সেমিনারে বক্তারা
মানহীন বিদেশি প্রসাধনীর ‘ডাম্পিং স্টেশন’ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ
ঢাকার কারওয়ানবাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে সেমিনারে অতিথিরা। ছবি: রাইজিংবিডি
দেশে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভেজাল, নকল, মানহীন, অনুমোদনহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনসামগ্রীর। বাংলাদেশ যেন বিদেশি এসব পণ্যের ডাম্পিং স্টেশন। প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিন দিন মানহীন পণ্যে সয়লাব হচ্ছে বাজার।
মানসম্পন্ন বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের প্রসাধন পণ্যের চাহিদা রয়েছে। তবে সেই চাহিদা সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী চোরাই পথে বিপুল পরিমাণ নিম্নমানের ভেজাল প্রসাধনী আনছে দেশের বাজারে। এতে ভোক্তারা যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন, তেমনি দেশীয় ও দেশি-বিদেশি যৌথ শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) রাজধানীর কারওয়ানবাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে এক সেমিনারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এমন মত ব্যক্ত করেন।
ভোক্তা অধিপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে এই সেমিনার আয়োজন করে অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিনকেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশ।
এর শিরোনাম দেওয়া হয় ‘মানহীন বিদেশি পণ্যের ডাম্পিং স্টেশন নাকি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মানসম্মত পণ্য: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’।
সেমিনারের জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, দেশীয় পণ্যই দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে। এ জন্য আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে।
তিনি বলেন, “নিজেরা পণ্য উৎপাদন করতে না পারলে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা যায় না। মানুষ সবাইকে নিজের মতো ভালোবাসলে পণ্য উৎপাদনে জালিয়াতি করতে পারত না।
ক্ষতিকর কোনো পণ্য উৎপাদন না করার আহ্বান রেখেছে ভোক্তার মহাপরিচালক আখতার খান বলেন, দেশে বিশ্বমানের কসমেটিকস ও হোমকেয়ার পণ্য উৎপাদন হলে এর সঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়বে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, “বিদেশি মানহীন পণ্য আমদানির ফলে বিপুল অঙ্কের টাকা চলে গেছে বিদেশে। তবে দেরিতে হলেও আন্তর্জাতিক পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠান। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্যগুলো স্থানীয় বাজারে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
“নিজস্ব কারখানায় মানসম্মত পণ্য বাজারজাতকরণে এরই মধ্যে তারা সাড়াও ফেলেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম রিমার্ক এইচবি শীর্ষ কোম্পানি রিমার্ক এলএলসি ইউএসএ-এর এফিলিয়েটেড প্রতিষ্ঠান রিমার্ক-হারল্যান। তাদের পণ্য ব্যবহার করে ক্রেতারা সন্তোষ প্রকাশ করছেন।”
অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতে জোর দিয়ে বলেন, “বিদেশি নিম্নমানের পণ্য আমদানি না করে দেশে উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন হলে এবং ব্যবহারে মানুষ আগ্রহী হলে দেশের অর্থনীতির জন্যও তা ইতিবাচক।
“এতে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়। প্রকারান্তরে, আমদানি হলে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়। আর নিম্নমানের মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ে।”
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআই-এর সাবেক পরিচালক ইসহাকুল হোসেন সুইট বলেন, “রিমার্ক-হারল্যানের মতো দেশীয় কোম্পানি মানসম্মত অথেনটিক পণ্য উৎপাদন করায় ক্রেতাদের মাঝে দেশীয় পণ্য ব্যবহারে আগ্রহও বাড়ছে।
“এ খাতে আরো বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে সরকারের নীতি সহায়তা বাড়ানোর প্রয়োজন।”
ঢাকার কারওয়ানবাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে সেমিনারে অতিথিরা। ছবি: রাইজিংবিডি
এসএমই ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলী জামান বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে দেশে মানসম্মত পণ্য উৎপাদিত না হওয়ায় বিদেশি পণ্যের ডাম্পিং স্টেশন হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। এমন অবস্থা চলতে পারে না।
“তবে খুশির কথা হলো দেশে এখন মানসম্মত পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, তার প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহও বাড়ছে। সুতরাং দেশে উৎপাদিত গুণগত মানের পণ্যের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস যেন বাড়ে, সে উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে।”
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল জলিল বলেন, ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য বাজারজাত বন্ধ করতে হবে।
আমদানি করা বিদেশি নিম্নমানের পণ্য ব্যবহার না করে দেশে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারের জন্য্য সবার প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।
বিএসটিআই-এর কর্মকর্তা নোভেরা বিনতে নূর বলেন, বিএসটিআই চেষ্টা করছে পণ্যের মান নিশ্চিতের পর যেন বাজারজাত হয়। নতুন পণ্যের বাজারজাতকরণের আগে পণ্য, মোড়কসহ সব বিষয়ের মান নিয়েও কাজ করছে বিএসটিআই।
স্কিন কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিনা হক মনে করেন, “নকল ও ভেজাল বিদেশি পণ্য ব্যবহার করে মানুষ স্কিন ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় মানসম্পন্ন পণ্য ব্যবহার করা।
“রিমার্ক ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে, মানুষের জীবনমান উন্নয়নে যেসব পণ্য বাজারে আনছে, আশা করি দেশের মানুষ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসব পণ্য ব্যবহার করে উপকৃত হবেন।”
চিত্রনায়ক সিয়াম আহমেদ বলেন, দেশে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানসম্মত কসমেটিকস, স্কিন কেয়ার ও হোম কেয়ার পণ্য উৎপাদন হওয়ায় তা ব্যবহারে মানুষের মাঝেও আগ্রহ বাড়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে দেশের
মানুষকে আরও আগ্রহী করতে মানসম্মত পণ্য ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে সরকারকেও ভূমিকা রাখা দরকার।
চিত্রনায়ক মামনুন হাসান ইমন জানান, দেশে উৎপাদিত মানসম্মত ও অথেনটিক পণ্য ব্যবহারে মানুষের মধ্যে আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। মানুষ এখন দেশীয় পণ্য ব্যবহার করতে চায়।
এ ক্ষেত্রে রিমার্ক-হারল্যানসহ দেশীয় কিছু কোম্পানি এগিয়ে আসায় তাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান তিনি।
এ খাতের বাণিজ্য সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ভেজাল রোধে এখন কাজ করছে। ফলে মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে।
“চাহিদা তৈরি হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযিুক্তির পণ্যের। মানহীন বিদেশি পণ্যের সয়লাব ঠেকাতে তাদের আরও কার্যকর ভূমিকা দেখতে চান দেশের মানুষ। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে মানহীন পণ্যের বাজারজাতকরণে ঠেকাতে না পারলে দেশীয় বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে,” বলেন জামাল উদ্দীন।
তিনি শ্রমঘন এই শিল্পের প্রসারে সুষম শুল্ক কাঠামো নির্ধারণের জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানান।
ঢাকা/হাসান/রাসেল