তারার মুখে তারার গল্প
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। মানুষকে আপন করে নেওয়া, আনন্দ দেওয়া আবার বিভ্রান্ত করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তার। এই শিল্পীর লেখা গল্প-উপন্যাস, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রের গল্পে তা বিদ্যমান। আর ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের সান্নিধ্য যারা পেয়েছেন তাদের অভিমতও এমন!
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কুতুবপুর গ্রামে বরেণ্য এই শিল্পীর জন্ম। কে জানতো নেত্রকোনার এই সন্তান একদিন হয়ে উঠবেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান জননন্দিত কথাশিল্পী, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করে অনেক শিল্পী খ্যাতি কুড়িয়েছেন। প্রয়াত অভিনেতা চ্যালেঞ্জার ও তার বোন মনিরা মিঠু হুমায়ূন আহমেদেরই আবিষ্কার। অভিনয়শিল্পী ফারুক আহমেদ, মনিরা মিঠু ও মাজনুন মিজান রাইজিংবিডিকে শুনিয়েছেন ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের গল্প।
ফারুক আহমেদ
সাহিত্যিক, গীতিকার, নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ কেমন তা মানুষ জানেন। কিন্তু ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ কেমন? প্রথমত ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কথা বলব। কারণ এটা বলা জরুরি। হুমায়ূন আহমেদ মানবিক হৃদয়ের একজন মানুষ ছিলেন। হিপোক্রেসি পছন্দ করতেন না। কাউকে কিছু বলতে চাইলে তা সরাসরি মুখের উপর বলে দিতেন। মানুষকে প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। ‘অন্যের জন্য ভাবেন’—এমন মানুষ সচরাচর খুব কম পাওয়া যায়। ধরুণ, একজন মানুষ অসুস্থ হয়েছে কিংবা নাট্যাঙ্গনের কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন তিনি।
আমি ‘আজ রবিবার’ নাটকের শুটিং করছিলাম। সেট ছিল বিআরটিএতে। এ নাটকে আমি ও আমার স্ত্রী নাসরিন অভিনয় করছিলাম। শুটিং শিডিউল ছিল ৩০ দিনের। কিন্তু আমরা কাজ করেছি মাত্র সাতদিন। আরো ২০ দিনের শুটিং বাকি ছিল। এ সময় আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে ছিল। এ বিষয় হুমায়ূন ভাইকে আমি বলিনি। কিন্তু কোথা থেকে যেন শুনেছেন আমার ভাইয়ের বিয়ে। হঠাৎ এসে আমার আর নাসরিনের পুরো মাসের টাকা খামে ভরে নাসরিনের হাতে দিয়ে দেন। আমি বললাম, এটা কী? দুষ্টামি করে হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘আমি শুনলাম তোমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে। কিন্তু তুমি তো কিছু বলবা না, যদি দাওয়াত দেওয়া লাগে।’ আমি বললাম, এখনো তো শুটিং শেষ হয় নাই। টাকা দিচ্ছেন কেন? জবাবে বললেন, ‘না, এখন এটা রাখো তোমার কাজে লাগবে। তাছাড়া টাকা তোমাকে দিতেই হবে। তার চেয়ে এখনি দিয়ে দিই।’ তারপর আমরা টাকা নিয়ে আসি। এই হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। এমন ঘটনা শুধু আমার সঙ্গে ঘটেনি, বহু মানুষের সঙ্গে এমনটা করতেন তিনি।
মনিরা মিঠু
আমার জন্মদিন আমি কখনো ঘটা করে পালন করিনি। একবার আমার জন্মদিনের দিন নুহাশ পল্লীতে শুটিং করছিলাম। এ বিষয়ে হুমায়ূন স্যারকেও কিছু বলিনি। কিন্তু স্যার যেন কীভাবে শুনেছিলেন তা জানি না। সন্ধ্যায় স্যার আমাকে বৃষ্টি বিলাস বাংলোতে ডেকে পাঠালেন। শীতের সময় ছিল। এরপর আমি গেলাম। গিয়ে দেখি পুরো মাটির দেয়ালে মোমবাতি জ্বালানো। স্যার এই মোমবাতি বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে জ্বালাতেন। যাওয়ার পর সবাই চিৎকার করে আমাকে শুভেচ্ছা জানান। তবলা, হারমোনিয়াম নিয়ে সবাই রেডি। এরপর স্যার ওইদিনের শুটিং প্যাকআপ করে দেন। এভাবে স্যার আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত ওই জন্মদিনটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জন্মদিন।
ব্যক্তিগত জীবনে স্যার আমাদের দুই ভাই-বোনকে (চ্যালেঞ্জার, মিঠু) খুব বিশ্বাস করতেন। এজন্য স্যার আমাকে নুহাশ চলচ্চিত্রের নির্বাহী অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। স্যার বলেছিলেন, ‘এর টাকা-পয়সা, চ্যানেলের সঙ্গে যোগাযোগ সব কিছু তুমি মেইনটেইন করবা। আর প্রধান সহকারী পরিচালকের সহকারী হিসেবে একটা মনিটরে বসবা।’ ওনি কীভাবে যেন বুঝে যেতেন কাকে দিয়ে কোনো কাজটি হবে আর হবে না। এ দায়িত্ব পালন করি কিন্তু পরে অনুধাবন করি আমার অভিনয় করতেই ভালো লাগে। পরে চাকরিটা ছেড়ে দিই। চাকরি ছেড়ে দেওয়াতে স্যার খুব মন খারাপ করেছিলেন। স্যার ভাইকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার বোনের মাথায় সমস্যা আছে।’ আর আমি টাকা গুনতে পারতাম না। এমনকি এখনো এ কাজ ভালোমতো করতে পারি না। এজন্য স্যার বলতেন, ‘গাধা মেয়ে টাকাটাও গুনতে পারে না।’ আমি আজও টাকা গুনি না, গুনতে চাইও না। প্রয়োজন হলে কাউকে না কাউকে দিয়ে টাকা গোনাই। এটা আমার কাছে এক প্রকার অ্যালার্জি, আতঙ্ক। তবে স্যারের এই কথাটা আজও আমার জীবনে সেরা স্মৃতি।
মাজনুন মিজান
হুমায়ূন স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি, পেয়েছি। লেখক, ঔপন্যাসিক, নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ ছিলেন। তার সঙ্গে সময় কাটানোটাই এক ধরণের সৌভাগ্যের ও আনন্দের। সবসময় তিনি মানুষকে আনন্দ দিতে পছন্দ করতেন। আড্ডার সময় স্যার, ইথিক্স, সততা, রাজনৈতিক সংকট নানা বিষয়ে কথা বলতেন। আর এসময় যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন। আলোচনার এ বিষয়গুলো ছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব বেশি বলতেন না। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কথা বলতেন তিনি। স্যারের পড়াশোনা ছিল প্রচণ্ড। ব্যক্তিগত জীবনে স্যার বৃক্ষ খুব পছন্দ করতেন। বৃষ্টি পছন্দ করতেন। কিন্তু মিথ্যা বলা অপছন্দ করতেন। শুটিংয়ের সময় কারো প্রতি স্যার যদি রেগে যেতেন তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে বলতেন, ‘ফাজিল। ফাজিল তুই কান ধরে উঠবস কর।’ কিংবা ‘কান ধরে ওই পাহাড়ের চারপাশ দৌড়া।’ দীর্ঘ সময় স্যারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগে এই হলো স্যারকে দেখা ও চেনা।
ঢাকা/শান্ত