ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর জন্ম ইতিহাস

আরিফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩০, ১৯ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর জন্ম ইতিহাস

আরিফুল ইসলাম : ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের পরিবর্তিত রূপই আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৭২ সালে বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই বিদ্যাপীঠের নামকরণ করেন। ১৮৮৪ সালে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজ ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত হয়।

 

এই সময় এটিই ছিল ঢাকার উচ্চ শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয়। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক ও জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়।

 

পুরনো ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে জগন্নাথ কলেজে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবার এই কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় সহশিক্ষা চালু করেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরণ করা হলেও পরের বছরে আবার এটি বেসরকারি মর্যাদায় ফিরে যায়। ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাসের মাধ্যমে এটি পরিপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।

 

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নতুন হলেও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে সুদীর্ঘ দেড়শ বছরেরও পুরনো ইতিহাস। বাংলদেশের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুথান ও মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলনের ইতিহাসে জগন্নাথের অবদান কখনো অস্বীকার করার মতো নয়। পাকিস্তান আমলে সরকার বিরোধী আন্দোলন করায় প্রতিষ্ঠানটিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার।

 

 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একাট্টা হয়ে জগন্নাথের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বরাবরের মতোই ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের মিছিলের মাধ্যমে ঢাকায় প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ২৬  ফেব্রুয়ারি। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকা শহরের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে। ভাষা আন্দোলনের সময় জগন্নাথ ও মেডিক্যাল কলেজে আলাদা করে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রথম পুস্তিকা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ এবং সাব-টাইটেল ছিল ‘কী ও কেন?’ যার লেখক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এই আন্দোলনে সর্বপ্রথম শহীদ হন জগন্নাথের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমদ। ৫২ সালে তিনি জগন্নাথের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম যে ১০ জন ১৪৪ ধারা ভেঙে ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। ভাষা সৈনিক মো. আবদুল জলিল এই প্রতিষ্ঠানে পড়া অবস্থায় ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

 

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের বীজ মূলত জগন্নাথ ও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই বপন করা হয়। ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলনের নেতা হায়দার আকবর খান বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রথমে ছাত্র সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে কলেজ থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। পরবর্তী কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা এই আন্দোলনটি আঁকড়ে ধরেন।’ তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফা আন্দোলনেও জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষিত হলে তার সমর্থনে সফল হরতাল পালনে ভূমিকা পালন করে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কাজী আরেফ আহমেদ ও চিত্র নায়ক ফারুক।

 

 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল কৃতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নাম গর্ব করে বলতেই হয় তাঁরা হলেন- শিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত আলী, আখতারুজ্জামন ইলিয়াস, ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হাসান, সাংবাদিক রাহাত খান, আ ন ম বজলুর রহমান, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সঙ্গীত শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, ড. শামসুজ্জামান খান, হায়াৎ মাহমুদ, বিক্রমপুরের ইতিহাস খ্যাত লেখক শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গবেষক গোলাম মুরশিদ ও মির্জা হারুণ-অর রশিদ, বাংলাদশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ, কথা শিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান, প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বিশারদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ, শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, ইংলিশ চ্যানেল পাঁড়ি দেয়া সাঁতারু ব্রজেনদাস, বাঙালি কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, লেখক ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমাদাদুল হক মিলন, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র সাইদ খোকন, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এ.আর.ইউসুফ, গায়ক ফকির আলমগীর, কিরণ চন্দ্র রায়, হায়দার হোসেন ও বিপ্লব, অভিনেতা এ.টি.এম.শামসুজ্জামান, জাহিদ হাসান, মীর সাব্বির, ফারুক ও প্রবীর মিত্র, জাদুকর জুয়েল আইচ প্রমুখ।

 

শুধু বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জবির পরিমাপ করা যাবে না। জবিকে জ্ঞানের সূর্য বলা যায়। যা ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্ঞানের আলো যাচ্ছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, জবিকে এখনো অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লজ্জা বহন করতে হয়। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে কিছু দিন পরপর হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামতে হয়।  বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি হল দখল করে রেখেছে স্থানীয় দখলদাররা। অবকাঠামোগত সমস্যা ও বাজেট বৈষম্যের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়টি। পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে শিক্ষকদের খাতা দেখার সন্মানিও আটকে থাকতে দেখা যায়। ২১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নেই পর্যাপ্ত পরিবহন ও ক্যান্টিন সুবিধা। সব মিলিয়ে এক সময় বাংলার আলীগড় খ্যাত বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরা করছে। বেশি দিন হয়ত নেই যখন ‘বঞ্চনা’ কথাটির সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘জগন্নাথ’ কে লিখতে হবে।

 

শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেদের জানান দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে জবির শিক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীরা। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু রয়েছে। অনেক আগেই ইউজিসির প্রতিবেদনে এ-গ্রেডভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। বিসিএসসহ সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষাতে গোপন বার-কোড পদ্ধতি চালু করার মাধমে জালিয়াতি রোধে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

(তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া, বিন্দু থেকে সিন্ধু, ব্রাহ্ম স্কুল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ চলা, ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।)

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ আগস্ট ২০১৬/আশরাফুল/বকুল

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়