ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৪ মে ২০২৪ ||  চৈত্র ৩১ ১৪৩১

রূপসজ্জাকারের মানবেতর বর্ণহীন জীবন

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৩, ১৪ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রূপসজ্জাকারের মানবেতর বর্ণহীন জীবন

রাহাত সাইফুল : তাদের হাতের ছোঁয়ায় বদলে গেছেন অনেক তারকা অভিনয়শিল্পী। অন্যকে সাজাতে গিয়ে নিজেদের জীবন সাজাতেই ভুলে গিয়েছিলেন তারা। পেশাগত জীবন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, নিজেদের জীবন ও সংসার অগোছালোই রয়ে গেছে। বলছি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই রূপসজ্জা শিল্পী কাজী হারুন ও আবদুর রহমানের কথা।

কাজী হারুন অর্থাভাবে এখন ভিক্ষা করে জীবনযাপন করছেন। শুধু তাই নয়, অর্থ সংকটের কারণে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে চলছে তার জীবন। অন্যদিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এক বন্ধুর বাসায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন আবদুর রহমান। দুজনেরই আর্থিক অবস্থা করুণ। চিকিৎসার জন্য তাদের আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন।

গত বছর ৩ জানুয়ারি স্ট্রোক  করলে রাজধানীর কমফোর্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আবদুর রহমানকে। আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় পুরোপুরি চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। তারপর থেকে অসুস্থ শরীর নিয়েই দিন পার করছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আবদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন রাইজিংবিডির এ প্রতিবেদক। অসুস্থতার কারণে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না তিনি। অনেকটা কাঁপা গলায় তিনি বলেন, ‘আমার শরীরের অবস্থা ভালো না। শরীর এখন কাঁপছে। চিকিৎসার জন্য টাকা প্রয়োজন। চিকিৎসা করানোর মতো কোনো টাকা আমার কাছে নেই। তাই সবার কাছে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছি। আর সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘চোখে কম দেখি। একা চলতে পারি না। ডাক্তার দেখানো দরকার। স্ট্রোক করার পর থেকে আমি অচল হয়ে পড়েছি। আমার কেউ নেই। আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় থাকি। আমার থাকার একটু জায়গাও দরকার। ওরা কতদিন আমাকে দেখাশুনা করবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক সহযোগিতা কামনা করছি। কিন্তু কীভাবে তার কাছে সহযোগিতা চাইব সেই পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আমাকে একটু সহযোগিতা করুন।’

জানা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে আবদুর রহমান অবিবাহিত। তিনি তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। যার জন্য সংসারে আপন বলতে আর কেউ নেই। এখন বন্ধু আলী আহসানের কাছেই থাকেন তিনি। কিশোর বয়স থেকেই রূপসজ্জার কাজ করেন আবদুর রহমান। ১৯৬৫ সালে ‘মিলান’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথম চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। যদিও সিনেমাটি আলোর মুখ দেখিনি। এরপর অসংখ্য জনপ্রিয় সিনেমায় তিনি শিল্পীদের রূপসজ্জার কাজ করেছেন। এ পর্যন্ত কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তার হাতে উঠেছে অসংখ্য পুরস্কার। এর মধ্যে দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মনের মানুষ’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ মেকআপ ম্যান হিসেবে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর ২০১৪ সালে মাসুদ পথিক পরিচালিত সরকারি অনুদানের সিনেমা ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ সিনেমার জন্য দ্বিতীয়বারের মতো শ্রেষ্ঠ মেকআপ ম্যান হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। সর্বশেষ ‘ভুবন মাঝির নাও’ সিনেমায় মেকআপ ম্যানের কাজ করেছেন।

এদিকে কাজী হারুন বর্তমানে স্ত্রী মহুয়া আকতারকে নিয়ে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ফরিদাবাদ বস্তিতে থাকেন। তিনটি বাড়িতে কাজ করে ঘর ভাড়া দেন স্ত্রী মহুয়া, আর ভিক্ষা করে জীবনধারণের খরচ চালান হারুন। ২০০৯ সালে স্ট্রোক হয় তার, এতে শরীরের ডান পাশ প্রায় পুরোটা অকেজো হয়ে যায়। অসুস্থ হওয়ার কারণে আর কাজ করতে পারেননি, তাই ছিটকে পড়েন চলচ্চিত্র জগৎ থেকে, শুরু হয় অর্থকষ্ট। অনেকটা বাধ্য হয়েই ২০১১ সাল থেকে ভিক্ষা করতে শুরু করেন। অভাবের তাড়নায় এরই মধ্যে তিনি বিক্রি করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হিসেবে পাওয়া সোনার মেডেল। বেঁচে থাকার জন্য হতদরিদ্র, বাকশক্তি হারানো হারুনের ভিক্ষাই এখন একমাত্র উপায়।



এ প্রসঙ্গে কাজী হারুনের স্ত্রী মহুয়া আকতার বলেন, ‘২০১০ সালে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর আমাদের ঘরে আর কোনো টাকা অবশিষ্ট ছিল না। বাড়ি ভাড়া দিতে পারি না, ঘরে খাবার নাই। আমি এরই মধ্যে পাশের এক বাড়িতে কাজ করে কিছু খাবার সংগ্রহ করি। আমি যদি একদিন অসুস্থ হই তবে তিনি (হারুন) কিছুই করতে পারেন না। একবার বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এক মাস খুঁজেও কোথাও পাইনি। তারপর একদিন বাড়ি এলেন। বললেন কমলাপুর ছিলেন, দিন-রাত ভিক্ষা করেছেন, রাতে ইট মাথায় দিয়ে ঘুমিয়েছেন। আমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিলেন। তারপর থেকে ভিক্ষাই করছেন তিনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘মেয়ের বিয়ের সময় আমাদের হাতে কোনো টাকা ছিল না। যে কারণে বাধ্য হয়ে আমরা মেডেলটি বিক্রি করেছিলাম। মেডেলে এক ভরি স্বর্ণ ছিল। তখন স্বর্ণের দাম ছিল মাত্র আট হাজার টাকা। আর যে পুরস্কারটি ছিল, সেটি বিক্রি করতে পারিনি। কারণ পিতলের কোনো দাম নাই। সেটা আমরা ফেলে দিয়েছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। তিনি তো কত শিল্পীকেই সহযোগিতা করেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনিই তো হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এখন এই মানুষটা অসুস্থ হয়ে কাজ করতে পারছেন না, ভিক্ষা করে আর কত দিন চলবে? আমি মেয়ে মানুষ হয়ে বাসাবাড়িতে কাজ করতে পারি। কিন্তু এই দিয়ে তো আর সংসার চলে না। আরেকটু বয়স হলে তো আর ভিক্ষাও করতে পারবেন না। আপনারা আমাদের জন্য কিছু করেন। প্রধানমন্ত্রী যেন আমাদের কিছুটা সাহায্য করেন।’

১৯৭৯ সালে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন হারুন। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমায় কাজ করে প্রশংসিত হন তিনি। ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’ সিনেমায় কাজের জন্য তিনি পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এছাড়াও ‘অন্য জীবন’, ‘শঙ্খমালা’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’, ‘জীবন সংসার’সহ শতাধিক সিনেমায় কাজ করেছেন হারুন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ অক্টোবর ২০১৮/রাহাত/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়