চেনা ছকে অচেনা সজল
এসএসসি ব্যাচ ২০০৩। বহুদিন পর এই ব্যাচের ছয় বন্ধু রিইউনিয়নের পরিকল্পনা করেন। বিশেষ চমক হিসেবে একজনকে রিইউনিয়নে রাখার প্রস্তাব করেন তাদের এক বন্ধু। কিন্তু আরেকজন অসম্মতি জানান, যদিও সর্বশেষ রাজি হন। এরপর একটি পুতুলকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় ভৌতিক আবহ। তারপর স্মৃতিবিজড়ির পুরোনো সেই স্কুল মাঠে রাতে শুরু হয় বারবিকিউ পার্টি। প্রথম দেখায় সবাই আবেগী হয়ে পড়েন। কৈশোরের চঞ্চলতা, উচ্ছ্বলতা আর প্রেমের স্মৃতি উঁকি দেয় সবার মনে।
রাত গভীর হয়, তৈরি হতে থাকে জটিলতা। বাড়তে থাকে পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও লাশের মিছিল। গল্পের শুরুতে ভৌতিক আবহ, জঙ্গলের পাশে পুরোনো স্কুল। বারবিকিউ পার্টি শুরুর পরও ভৌতিক একটা আবহ তৈরি করেছেন গল্পকার। এটা খুবই চিরচেনা ছক। গল্প বলার এমন কৌশল অনেক ভৌতিক ঘরানার সিনেমায় দেখা যায়। তবে মানুষের প্রতি মানুষের হিংসাপরায়ণ সুক্ষ্ম মনোভাব ‘ব্যাচ ২০০৩’ সিনেমায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার। পাশাপাশি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন।
এ সিনেমার গল্পের শুরুতে কাহিনিকার যে ভৌতিক আবহ তৈরি করেছেন, তা মূলত টুইস্ট তৈরির জন্য। যার সঙ্গে গল্পের শেষ পরিণতির একটি যোগ রয়েছে। অর্থাৎ গল্পে ক্লাইমেক্স তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এটি। বলা যায়, এক্ষেত্রে গল্পকার, নির্মাতা দুজনেই সফল। কিন্তু এই সফলতা বয়ে এনেছেন সিনেমার গল্পের সুমন চরিত্রটি। অর্থাৎ আব্দুন নূর সজল। খুব চেনা একটি ছকে এই অভিনেতা অচেনা রূপে ধরা দিয়েছেন। যা দারুণভাবে প্রশংসনীয়।
টেলিভিশন নাটক-টেলিফিল্ম কিংবা সিনেমায় আমরা যে সজলকে দেখে অভ্যস্ত তা পুরোপুরি এখানে অনুপস্থিত। যদিও সিনেমার গল্পের এন্ট্রি লেভেলে সেই চেনা সজলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু রাত গড়ানোর সঙ্গে বাড়তে থাকে সজলের রূপ বদলের খেলা। গল্পের এন্ট্রিতে সজলের সহজ-সরল অভিনয়, আবার রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সজলের বদলে যাওয়া সত্যি বিস্ময়কর। তার আবেগ, সরলতা, বন্ধুসূলত আচরণে ছিল পূর্ণ সাবলীলতা। যা শুরুতে আঁচ করা দুষ্কর ছিল।
স্কুল জীবনে সজল ভালোবেসে প্রেমের চিরকুট দেন তাসনুভা তিশাকে। তা নিয়ে দারুণ অপমানিত হন সজল। রিইউনিয়নে সজলকে দেখার পর তার পাশে এসে বসেন তিশা। প্রশ্ন করেন পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলে যে? জবাবে সজল বলেন, ‘হাসপাতালে ছিলাম মানসিক সমস্যার জন্য। তারপর সুস্থ হয়ে ফিরে আসি। পরীক্ষা দিতে পারলাম না পড়াশোনাটাও শেষ হয়ে গেল।’ আরেক প্রশ্নের উত্তরে সজল বলেন, ‘তেমন কিছু করা হয় না। এ ছোট্ট শহরে আমার মতো করেই আছি। একটা ছোটোখাটো ব্যবসা করি, বই পড়ি, গান শুনি, গুনগুন করে গান গাইতেও চেষ্টা করি।’ এসব সংলাপে আবেগ-অভিব্যক্তির কমতি ছিল না সজলের।
প্রেমাবেগ, বন্ধুত্বের আড়ালে সজলের প্রতিহিংসাপরায়ণতা দর্শকদের আলাদাভাবে নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দৃশ্যে সজল তার সেরাটা দিয়েছেন। নিজেকে ভেঙেছেন, যথেষ্ট ঘাম জড়াতে হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রেমিকের হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, অসহায়ত্ব—সজলের সংলাপ, শরীরি ভাষার আষ্টেপিষ্টে লেগে রয়েছে। চেনা বলয় ভেঙে নতুন রূপে পর্দায় হাজির হয়েছেন সজল। যা তার বড় স্বার্থকতা। চেনা সজলকে বলয়ের বাইরে আনার এই কৃতিত্ব পরিচালকেরও কম নয়।
সজলের অন্য বন্ধুদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন—তাসনুভা তিশা, কাজী নওশাবা আহমেদ, শিপন মিত্র, তন্ময়, শারমিন আঁখি। তাসনুভা তিশাকে কেন্দ্র করে গল্প ত্রিভুজ প্রেমে রূপ নেয়। চরিত্রটির গুরুত্ব মোটেও কম নয়। কিন্তু গুণী এই অভিনেত্রী প্রত্যাশার চেয়ে দর্শককে কিছুটা কম দিয়েছেন। কারণ কিছু দৃশ্যে মনে হয়েছে চরিত্র থেকে বেরিয়ে গেছেন তিনি। শিপন মিত্র বেশ সাবলীলভাবে হেঁটেছেন পুরো গল্পময়। কাজী নওশাবা আহমেদ তার চরিত্রে দারুণ মানানসই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার ভূমিকা অনেক। তার সংলাপ ডেলিভারি প্রশংসনীয়। সব মিলিয়ে অভিনয়শিল্পীদের পারফরম্যান্স ভালো। শুটিং লোকেশন, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, কালার গ্রেডিং সবকিছু ঠিকই ছিল, কিন্তু কিছু কিছু দৃশ্যে আলো-আঁধারের খেলায় বেশ ছন্দপতন হয়েছে!
রাফায়েল আহসানের গল্প অবলম্বনে সাইকো-থ্রিলার ঘরানার সিনেমাটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন পরিচালক পার্থ সরকার। এ নির্মাতার নির্মাণ শৈলী ভালো লেগেছে। গতানুগতিক গল্পের বাইরে গিয়ে মানুষের অন্তরাত্মায় লুকিয়ে থাকা প্রতিহিংসার যে চিত্র সামনে এনেছেন, তাতে বাঙালি সিনেমাপ্রেমিরা পরবর্তীতে আরো ভালো কিছুর জন্য ভরসা করবেন। আর উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে দেশের সীমানার বাইরে।
আইরিশ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট। তার ‘ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকে ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগনের সময়-যাপনের নিরর্থক খেলা আর কথোপকথনের মধ্যে সুতীক্ষ্ম গালি হিসেবে উচ্চারিত হয় ‘সমালোচক’ শব্দটি। আসলে ‘সমালোচনা’ ও ‘সমালোচক’ দুটি শব্দই খুব অপ্রিয়। তারপরও সমালোচনা স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। ‘সমালোচনা’ শব্দটি অপ্রিয় জেনেও উপরের কথাগুলো দেখা ও উপলদ্ধি থেকে লেখা, মোটেও পাণ্ডিত্য জাহির নয়। বাংলা সিনেমা পরিবর্তনের পথ ধরে এগিয়ে যাক বহুদূর।
ঢাকা/শান্ত