মানিলন্ডারিং আইন লঙ্ঘন
কাট্টালি টেক্সটাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সিআইডিকে নির্দেশ
পুঁজিবাজারে বস্ত্র খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি কাট্টালি টেক্সটাইল লিমিটেডের বিরুদ্ধে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিল ‘নয়ছয়’ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অভিযোগ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
ইতোমধ্যে বিএসইসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। বিএসইসির ওই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে সিআইডি।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বরাবর পাঠানো হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
সিআইডিতে পাঠানো চিঠিতে বিএসইসির উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেন্ত কমিশন গত ১৬ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে কাট্টালি টেক্সটাইল লিমিটেডের আইপিও অর্থ ব্যবহারসহ অন্যান্য বিষয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কমিশনে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কাট্টালি টেক্সটাইল লিমিটেডের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সংস্থা অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ পুলিশ বরাবর প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অতএব, এ বিষয়ে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি নির্দেশক্রমে প্রেরণ করা হলো।
কাট্টালি টেক্সটাইল লিমিটেড ২০১৮ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ৩৪ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু, দীর্ঘ পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও কোম্পানিটি আইপিও তহবিল ব্যবহারে ব্যর্থ হয়। কোম্পানিটি আইপিও তহবিলের মাধ্যমে মূলধনী যন্ত্রপাতি ক্রয়, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার স্থাপন এবং আইপিও খরচ বহন করার জন্য শেয়ারবাজার থেকে ৩৪ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে তহবিল ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানিটি আইপিও তহবিলের মাত্র ১৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যবহার করেছে।
কোম্পানিটির আইপিও তহবিল ব্যবহারে ব্যর্থতা জানতে ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর তিন সদস্যের একটি কমিটি তদন্ত গঠন করে বিএসইসি। কমিটির সদস্যরা হলেন— বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, উপ-পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাসুদ খান।
কাট্টালি টেক্সটাইল লিমিটেডের বিরুদ্ধে অভিযোগ
কাট্টালি টেক্সটাইল পুঁজিবাজারের অন্যতম আলোচিত কোম্পানি। আইপিও তহবিল উত্তোলনের বিষয়টি বেশ বিতর্কিত ছিল। কিছু বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সুবিধা ব্যবহার না করে কেবল চট্টগ্রামে এর কারখানা ভবন থেকে ভাড়া আদায়ের ওপর নির্ভর করে চলছে। পরবর্তী সময়ে কোম্পানিটি নির্ধারিত সময়ে আইপিও তহবিল সঠিকভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে কোম্পানিটি সময়মতো তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রত্যাশিত রিটার্ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আইপিও তহবিল ব্যবহারে ব্যর্থতার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কোম্পানিটির আর্থিক বিবরণীসহ সার্বিক ব্যবসা কার্যক্রম যাচাই করে দেখেছে বিএসইসির তদন্ত কমিটি। সেখানে কোম্পানিটির আইপিওর অর্থ নয়ছয় করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এর আগে আইপিও তহবিল ব্যবহারে ব্যর্থতার জন্য ২০২০ সালের জুলাই মাসে বিএসইসি কাট্টালি টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ১ কোটি টাকা জরিমানা করে এবং স্বতন্ত্র ও মনোনীত পরিচালক ব্যতীত অন্য পরিচালকদের প্রত্যেককে ৫০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এবার সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে সিআইডিকে দায়িত্ব দিয়েছে বিএসইসি।
কোম্পানির আর্থিক অবস্থা
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাববছরে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গত ২৮ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ০.২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর পুরোটাই নগদ লভ্যাংশ। প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের শেয়ারের বিপরীতে ০.০২৫ টাকা নগদ লভ্যাংশ পাবেন শেয়ারহোল্ডারা। তবে, ঘোষিত লভ্যাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের দেওয়া হবে না। ঘোষিত লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতিক্রমে অনুমোদনের জন্য কোম্পানিটির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) গত ২১ নভেম্বর হাইব্রিড পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। ঘোষিত লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বিতরণে রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয়েছিল ২২ অক্টোবর। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে (০.৮৪) টাকা। আগের হিসাববছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল (০.৩২) টাকা। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৫.০২ টাকা।
কোম্পানির সার্বিক পরিস্থিতি
কাট্টালি টেক্সটাইল লিমিটেড বিভিন্ন ধরনের পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি করে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ দেওয়ার নাম-গন্ধও নেই। ২০২১ সালের পর ২০২৪ সালে কোম্পানিটি নামমাত্র লভ্যাংশ দিয়েছে। তাই, এ কোম্পানিকে ‘জেড’ থেকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। কোম্পানিটির স্বল্প মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। কোম্পানির রিজার্ভ রয়েছে ৫৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১১৬ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সে হিসেবে কোম্পানিটির মোট শেয়ার ১১ কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার ২০০টি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ডিএসইর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানির উদ্যেক্তা পরিচালকদের হাতে ৩০.৩২ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২১.৭৯ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.২৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৪৭.৬২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেছেন, ‘‘কাট্টালি টেক্সটাইল লিমিটেডের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আইপিওর মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিল ‘নয়ছয়’ করার অভিযোগ ছিল। বিএসইসির তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে তা প্রমাণ হয়েছে। তাই, মানিলন্ডারিং আইন অনুযায়ী সিআইডিকে এ কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি।’’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির মিডিয়া উইংয়ের প্রধান (বিশেষ পুলিশ সুপার) আজাদ রহমান রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা এখনো এ ধরনের কোনো চিঠি পাইনি। চিঠি পেলে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
ঢাকা/এনটি/রফিক