ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১০ ১৪৩১

বিশেষ সাক্ষাৎকার

আবৃত্তির রাষ্ট্রীয় সমাদর এখনো হয়নি : ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

জেমস আনজুস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আবৃত্তির রাষ্ট্রীয় সমাদর এখনো হয়নি : ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

বিনোদন প্রতিবেদক
ঢাকা, ১২ ফেব্রুয়ারি : বাংলাদেশের একজন প্রাজ্ঞ আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৫২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খুলনা শহরে জন্ম গ্রহন করেন। বাবা প্রয়াত লোহিত কান্তি বন্দোপাধ্যায়। মা প্রয়াত দেবী বন্দোপাধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা, দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা নিয়ে লেখাপড়া করেন। এরপর নাটকের ওপর ডক্টরেট করেছেন রবীন্দ্রভারতী থেকে। আবৃত্তি শিল্পের একনিষ্ঠ মানুষটি হাতেগোনা চার থেকে পাঁচটি আবৃত্তির একক অ্যালবাম করেছেন। বর্তমানে স্ট্যামফোর্ট ইউনিভার্সিটিতে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন।  ৬২ বছর বয়সের কোঠা পার করলেন তিনি আজ। এই নিবেদিত প্রাণ আবৃত্তিশিল্পীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেন রাইজিংবিডির সংবাদকর্মি জেমস আনজুস। সেই আলাপচারিতার সুত্র ধরেই এই বিশেষ সাক্ষাতকার।

ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : বাবা ঘরে আবৃত্তি করতেন। তিনি নিজে অভিনয় করতেন। নাট্য নির্দেশক ছিলেন। কলকাতায় যে অ্যামেচার থিয়েটার গ্রুপ ছিল সেখানে অভিনয় করতেন। কলকাতা থেকে দেশে ফেরার পর আমাদের খুলনায় তিনি অভিনয় করতেন। নাটক নির্দেশনা দিতেন। সবাইকে সংগঠিত করে নাটক শেখাতেন। তার এই ধারার কিছুটা ছাপ বা প্রভাব আমার মধ্যে কাজ করে। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনতে শুনতে নিজেও কিছু আবৃত্তি করতাম। ছোটবেলায় স্কুলে সমাপনী অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতাম। ঘরোয়া অনুষ্ঠান, পাড়ার অনুষ্ঠানেও আবৃত্তি করতাম। কেমন করতাম জানি না, তবে লোকজন উৎসাহিত করতেন। তারপর আকাশবাণী কলকাতায় আবৃত্তি শুনতাম; সৌম মিত্র, দেব দুলাল, পার্থ ঘোষ, প্রদীপ ঘোষ, গৌরী মজুমদার, কাজী সব্যসাচী প্রমুখের আবৃত্তি শুনতাম। তাদের আবৃত্তি শুনে সাংঘাতিক আপ্লুত হতাম।  ঢাকায়ও তখন আবৃত্তি হত। তবে খুলনা থেকে ঢাকার বেতারের চেয়ে কলকাতার বেতার পরিষ্কার শোনা যেত। এটা ষাটের দশকের কথা। তখন ঢাকায় টেলিভিশন চালু হলেও খুলনায় আমরা দেখতে পেতাম না। সঙ্গতকারণেই ঢাকার আবৃত্তি সম্পর্কে জানা ছিল না। আসলে এই শিল্পের প্রতি আমার ভালবাসা তৈরি হয়েছে- প্রথমত আমার বাবার কাছ থেকে এবং আকাশবাণী কলকাতার আবৃত্তি শুনে।

ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় :  স্বাধীনতার পর সাংবাদিকতায় যুক্ত হই। তার আগে বেতারে সাংবাদিকতা করেছি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের একটা পত্রিকায় নিউজ এডিটর হিসেবে কাজ করি। সেটাও খুলনাতে। সেখানে কাজ করতে করতে ঢাকার দৈনিক বঙ্গবার্তা পত্রিকার খুলনা প্রতিনিধি হই। এই কাজটিও খুব আগ্রহ নিয়ে করতে থাকি। আমার অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টগুলো প্রথম পাতার ব্যানার হেড হিসেবে আসতো। তখন মনে হল, হ্যা আমি তো পারি! এতেই সাংবাদিকতায় আগ্রহী হয়ে উঠলাম। বাড়ি থেকে বলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা পড়ার জন্য। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে সাংবাদিকতা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। এদিকে আমার ভেতরে আবৃত্তি আছে, নাটক আছে। ঢাকা বেতার, পত্রপত্রিকায় লেখা, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাজ করতে শুরু করলাম। এর মাঝে থিয়েটারও করতাম। ভারত সরকারের বৃত্তি দিয়ে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে নাটক দিয়ে পড়তে চলে গেলাম দিল্লিতে। তিন বছরের কোর্স শেষ করে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স পড়াও শেষ করলাম। দিল্লি থেকে ফিরে কলকাতায় নাটক নিয়ে এক বছর গবেষণা করলাম। সেখান নাটক করতাম, শেখাতাম। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কর্মশালা করতাম। এর পর ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসি। দেশে ফেরার পরে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তখন আমাকে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিলো।

ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় :  আশির দশকের শুরুতে টিএসসি কেন্দ্রিক সাংগঠনগুলো আবৃত্তিচর্চার সূত্রপাত করে। প্রথমে আমরা আবৃত্তি ফেডারেশন করলাম। সেটা বেশি দিন কাজ করেনি। এরপর আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ করলাম। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম আমি। এ সময় সারা দেশে বিভিন্ন আবৃত্তি দল ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতা থেকে প্রদীপ ঘোষ ও কাজী সব্যসাচী আসেন। নানা স্থানে আবৃত্তি অনুষ্ঠান হতে থাকে। ফলে এর একটা জোয়ার সৃষ্টি হয়। ডাকসুতে আবৃত্তি বিভাগ চালু হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে প্রথম জাতীয় আবৃত্তি উৎসব করি। আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান, অভিনয় প্রভৃতির পাশাপাশি আবৃত্তি হত। আর এখন দর্শনীর বিনিময়ে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা আবৃত্তি শুনছে।

ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : দলগত আবৃত্তি, সম্মেলক আবৃত্তির নতুন নতুন দল তৈরি হতে থাকে তখন। এত লোক সামিল হচ্ছে সৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। তখন প্রচুর কবিতা লেখা হয়েছে। স্বৈরাচার বিরোধী কবিতা। আমরা ট্রাকে করে আবৃত্তি করেছি তখন। ফুটপাতে, শহীদ মিনারে , মিছিল নিয়ে আবৃত্তি করতে করতে রাজপথে থেকেছি। সে আন্দোলনে কবিতা ও আবৃত্তির যে ভূমিকা, তা বিশাল। সংগঠিত  দলগুলো পুলিশের গুলির মুখে দাড়িয়েই আবৃত্তি করেতো।

ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কবিতাকে যেভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, পরবর্তীতে আসলে সেভাবে হয়নি। তবে বর্তমান সময়ে ওই সময়ের কবিতাগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আবৃত্তি করা হচ্ছে। স্বৈরাচার হটানোর পর গণতন্ত্র আসার পরও আবৃত্তি শিল্পীরা জেগেই ছিলেন, এখনও আছে।  গণ বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কবিতা সব সময়েই হয়েছে এবং হচ্ছে।

ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত যে অসাধারণ কবিতা লেখা হয়েছে, এখন হয়তো ওভাবে হচ্ছে না। এখন অবশ্যই ভাল কবিতা লেখা হচ্ছে, কিন্তু সেই সময়ে যে বাঁধ ভাঙা জোয়ার যে এসেছিল তা দেখছি না। আবৃত্তি শিল্পীদের আলোড়িত করবে এমনটা হয়তো হচ্ছে না। আমার নিজেরও এখন খুব একটা পড়া হয় না। তবু উল্লেখযোগ্য কবিতা হলে তো অশব্যই চোখে পড়বে। অগ্রজ কবিদের কবিতার প্রতি যে নিবেদন ছিল, তারা যে সময় দিয়েছিলেন, এখনকার কবিরা হয়তো সে রকম সময় দিচ্ছে না। তবে নতুন কিছু কবির কবিতা আমি  মঞ্চে পড়েছি। নতুন অনেক কবির কবিতা পড়ে, তাদের চেনানোর চেষ্টা করেছি। এজন্য আবৃত্তি শিল্পীদেরও দায়িত্ব আছে। নতুনদের কবিদের ভাল কবিতা তুলে আনার দায়িত্ব আবৃত্তিশিল্পীদেরও।

ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : নাট্য, অভিনয় সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি; যেমন একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার-এসব ক্ষেত্রে আবৃত্তি বিষয়টা যুক্ত করা যায়। যারা আবৃত্তির পেছনে সারা জীবনকে উৎসর্গ করেছেন বা করছে তাদেরকে প্রাপ্য সমাদর দেওয়া উচিত। আবৃত্তির রাষ্ট্রিয় সমাদর এখনও হয়নি।

 


রাইজিংবিডি / জেমস আনজুস / রাশেদ শাওন

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়