ঢাকা     রোববার   ২৩ মার্চ ২০২৫ ||  চৈত্র ১০ ১৪৩১

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

মহাসিন আলী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০০, ১৬ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ (ছবি : মহাসিন)

মহাসিন আলী, মেহেরপুর : ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাঙালী জাতির জন্য দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনে মুজিবনগর (তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলা) আম্রকাননে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ঘোষণা ও শপথ গ্রহণ করা হয়।

 

সরকার ঘোষণা ও শপথ গ্রহণের পর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত, অশ্রু এবং কোটি জনতার আত্মত্যাগের সুমহান ঐতিহ্য সৃষ্টি করে ৯ মাসের এক বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যে কারণে দিনটি প্রতিটি বাঙালীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

মুজিবনগর আম্রকাননের যে স্থানটিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা ও শপথ গ্রহণ হয়, সেই স্থানে ১৯৮৭ সালে গড়ে ওঠে স্মৃতিসৌধ। যা বর্তমানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ নামে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিশেষভাবে পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাস খুঁজতে সারা বছর মুজিবনগরে লোক সমাগম হয়। অনেকে দেখতে আসেন; অনেকে জানতে আসেন। কিন্তু মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের কোন কোন ইতিহাস আছে তা এখনো অনেকের অজানা রয়েছে।

 

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়। এর প্রায় ২০০ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুরের মুজিবনগর আম্রকাননে স্বগর্বে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য। এর পর ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালী স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ লাভ করেন। এরপর স্বাক্ষী হিসেবে স্বাধীন বাংলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধরে রাখতে গড়ে তোলা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ।

 

১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর স্মৃতি মিউজিয়ামের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম। একই দিনে বঙ্গবন্ধু তোরণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনছুর আলী। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার ১৪ কোটি টাকা ব্যায়ে সেখানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ এবং রেস্ট হাউজ নির্মাণ করেন।

 

নীচের তথ্যগুলো মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে পাঠকদের সঠিক ধারণা দেবে।

 

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে লালমঞ্চ : এটি স্বাধীনতার রক্তাক্ত সূর্য। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের স্থানে ২৪ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট প্রশস্ত সিরামিক ইটের তৈরি আয়তকার লাল মঞ্চটিকে স্থান দেওয়া হয়েছে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের মূল ভিতের মাঝখানে। যেখানে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

 

২৩টি স্মৃতিস্তম্ভ : স্বাধীনতার রক্তাক্ত সূর্য হতে বিচ্ছুরিত ২৩ রশ্মির শেষাংশ দ্বারা ২৩ স্তম্ভ বোঝানো হয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্থানী শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিক। দেওয়ালগুলোর প্রথমটির উচ্চতা ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ ২০ ফুট। পরবর্তী প্রতিটির দেওয়াল ক্রমান্বয়ে দৈর্ঘ এক ফুট ও উচ্চতা ৯ ইঞ্চি করে বেড়ে গেছে। যার অর্থ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ৯ মাস ধরে যুদ্ধ করেছিল। শেষ দেওয়ালের উচ্চতা ২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট। প্রতিটি দেওয়ালে ফাঁকে অসংখ্য ছিদ্র আছে। যেগুলো পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠির অত্যাচারের চিহ্ন হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে।

 

একলক্ষ বুদ্ধিজীবীর মাথার খুলি : স্মৃতিসৌধের ভূতল থেকে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু বেদীতে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত দ্বারা এক লক্ষ বুদ্ধিজীবীর খুলি বোঝানো হয়েছে।

 

৩০লাখ শহীদ : স্মৃতি সৌধের ভূতল থেকে ৩ ফুট উচ্চতার বেদীতে অসংখ্য পাথর দ্বারা ৩০ লাখ শহীদ ও মা-বোনের সম্মানের প্রতি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা ও স্মৃতিচারণ প্রকাশ করা হয়েছে। পাথরগুলোর মাঝখানে ১৯টি রেখা দ্বারা তৎকালীন (পূর্ব বাংলার যা পূর্ব পাকিস্থান নামে পরিচিত ছিল) ১৯ টি জেলা বোঝানো হয়েছে।

 

১১টি সিড়ি : স্মৃতিসৌধে আরোহনের জন্য ১১টি সিড়ি রয়েছে। যা মুক্তিযুদ্ধকালীন সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভিক্ত করা হয়েছিলো তা বোঝানো হয়েছে।

 

সাড়ে কোটি ঐক্যবদ্ধ জনতা : লাল মঞ্চ ও ২৩টি দেওয়ালের মাঝে অসংখ্য নুড়িপাথর মোজাইক করা আছে। এটা সাড়ে ৭ কোটি ঐক্যবদ্ধ জনতার প্রতীক।

 

রক্তের সাগর : পশ্চিম পাশে স্মৃতিসৌধের প্রথম দেওয়ালের পাশ দিয়ে শহীদের রক্তের প্রবাহ বয়ে গেছে। যাকে রক্তের সাগর বলা হয়।

 

২১ ফেব্রুয়ারির প্রতীক : স্মৃতি সৌধের প্রধান ফটক থেকে যে রাস্তাটি মূল স্মৃতি সৌধ্যের রক্তের ঢালকে স্পর্শ করেছে। সে রাস্তাটি ভাষা আন্দোলনের বা ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতীকি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এ রাস্তায় সকল প্রকারযান চলাচল নিষিদ্ধ।

 

বঙ্গোপসাগর : স্মৃতিসৌধের উত্তর পাশের আমবাগান ঘেষা যে স্থানটি মোজাইক করা রয়েছে, তা দিয়ে বঙ্গোপসাগর বোঝানো হয়েছে। যদিও বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের দক্ষিণে তবুও শপথ গ্রহণের মঞ্চটির সঙ্গে সামাঞ্জস্য রক্ষার জন্য এটিকে উত্তরে স্থান দেওয়া হয়েছে।

 

এদিকে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস পালন উপলক্ষে মুজিবনগরে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন স্থাপনা ধোয়া মোছা, রঙের কাজ, গাছের গোড়ায় চুন টানা ও স্থাপনায় রঙ করাসহ লাইটিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যবৃন্দসহ আওয়ামীগ নেতৃবৃন্দ ওইসব কাজের তদারকি করেন।

 

 

রাইজিংবিডি/মেহেরপুর/১৭ এপ্রিল ২০১৫/মহাসিন আলী/সনি

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়