আস্থা ফিরিয়ে পুঁজিবাজার গতিশীল করা বড় চ্যালেঞ্জ
অধ্যাপক আবু আহমেদ, শাকিল রিজভী এবং মো. আল-আমিন
চরম সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে ২০২৪ সাল পার করেছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। কয়েক বছর ধরে চলমান বৈশ্বিক অনৈতিক মন্দা, ব্যাংক খাতে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে গত বছর মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুঁজিবাজার। ফলে, বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়তে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আশা-নিরাশার দোলাচলে শুরু হচ্ছে নতুন বছর ২০২৫। এ বছর স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে পুঁজিবাজারে গতিশীল করাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের প্রত্যাশা, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় নতুন বছরে পুঁজিবাজার যেন ঘুরে দাঁড়ায়। হারানো পুঁজি যেন ফিরে পান বিনিয়োগকারীরা।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সংস্কার যথাযথভাবে সম্পন্ন করা গেলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে, পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ফিরতে হবে। তারা বিনিয়োগে ফিরলেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো সম্ভব হবে। এতেই পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত বছরের বেশিরভাগ সময়জুড়েই পুঁজিবাজার পতনমুখী ছিল। তবে, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর টানা চার কার্যদিবস পুঁজিবাজারে বড় ধরনের উত্থান দেখা যায়। তবে, অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর আবার পতনের ধারায় ফেরে পুঁজিবাজার। একই সঙ্গে লেনদেনে দেখা দিয়েছে খরা। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন নেমে যায় ৩০০ কোটি টাকার ঘরে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক কমে হয়েছিল ৪ হাজার ৮৯৮.৫২ পয়েন্ট, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেছেন, “আশা করছি, আগামী দিনে আমরা একটা প্রকৃত শেয়ারবাজার পাব। আগের মতো কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা পুঁজিবাজার থাকবে না। প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তা গড়ে তোলা হবে। এ বছর আমরা একটা স্বচ্ছ শেয়ারবাজার পাব। তবে, আমাদের বিনিয়োগকারী চান, পুঁজিবাজারে রমরমা ব্যবসা। তাদের মাথা থেকে এগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে। আগামীতে ভালো ভালো কোম্পানির আইপিও এলে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারবেন। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গাটা পাকাপোক্ত হবে।”
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী বলেছেন, “গত বছর পুঁজিবাজারে অনেক খারাপ সময় গেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটের কারণেই বাজারে এই মন্দা অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো বড় চ্যালেঞ্জ হবে। আমি মনে করি, এ বছর মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে সবকিছুতেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে, পুঁজিবাজার রাতারাতি গতিশীল হয়ে উঠবে, এমনটি ভাবা ঠিক হবে না। কারণ, ব্যাংকগুলোতে লুটপাট হয়েছে। এখনও অনেক ব্যাংকে টাকা নেই। ডলার সংকট, উচ্চ সুদের হার এবং অর্থনীতির ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে। এগুলো তো মানতে হবে। এগুলো হলো কঠিন বাস্তবতা। বাজারে সুশাসন নিশ্চত করা, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে ফেরানো এবং ভালো মানের আইপিও আসলে, আশা করা যায়, পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল-আমিন বলেছেন, “দেশের সার্বিক অর্থনীতি গতিশীল রাখার জন্য অনেকগুলো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে যদি মুদ্রাস্ফীতি কমে আসে এবং ব্যাংক সুদের হার কমানো হলে কিছু বিনিয়োগ পুঁজিবাজারমুখী হবে। বর্তমনে পুঁজিবাজার আছে তলানিতে আর ব্যাংক সুদের হার আছে উচ্চ পর্যায়ে। একই সঙ্গে ট্রেজারি বন্ড বা বিলে ভালো রিটার্ন দিচ্ছে। এগুলো যদি একটু ব্যালেন্স করা যায়, তাহলে পুঁজিবাজারে কিছু বিনিয়োগ আসবে। আবার পুঁজিবাজারে অনেকের পুঁজি আটকে গেছে। সেই টাকাগুলো রিলিজ না হলে তারল্য প্রবাহ বাড়বে না। তবে, আশা করা যাচ্ছে, ফান্ডামেন্টাল শেয়ারগুলো আগামীতে ভালো হতে পারে। তবে, বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিনিয়োগকারীদের যদি বিনিয়োগভাবনায় পরিবর্তন না আনা হয়, তাহলে বাজারকে গতিশীল করা অনেক চ্যালেঞ্জের হবে। জানুয়ারি মাসের মধ্যে মিউচুয়াল ফান্ডের গভর্নেন্স ইস্যুতে কিছু সংস্কার করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাজারে যদি নতুন কিছু মিউচুয়াল ফান্ড আসে, আর সেই ফান্ডে যদি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সাপোর্ট থাকে, তাহলে হয়ত বাজার ভালোর দিকে যাবে। তবে, পলিসি সাপোর্ট থাকুক বা না থাকুক, ফান্ড প্রোভাইডাররা সক্রিয় থাকলে পুঁজিবাজার আপন গতিতেই গতিশীল হয়। বাজার মন্দা থাকলে যতই পলিসি সাপোর্ট দেওয়া হোক না কেন, তা কাজে আসে না। তাই, অবশ্যই বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে, তাহলেই পুঁজিবাজার গতিশীল হবে।”
ঢাকা/এনটি/রফিক