চলতি বাজেটেও স্বাস্থ্যখাত ‘অবহেলিত’
করোনা মহামারির সময়ই ২০১৯-২০২০ সালের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের দুরবস্থার চিত্র ফুটে উঠে। কিন্তু এরপরও বাজেটে প্রত্যাশিত মনোযোগ পাচ্ছে না এ খাত। এবারের বাজেট স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ থাকছে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। এসব বরাদ্দ সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৩৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এবারে বাজেটে বরাদ্দ ৩ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা বাড়লেও মোট জিডিপির তুলনায় এই খাতে বরাদ্দ খুব একটা বেশি নয়। কোভিডের আগের প্রতিবছরের বাজেটের ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটেও স্বাস্থ্যখাত ‘অবহেলিত’ বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে একজন বাংলাদেশির বছরে ৮৮ ডলার খরচ করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু খরচ হয় ৫৮ ডলার, যার বড় অংশই নাগরিকেরা নিজেরা সংস্থান করেন।
গত পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ সময় স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ৫ শতাংশের আশপাশে ছিল। অন্যদিকে, মোট জিডিপি অনুপাতের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ১ শতাংশের মতো।
উন্নয়ন খাতের বরাদ্দে সরকার স্বাস্থ্যের চেয়ে রাস্তাঘাট, জ্বালানি খাতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য খাত বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে শীর্ষ তিনটি খাতের মধ্যে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যখাত নেই। বরাদ্দ পাওয়ার বিবেচনায় শীর্ষ তিন খাত হলো- স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগ। এই তিন খাতই এডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দে বড় কোনও পরিবর্তন আসেনি। করোনার পর স্বাস্থ্যে বাজেট বাড়ানোর বিষয়ে নানা আলোচনা হলেও বাস্তব অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ বাজেটের ৫ ও জিডিপির ১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্যে বাজেটের আকার ছিল ২৯ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা, যা ছিল ওই বাজেটের ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। পরের কয়েক বছর কোভিডের ডামাডোল থাকলেও অগ্রাধিকারে তেমন পরিবর্তন আসেনি। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাজেটের ৫ শতাংশের আশপাশেই ছিল। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে ৩৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে হচ্ছে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে এডিপির মাত্র ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বরাদ্দ থাকছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যখাতে মোট এডিপির ১১ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছিল।
বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে ৫৬টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৮টি হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ বিভিন্ন ধরনের ভবন নির্মাণসংক্রান্ত। বাকিগুলো গবেষণা, দক্ষতা, সেবা স্বয়ংক্রিয় করতে নেওয়া হয়েছে।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু চিকিৎসা ব্যয় অনেক কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে একজন মানুষের চিকিৎসা খরচ প্রতিবছরে ৫৮ ডলার। অথচ মাথাপিছু চিকিৎসা খরচ ভারতে ৭৪ ডলার, ভুটানে ১৮০ ডলার, মালদ্বীপে ১০৩৮ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১৬৬ ডলার এবং নেপালে ৬৫ ডলার।
বিশেষজ্ঞরা জানান, স্বাস্থ্যখাতে একজন বাংলাদেশি যত টাকা খরচ করেন, তার দুই-তৃতীয়াংশই খরচ করেন নিজের পকেট থেকে। অথচ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে মাথাপিছু চিকিৎসা খরচ অন্তত ৮৮ ডলার হওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতাল ভবন বানানো হয়, ১০০ শয্যার হাসপাতাল ২০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। সেই অনুসারে লোকবল নিয়োগ হয় না। ফলে ভবন, যন্ত্রপাতি পড়ে থেকে নষ্ট হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, নীতিনির্ধারকদের অগ্রাধিকারে স্বাস্থ্যখাতের নাম নেই। কোভিডের সময়ে খাতটি কিছুটা নজরে এসেছিল। কিন্তু এখন এটি আর নজরে নেই। স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাতে হবে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম সক্রিয় করার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট জনবল বাড়াতে বিনিয়োগ করতে হবে। বিভিন্ন শূন্য পদে লোকবল নিয়োগ করতে হবে। যদিও এসবের চেয়ে অবকাঠামো নির্মাণে বেশি আগ্রহী সংশ্লিষ্টরা। সেবায় তেমন বিনিয়োগ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উদ্বোধন করা হয় ভবন, সেবা উদ্বোধন করা হয় না।
/এনএইচ/