ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৪ মে ২০২৪ ||  চৈত্র ৩১ ১৪৩১

ন ডরাই : বাঙালি মধ্যবিত্ত চিন্তায় চপেটাঘাত

অনার্য মুর্শিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ন ডরাই : বাঙালি মধ্যবিত্ত চিন্তায় চপেটাঘাত

‘ন ডরাই’ সিনেমার একটি দৃশ্য

চলচ্চিত্রের কাজ কী? মানুষকে বিনোদন দেয়া না কি শিক্ষা দেয়া? অথবা বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া? কিংবা শিক্ষার মাধ্যমে বিনোদন দেয়া? নিউ রিয়ালিজম মুভমেন্টের সময় ইতালির চলচ্চিত্রকাররা বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তারা সিনেমার দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আইজেনস্টাইনদের চলচ্চিত্র দর্শন সঠিক ছিল। মাঝখানে চলচ্চিত্র তার গতিপথ হারিয়েছিল।

চলচ্চিত্রের এই বিপথগামীতা শুধু ইতালি কিংবা ব্রিটেনেই হয়নি, উপমহাদেশেও হয়েছে। বেঙ্গল রিয়ালিজমের জনক সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনরা বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের দেখিয়ে গেছেন কোনটা আমাদের চলচ্চিত্রের ঔচিত্য পথ। সেই পথে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যে একেবারে হাঁটেননি তা নয়। তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, ঋতুপর্ণ ঘোষদের চলচ্চিত্রযাত্রা তার উদাহরণ। কিন্তু হাতে গোণা কয়েকজন চলচ্চিত্রকারের পক্ষে প্রতি সপ্তাহে একটি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ অসম্ভব। এজন্য প্রয়োজন অসংখ্য তরুণ নির্মাতা। দীর্ঘদিনের সেই শূন্যস্থান আজ পূরণ হতে চলেছে স্টার সিনেপ্লেক্স প্রযোজিত ‘ন ডরাই’ সিনেমাটির মাধ্যমে।

ট্রেইলার দেখেই দর্শকের বুঝতে অসুবিধা হয়নি এই গল্প এবং এর বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ নতুন। সিনেমাটোগ্রাফিও যে অসাধারণ হবে সন্দেহ নাই। আয়েশা কক্সবাজারের নারী সার্ফার। কতটা সামাজিক বাঁধার মধ্য দিয়ে তিনি সার্ফিং করেন তাই উঠে এসেছে এই গল্পে। শুধু আয়েশা নয়, তাকে ঘিরে সার্ফিং ক্লাবের আরো কিছু চরিত্র উঠে এসেছে গল্পে। কক্সবাজারের নান্দনিক দৃশ্য, পর্যটন শিল্পের বিস্তার, অধিবাসীদের পারিবারিক এবং সামাজিক দিকটিও উঠে এসেছে পটভূমিতে। বাস্তব থেকে নেয়া বলে গল্পে অবাস্তব কোনো দিক নেই বললেই চলে।

গল্পটি ভালো লাগার পেছনে বড় যে কারণটি রয়েছে তা হলো গল্পের দর্শন। গল্পটি নিম্নবিত্তের হলেও এর দর্শন উচ্চ- সন্দেহ নেই। বাংলা চলচ্চিত্রের গল্পে সাধারণত চিন্তার এই শ্রেণী অতিক্রম সম্ভব হয়ে ওঠে না। চিন্তার শ্রেণীর দিক থেকে গল্পটি এতই উচ্চ এবং স্পষ্ট যে, কোনো কোনো দর্শকের কাছে পপকর্ণটিও তিতা লাগতে পারে। আমাদের রক্ষণশীল এবং পুরুষতান্ত্রিক চিন্তায় এর দর্শন এতই আঘাত করে যে, কেউ যদি জানত আয়েশা শেষ অবধি পুরুষতন্ত্রে লাত্থি মেরে ঘুরে দাঁড়াবে, তাহলে সে আগেই হল থেকে উঠে যেত। আরো চতুর দর্শক চিন্তার এই চাপ থেকে বাঁচতে হয়ত হলেই যাবে না। কারণ ট্রেইলারটিই তার জন্য বোরিং মনে হতে পারে। তার চেতন কিংবা অবচেতন জানে, গল্পটি বাঙালি মধ্যবিত্ত চিন্তায় একটি বড় চপেটাঘাত! দেশে নারীরা যখন ধর্ষিত হচ্ছে, অবমূল্যায়িত হচ্ছে তখন নারী স্বাধীনতার এই গল্পটি মানুষকে নাড়া দিতে বাধ্য। দীর্ঘদিন পর্দায় গল্পের দর্শনের যে শূন্যতা ছিল তা চিত্রনাট্যকার শ্যামল সেনগুপ্ত পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন- একথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।

শুরুর দিকে গল্পটি চমৎকারভাবেই এগুচ্ছিল। কিন্তু বিরতির পর থেকে গল্পটি খানিকটা ঝুলে গেছে বৈকি। প্রায় দশ মিনিটের মতো গল্পটি একই জায়গায় ঘুরছিল। কিছু দৃশ্য এমন মনে হয়েছিল যেন দৃশ্য দেখানোর জন্যই গল্প বলা হচ্ছে। এই বিচ্যুতি গল্পকে যে একেবারে কেন্দ্রচ্যুত করেছে তা নয়। একটু পরই গল্পকার বৃত্তে ফিরে এসেছেন। তিন ঘণ্টায় অভ্যস্ত বাণিজ্যিক সিনেমার দর্শকদের ধরে রাখার জন্য গল্পে এ ধরনের মেদ যুক্ত করা হয়েছে কিনা জানি না।

প্রতিটি চরিত্রে দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ছাপ রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সোহেল কিংবা আয়েশাকে একবারও মনে হয়নি তারা কেউ আনকোরা সার্ফার। বিদেশিরাও তাদের চরিত্রের জায়গায় যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন, মার্ক ব্যাতীত। অ্যান্টাগনিস্ট হিসেবে লিয়াকতের নির্মমতা মানুষকে আহত করে। আয়েশার বাবা-মা, স্বামী, শাশুড়ি চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তারা প্রত্যেকেই সাবলীল, দেবর চরিত্রটি ছাড়া। আমির চরিত্রটি আরো ফুটিয়ে তোলা যেত। অভিনয় দেখে মনে হয়েছিল তিনি চরিত্রের সার্ফেস লেবেলে ছিলেন। তবে মাঝেমধ্যে তিনি এতো ভালো অভিনয় করেছেন যে, পুরো সিনেমায় অন্য সব অভিনেতার অভিনয়কে ছাপিয়ে তিনি শীর্ষে আরোহণ করছিলেন। বিশেষত হতাশা এবং মানসিকভাবে আহত হওয়ার মুহূর্তগুলোতে। সোহেলের বন্ধুর চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তাকেও দর্শক মনে রাখবে।

যে কোনো সিনোমর শব্দ শুনে মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় বলা যায় সিনেমাটি প্রুযুক্তিগত দিক থেকে কতটা ভালো হবে কিংবা মন্দ! সেদিক থেকে ‘ন ডরাই’ প্রথম দৃশ্যেই সফল এবং এই সফলতা সিনেমার শেষ অব্দি ছিল। সিনেমার বিষয়ের তুলনায় সঙ্গীতের কথাগুলো ছিল অগভীর। সুর ও গায়কি ভালো হওয়ায় হয়ত তা তাৎক্ষণিক দর্শকের ভালো লাগতে পারে। কিন্তু হল থেকে বের হওয়ার পর গানগুলো অনেকটা হাওয়াই মিঠাই মনে হয়। ‘যন্ত্রণা’ গাণটি খানিকটা ভালো হলেও পরিস্থিতির অনুভূতির সঙ্গে কতটা মিলেছে- প্রশ্ন থেকেই যায়! যিনি আবহসঙ্গীত তৈরি করেছেন নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখেন।

বাংলা ছবির দর্শকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ- আমাদের সিনেমার ফ্রেমগুলো নাটকের মতো। এই সিনেমা সেই অভিযোগটা অনেকটা ঘুঁচিয়ে দিয়েছে। ইতোপূর্বে কক্সবাজারে এতো সিনেমা হয়েছে কিন্তু সমুদ্রকে এতো নান্দনিক চোখে কেউ দেখাতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ আছে। যারা সমুদ্রকে স্বচোখে দেখেছেন তাদের অনেকেই হয়ত কক্সবাজারকে এতোটা সুন্দর দেখেননি। কিছু দৃ্শ্য দেখে মনে হয়, এখনি চলে যাই সমুদ্রে। ক্যামেরা যে পর্দার ভাষা তৈরি করে এটা পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার সফলভাবে দেখিয়েছেন। ঘটনা ও চরিত্রের মানসিক দিকটি লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন ফ্রেম এবং অ্যাঙ্গেলের শট চলচ্চিত্রের ভাষাকে সাবলীল করেছে।

সেটে শিল্প নির্দেশকের যত্মশীল মানসিকতার ছায়া দেখতে পেয়েছেন দর্শক। শুধু আয়েশার মেক-আপ দুয়েক জায়গায় দর্শক বিভ্রান্ত হয়েছে। ক্লোজ শটে দুয়েক জায়গায় আয়েশাকে আমরা ভারি মেকাপে দেখতে পেয়েছি। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের চরিত্র কতটা মেকাপ নেয় তা আরেকটু ভাবা যেত।

সবগুলো দৃশ্যে আলোর ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। এতো চমৎকার ভোর, সন্ধ্যা, রাত বাংলা ছবির দর্শক অনেকদিন দেখেননি। আলোর এই মুন্সিয়ানা সিনেমাটোগ্রাফিকে যে আরো উচ্চতায় নিয়ে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। দুয়েকটা জায়গায় অনুভূতির সঙ্গে রংয়ের ব্যবহার বিভ্রান্ত করেছে বৈকি। যেমন রান্নাঘরের দৃশ্য। সম্পাদক সৃষ্টিশীল মানসিকতা থেকে কাজটা করেছেন বলে আমাদের চোখের জার্নিটা আরামদায়ক ছিল।

শেষের দিকের সংলাপগুলো আরেকটু সম্পাদিত হতে পারত। সার্ফিং ক্লাবের আমির এবং সোহেলের বন্ধু যখন আয়েশা এবং সোহেলের বিয়ে প্রসঙ্গে কথা বলছে তখন বিষয়টি নাটকীয় মনে হলো। সংলাপগুলো আরেকটু সম্পাদনা করলে দৃশ্যটি এতোটা আনকোরা মনে হতো না। সিনেমাতে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের মিশেলে একটি ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। দর্শকদের দিক থেকে চিন্তা করলে এটা দোষণীয় নয়, বরং ভাষাটা বুঝতে সহায়ক হয়েছে। তবু অনেকের কাছে কঠিনই লেগেছে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে পরিচালক তার সর্বোচ্চ দিয়েছেন। আমরা দর্শকরা ভাষা বুঝতে পারছি না, এই ব্যর্থতা আমেদের। একটি চরিত্র তো তার ভাষাতেই কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। মাঝেমধ্যে ইংরেজি সাবটাইটেল ব্যবহার করা হয়েছে। দরকার ছিল না। যেহেতু পুরো সিনেমায় আর কোথাও সাবটাইটেল ছিল না। সাবটাইটেল রাখা, না-রাখার সুবিধা, অসুবিধা দুটোই আছে। রাখলে দর্শকের ভাষা বুঝতে সুবিধা হতো। কিন্তু অসুবিধাটা হতো দর্শক এতো চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফি থেকে বঞ্চিত হতেন। তখন সাবটাইটেলের উপরেই চোখ পড়ত। এদিক থেকে সাবটাইটেল না দিয়ে ভালোই করেছেন পরিচালক। যেটুকু বাংলা সাবটাইটেল দেয়া হয়েছে ফন্ট চোখে লেগেছে। এক্ষেত্রে বিজয় ইউনিকোড বা অন্যকোনো ফন্ট ব্যবহার করা যেত।

মার্কেটিংয়ে বলা হয়েছে এই ছবি সার্ফিং নিয়ে। কিন্তু সার্ফিং নিয়ে কি আসলে সিনেমা হয়? সিনেমা হয় সার্ফিং যারা করে তাদের নিয়ে। মার্কিটিংয়ে যখন বলা হয়েছে সিনেমা সার্ফিং নিয়ে তখন দর্শক পর্দায় সার্ফিং দৃশ্যই বেশি দেখতে চাইবেন। সেই দিক থেকে দর্শক বঞ্চিত হয়েছেন। আয়েশা এবং অন্যান্যদের আরেকটু সার্ফিং দেখানো দরকার ছিল। সবচেয়ে ভালো হতো সিনেমার প্রচারণায় যদি নারীমুক্তি সংগ্রামের বিষয়টি সামনে আনা হতো। তাহলে সার্ফিংটা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় দর্শকদের মনেও অবজেক্ট হিসেবে থাকত।

সব ধরনের দর্শকের অ্যাঙ্গেল সামনে রেখে একটি চলচ্চিত্র সমালোচনা অসম্ভব। আর এই লেখা সে অর্থে সমালোচনা কিংবা নির্দেশনামূলক লেখা নয়। আমি মতামত দিতেই পারি। মিষ্টির স্বাদ যদি আপনাকে নিতেই হয়, নিজের মুখেই নিতে হবে। তবে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, হলে গিয়ে আপনার সময়টা একেবারে বিফলে যাবে না।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়