ঢাকা     শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১৩ ১৪৩১

দ্রোহ-দ্বন্দ্বে ‘জ্বলেছে’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ফাহমিদুর রহমান ফাহিম, রাবি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ০৮:৫৪, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
দ্রোহ-দ্বন্দ্বে ‘জ্বলেছে’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

৭৫৩ একর আয়তনের সুবিশাল বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। এর সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ প্রায় ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ যুক্ত রয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র জীবিকা নির্বাহ করেন কয়েক হাজার পরিবার। এই ২০২৪ সাল ছিল অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে একটু আলাদা। যার ছোঁয়া ভালোই লেগেছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক প্রত্যাখ্যান
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে বারবার দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া স্বর্ণপদক এবং প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন মো. নূরুল হুদা নামের এক আইনজীবী। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। নিজে শিক্ষক নিয়োগে আবেদন করে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির কাছে হার মেনেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। এজন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া স্বর্ণপদক ও ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন।

নির্মাণাধীন ভবন ধস
রাবির মাদার বখশ হলের সামনে নির্মাণাধীন এএইচএম কামারুজ্জামান হলের একটি অংশ ভেঙে পড়ে। এতে অন্তত সাত নির্মাণ শ্রমিক আহত হয়। আহতদের মধ্যে তিনজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে কমিটি আজো প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে জানা গেছে।

আরো পড়ুন:

জন্ডিসের প্রকোপ
বছরের শুরুর দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ জন্ডিসের প্রকোপ বেড়ে যায়। ফেব্রুয়ারির প্রথম তিন সপ্তাহে ৩২৪ জন শিক্ষার্থী জন্ডিস পরীক্ষা করেন। তাদের মধ্যে অন্তত ১৩১ শিক্ষার্থীর জন্ডিস ধরা পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসের দোকানগুলোতে সুপেয় পানির অভাব এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার পরিবেশনের কারণে এমনটা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছিলেন চিকিৎসকেরা।

তবে জন্ডিসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসের দোকানগুলোতে একদিন তদারকি ছাড়া কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

খেলা নিয়ে রাবি ও ঢাবি শিক্ষার্থীদের উত্তেজনা
গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ কামাল স্টেডিয়ামে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলোয়াড়দের মাঝে উত্তেজনা বিরাজ করে। একপর্যায়ে তা হাতাহাতিতে গড়ায়। পরে মানবঢাল তৈরি করে পুলিশি পাহারায় খেলোয়াড়দের মাঠ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে রাবি প্রশাসন।

যৌন হয়রানির অভিযোগে চাকরিচ্যুত চিকিৎসক
অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরীকে যৌন হয়রানির দায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের উপপ্রধান চিকিৎসক রাজু আহমেদকে গত ৪ জুন স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩১তম সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

শিক্ষকদের কর্মবিরতি
বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নির্দেশনা মোতাবেক গত ২৫, ২৬, ২৭ জুন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করে রাবি শিক্ষক সমিতি।

এরপর বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী গত ৩০ জুন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণদিবস কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ জুন রাবি শিক্ষক সমিতি পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করে।

কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদ
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদ এবং কোটা সংস্কারের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি পালন করেন রাবি শিক্ষার্থীরা। গত ৪ জুলাই বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে পালিত এ কর্মসূচির তারা দ্রোগের আগুন জ্বালান।

পরবর্তীতে তারা ৮ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে পরবর্তী চার ঘণ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ ভবন সংলগ্ন ফ্লাইওভার এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী রেললাইন অবরোধ করে রাখেন। এছাড়া বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তারা কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদ জানান।

ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়ন
১৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের তাড়া খেয়ে ক্যাম্পাস ছাড়েন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিবসহ নেতাকর্মীরা। এরপর প্রত্যেক হলে হলে অভিযান চালান শিক্ষার্থীরা। এদিন বেশ‌ কয়েকটি মোটরবাইকে অগ্নিসংযোগের ঘটনা‌ ঘটে। দীর্ঘদিন পর প্রথমবারের মতো ক্যাম্পাস থেকে সমূলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বিতাড়িত করা হয়।

শিক্ষার্থীদের ছাড়াতে থানায় শিক্ষকরা
আন্দোলনের সময় রাবির পাঁচ শিক্ষার্থীকে  আটক করে পুলিশ। আটক শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে নিতে থানায় অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। পরে তাদের সঙ্গে নিয়ে ফেরেন শিক্ষকরা।

রাবি প্রশাসনের পদত্যাগ
৮ আগস্ট শিক্ষার্থীদের আলটিমেটামের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ছাত্র উপদেষ্টা, প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষসহ একে একে প্রায় সবাই পদত্যাগ করেন।

হলে হলে তল্লাশি, মাদক অস্ত্র উদ্ধার
২০ আগস্ট থেকে রাবির ছেলেদের ১১টি হলে একে একে তল্লাশি চালান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অভিযান চলাকালে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীও ছিল। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কক্ষে তল্লাশি করে প্রচুর পরিমাণে কনডম, মাদক ও অস্ত্রসহ বিভিন্ন জিনিস উদ্ধার করেন তারা।

পরীক্ষা দিতে এসে গ্রেপ্তার ছাত্রলীগ নেতারা
ছাত্রলীগের দুই নেতা পরীক্ষা দিতে আসলে সহপাঠিরা তাদের সঙ্গে পরীক্ষায় বসবেন না বলে জানান। পরে সহপাঠিদের দাবির মুখে ওই দুই নেতাকে নগরের মতিহার থানা-পুলিশের কাছে সোপর্দ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে তাদের বিরুদ্ধে থাকা পূর্বেই দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এছাড়া পরবর্তীতে আরো অনেকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পোষ্য কোটা বাতিলের দাবি
স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেন তিন শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা চত্বরে অবস্থান নিয়ে তারা এ অনশন শুরু করলে আরো পাঁচজন যোগ দেন। পরে উপাচার্যের আশ্বাসে অনশন ভাঙেন তারা।

এছাড়া স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য বরাদ্দকৃত পোষ্য কোটাকে প্রতীকী ‘কবর’ দিয়ে প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের পাশে পোষ্য কোটার প্রতীকী ‘মরদেহ’ সমাধিস্থ করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বহিষ্কার
বিভিন্ন সময়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ছয়জনকে স্থায়ী বহিষ্কারসহ ৩৩ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। বহিষ্কৃত এ ছয়জনই সাবেক-বর্তমানসহ নিষিদ্ধ সংগঠন রাবি শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।
গত ২১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। শাস্তিপ্রাপ্ত এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৫ জনই নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। বাকিরা সাধারণ শিক্ষার্থী। তবে কোন অপরাধে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তা বিস্তারিত জানানো হয়নি।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়