদানি ব্যয় কমাতে সহায়তা করবে।’
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াকে গতিশীল করবে। এসব উদ্যোগ এসডিজি-৭, ৮ ও ৯ অর্জনে ভূমিকা রাখবে। অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপকে (পিপিপি) আরও জোরদার করতে হবে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। যা গত বছরের লক্ষ্যমাত্রার (৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা) তুলনায় ১২ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি। কোনো অর্থবছরেই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। ফলে, কর-জিডিপি বাড়ছে না। বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সময়ে শুল্ক-কর আয় বাড়ছে। মূলত কর ব্যবস্থা সহজ ও ব্যবসাবান্ধব করা দরকার। পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ইন্টিগ্রেটেড ও অটোমেশন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা জরুরি। এতে ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে বলে মনে করছে এফবিসিসিআই।’
খেলাপি ঋণ মওকুফ করা হলে তা করযোগ্য আয় হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছে এফবিসিসিআই।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ মওকুফ করা হলে তা করযোগ্য আয় হিসেবে গণ্য করা হবে কেন? দুর্ভোগ লাঘবের জন্যই খেলাপি ঋণ মওকুফ করা হয়ে থাকে বিধায় মওকুফকৃত ঋণের ওপর কর আরোপ করা যুক্তিযুক্ত নয়। আমরা মনে করি, আয়ের ওপর কর আদায় করাই হচ্ছে আয়করের মূলনীতি।’
তিনি বলেন, ‘রপ্তানিকারক কর্তৃক রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশের পরিবর্তে ১ শতাংশ উৎসে কর কর্তনের বিধান বাতিল করে আগের মত (০.৫০ শতাংশ) রাখার প্রস্তাব করছি। অর্থবিলে রপ্তানির সংজ্ঞাকে সংকুচিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের ক্ষেত্রে ঋণপত্রের পাশাপাশি চুক্তিপত্রের মাধ্যমে স্থানীয় সরবরাহকে রপ্তানির সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছি। সোলার প্যানেল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক শূন্য শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১ শতাংশ করা হয়েছে। সোলার প্যানেলের ওপর আরোপিত আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের অনুরোধ করছি।’
জসিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে উৎপাদকদের কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে কর ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ এবং ব্যবসায়িক পণ্যের সরবরাহের ওপর উৎসে করের হার ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। উৎসে কর ফেরতযোগ্য এবং ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি করে বিধায় উৎসে কর প্রত্যাহারের জন্য আমরা আবার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয়, মুদ্রাস্ফীতি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে ব্যক্তি শ্রেণির আয়করের সীমা বর্তমান ৩ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৪ লাখ টাকা করার জন্য প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু, প্রস্তাবিত বাজেটে আয়করের সীমা বৃদ্ধি করা হয়নি। আয়করের সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। ভারতে আয়করের সীমা ৫ লাখ রুপি।’
মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কর অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের মূল্য ও খরচ বৃদ্ধির কারণে সাধারণ ভোক্তার ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান পণ্যমূল্য দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এ সমস্যা নিরসনে এফবিসিসিআই উৎপাদনমুখী খাতসহ নিত্যব্যবহার্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের পরোক্ষ করে রেয়াত দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ ধরনের শুল্ক ও কর রেয়াতের ব্যবস্থা নিয়েছে।’
প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কয়েকটি বিশেষ খাতে মূসক, আগাম কর, উৎসে কর, অগ্রিম কর ইত্যাদি সহ আমদানি শুল্কে রেয়াত দেওয়া হলেও সামগ্রিক শিল্প বাণিজ্য খাত এসব শুল্ক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। ফলে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অসমতা দেখা দিচ্ছে। এ সমস্যা নিরসনে এফবিসিসিআইয়ের প্রাক-বাজেট প্রস্তাবনাগুলো পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানান এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
হাসনাত/রফিক