ঢাকা     শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১৩ ১৪৩১

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ‘অস্থিতিশীল’ রাখে শিক্ষক সমিতি

এমদাদুল হক, কুবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১০:২১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ‘অস্থিতিশীল’ রাখে শিক্ষক সমিতি

রাত ও দিনের পালাবদলে পার হয়ে যায় একটি বছর। ভালো-খারাপ এ দুই ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেটে যায় একটি বছর। এর মধ্যেই ঘটে অনেক ঘটনা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ২০২৪ সালের শুরুটা হয়েছিল শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। 

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ শিক্ষকরা সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে ঘটে বিপত্তি। উপাচার্য কার্যালয়ে সৃষ্টি হয় বাকবিতণ্ডার। এ বাকবিতণ্ডার মাধ্যমেই উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির মধ্যকার দ্বন্দ্ব সামনে আসে।

এরপর শিক্ষক সমিতির অর্ধদিবস ও পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালনসহ নানা ঘটনায় অস্থিতিশীল হয়ে উঠে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। একাধিকবার বন্ধ হয় এ শিক্ষাঙ্গনের দুয়ার। শিক্ষক সমিতি ও উপাচার্যের দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন ছুটি মিলিয়ে ১৫৬ দিন অর্থাৎ প্রায় ৫ মাসের মত বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চেপেছে দীর্ঘ সেশনজট। শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্ব নিয়ে সাজানো হয়েছে এ পর্ব।

আরো পড়ুন:

ফুল দেওয়া নিয়ে হট্টগোল
চলতি বছরে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ফুল দেয়ার পর পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, শাখা ছাত্রলীগ, কর্মকর্তা সমিতি ও কর্মচারী সমিতি ফুল দেয়। এরপর কোটবাড়ি পুলিশ ফাঁড়িকে ফুল দেওয়ার অনুরোধ জানান, উপস্থাপক নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক অমিত দত্ত।

এ সময় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান এসে প্রথমে অমিত দত্তের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল বাকি থাকার পরও তাদের ফুল দিতে দেওয়ার কারণ জানতে চান। পরে একই প্রশ্ন করেন অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের কাছে। এরপর শুরু হয় হট্টগোল। 

নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত ও উপাচার্যকে ‘ডাস্টবিন’ সম্বোধন
গত ৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের লিখিত নিয়োগ পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার দিন সকাল ১০টার দিকে কুবি শিক্ষক সমিতির সদস্যরা সাবেক উপাচার্যের কক্ষে প্রবেশ করেন লিখিত পরীক্ষা বন্ধ করতে বলেন। এরপর সাড়ে ১০টায় সাবেক উপাচার্য প্রশাসনিক ভবনের ৪১১ নং কক্ষে পরীক্ষা হলে গেলে সেখানে শিক্ষক সমিতির সদস্যরাও প্রবেশ করেন। তখন তারা এ নিয়োগ পরীক্ষা অবৈধ ও প্রশ্ন ফাঁস করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুষদের ডিন ও বিভাগটির বিভাগীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে এ পরীক্ষা কোনোভাবে বৈধ নন বলেও অভিযোগ করেন শিক্ষক সমিতির সদস্যরা। পরে ওই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তবে স্থগিত হওয়া পরীক্ষা আজো নেওয়া হয়নি।

পরীক্ষা স্থগিতের পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন দুপুরের খাবারের জন্য উপাচার্য দপ্তর থেকে বের হচ্ছিলেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে তাকে ‘ডাস্টবিন’ বলে সম্বোধন এবং উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান। 

এর জবাবে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন বলেন, “আপনার কথায় পদত্যাগ! হু আর ইউ টু আস্ক মি টু রিজাইন? হু আর ইউ? হু আর ইউ?”
 
ক্লাস বর্জন কর্মসূচি
সাত দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি গত ১২ মার্চ দুইদিন ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে দুই দিনে শিক্ষক সমিতির সাত দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় আবারো ১৮ মার্চ থেকে সেমিস্টার পরীক্ষা ব্যতীত সাত দিনের জন্য শ্রেণী কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা করে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। শিক্ষার্থীদের বিরূপ সমালোচনার শিকার হয় শিক্ষক সমিতি। 

শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন
গত ২৫ মার্চ সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে কুবি শিক্ষক সমিতি মানববন্ধন করে। মানববন্ধনে উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়োগ-পদোন্নতিতে বিধিবহির্ভূত অবৈধ শর্তারোপ, পদোন্নতি বঞ্চিতকরণ, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ডিন ও বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ, তথ্য গোপন করে ইনক্রিমেন্টের নামে অর্থ আত্মসাৎ এবং গবেষণা ফান্ড থেকে জালিয়াতি করে অর্থ লুটের অভিযোগ তোলা হয়।

তিন দপ্তরে শিক্ষক সমিতির তালা
গত ২৫ এপ্রিল শিক্ষক সমিতির সাত দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য- কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। এরপর উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টরের কার্যালয় তালাবদ্ধ করে সংগঠনটি। এতে বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। 

কোষাধ্যক্ষের পথরোধ
গত ২৭ এপ্রিল বিকেল ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামানকে গাড়িসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে পথরোধ করে রাখে শিক্ষক সমিতি। তারা কোষাধ্যক্ষকের গাড়ির চাবি দিয়ে চলে যেতে বলেন। তখন সেখানে বাঁধা দেয় শিক্ষকদের আরেকটি পক্ষ। এতে শিক্ষদের দুই পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে কোষাধ্যক্ষ গাড়ি থেকে নেমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাংলোতে যান।

প্রধান ফটকে শিক্ষক সমিতি তৎকালীন কোষাধ্যক্ষের পথরুদ্ধ করা অবস্থায় শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষক সমিতির সঙ্গে তালা লাগানো নিয়ে বাকবিতণ্ডা করেন। তখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা সংস্কৃতি বন্ধ চান বলে মন্তব্য করেন।

অবস্থান কর্মসূচি ও ত্রিমুখী সংঘর্ষ
সাত দফা দাবির প্রেক্ষিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টরকে অবাঞ্চিত ঘোষণার পর উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গত ২৮ এপ্রিল অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষক সমিতি। এদিন দুপুর ১টা ১২ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন নিজ কার্যালয়ে প্রবেশ করার জন্য প্রশাসনিক ভবনে আসলে শিক্ষক সমিতি বাঁধা দেয়। এ ঘটনার সূত্র ধরে প্রথমে শিক্ষক সমিতির সঙ্গে উপাচার্যের ধাক্কাধাক্কি হয়। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দের মারামারির ঘটনা ঘটে।

এ মারামারির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের আমিনুর বিশ্বাসকে শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ মারধর করেন। এছাড়া শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আবার শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দের উপর চড়াও হন। এতে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামিমুল ইসলাম, লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.জান্নাতুল ফেরদৌসসহ আরো চারজন শিক্ষক আহত হয়। 

উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা
গত ১০ মে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈনের কুশপুত্তলিকা ঝুলিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ। মূল ফটকের সামনে এবং গোল চত্ত্বর সংলগ্ন ডাস্টবিনের উপর এ কুশপুত্তলিকা ঝুলানো হয়েছিল। কুশপুত্তলিকা ঝুলানোকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে। এতে শিক্ষার্থীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে শিক্ষক সমিতি। 

শিক্ষক সমিতির সংবাদ সম্মেলন
গত ২৩ জুন সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অবৈধভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষক সমিতি। সংবাদ সম্মেলনে সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিয়োগের শর্ত কমিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

এ উপাচার্যের সময় বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নিয়ম মেনে দেওয়া হয়নি বলেও তখন অভিযোগ তোলে। সমিতির ভাষ্য, দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘অবৈধ’ ডিন ও চেয়ারম্যানরা নিয়োগ বোর্ডে বসে নিয়োগ দিলে সেই নিয়োগও অবৈধ হবে। 

সংবাদ সম্মেলন শেষে নতুন নিয়োগ বন্ধ রাখার দাবিতে শিক্ষক সমিতি সাবেক উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়। সেখানে তাদের দাবির মুখে ২৪ জুন তিনটি বিভাগের (ইংরেজি, পরিসংখ্যান, পদার্থবিজ্ঞান) এবং ২৭ জুন তিন বিভাগের (কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগ ও আইসিটি বিভাগ) প্রভাষক পদের নিয়োগ পরীক্ষা সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করা হয়।

অর্ধদিবস ও পূর্ণদিবস কর্মবিরতি
বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নির্দেশনা মোতাবেক গত ২৫, ২৬, ২৭ জুন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করে।

এরপর বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী গত ৩০ জুন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণদিবস কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ জুন শিক্ষক সমিতি পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করে।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়