টেন্ডার ডেকে সিনেমা নির্মাণে অবাক নির্মাতারা
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নৌ-সেক্টর পরিচালিত সফলতম গেরিলা অপারেশনের নাম অপারেশন জ্যাকপট। গৌরবময় এই অপারেশন নিয়ে নির্মিত হচ্ছে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ শিরোনামে সিনেমা। সিনেমাটি নির্মাণের ঘোষণার পর থেকেই তৈরি হয় আলোচনা-সমালোচনা। আজ থেকে সিনেমাটির দৃশ্যধারণের কাজ শুরু হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এই সিনেমার বাজেট ধরা হয়েছে ২১ কোটি টাকা। বিশাল ক্যানভাসের বিগ বাজেটের এই সিনেমার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সর্বাধিক সিনেমার পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু (বাংলাদেশ) ও রাজীব কুমারকে (ভারত)।
এর আগে দরপত্রে কিবরিয়া ফিল্মস সম্ভাব্য পরিচালক হিসেবে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু (বাংলাদেশ), স্বপন চৌধুরী (বাংলাদেশ), জেপি দত্ত (ভারত) এবং অনিরুদ্ধ রায় (ভারত) এর নাম উল্লেখ করেন। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকায় পরিচালক হিসেবে স্বপন চৌধুরী (বাংলাদেশ), জেপি দত্ত (ভারত) এবং অনিরুদ্ধ রায়ের (ভারত) নাম নেই। অপরদিকে বিবিসি বাংলাকে সিনিয়র পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু জানিয়েছিলেন, সিনেমা নির্মাণ প্রস্তাবের দরপত্রে নাম থাকলেও এটি নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে কিছুই জানতেন না।
ওই সময় ঝন্টু বিবিসি বাংলাকে তার অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে বলেছিলেন, ‘অপারেশন জ্যাকপট সিনেমার বিষয়ে এসব আলোচনার আগে আমি কিছুই জানতাম না। একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে আমি প্রথম শুনি, আমাকে না কি পরিচালক হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। তাকে বললাম, আমি তোমার কাছেই প্রথম শুনলাম, আমি তো জানিই না। তখন সে বলল, টেন্ডারে অ্যাপ্লাই করে কিবরিয়া ফিল্মস সিনেমাটি পেয়েছে।’
টেন্ডারে জমা দেওয়া শিল্পীদের তালিকায় শাকিব খান, ওমর সানি, মোশাররফ করিম, মৌসুমী, পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাস, রিয়াজ, নিপুণ, ববিতা, আহমেদ শরীফ, সুচরিতা, মিশা সওদাগর, সুচরিতা, চম্পা, ভারতের রাণী মুখার্জি, সানি দেওল, সুনীল শেঠি, ফারদিন খান, জয়া বচ্চনসহ আরো কয়েকজনের নাম থাকলেও ২৭ ডিসেম্বর নামের তালিকায় গুণী অভিনেতা আহমেদ শরীফ, ইলিয়াস কাঞ্চন এবং মিশা সওদার ছাড়া উল্লেখিত কারো নাম দেখা যায়নি।
প্রযোজক স্বপন চৌধুরীর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, এই সিনেমায় ৮০ জনের বেশি অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করবেন। এর মধ্যে মুখ্য চরিত্রগুলোতে চূড়ান্ত হয়েছেন অনন্ত জলিল, রোশান, ইমন, নিরব, শিপন মিত্র, সাঞ্জু জন, জয় চৌধুরী, আমান রেজা, ডন, ড্যানি সিডাক প্রমুখ। অপরদিকে চিত্রনাট্য পছন্দ না হওয়ায় সিনেমা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন চিত্রনায়ক বাপ্পি চৌধুরী, সিয়ামের মতো তারকা অভিনেতারা।
এর আগে বিটিভির অর্থায়নে অপারেশন জ্যাকপট বানিয়েছিলেন নব্বই ও বিংশ শতকের শূণ্য দশকের তারকা পরিচালক এফ আই মানিক। সেসময় টেলিফিল্মটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল ১৯ লাখ টাকা। তিনি বলেন, ‘শুরুতে শুনেছিলাম গিয়াস উদ্দিন সেলিম কাজটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন গুণী নির্মাতাও ছিলেন। যাদের পরিচ্ছন্ন নির্মাণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পরে জানলাম তারা পাচ্ছেন না। সত্যি বলতে টেন্ডার ডেকে সিনেমা নির্মাণ এ ধারণাটাই আমাকে অবাক করেছে। অপারেশন জ্যাকপট প্রেমের গল্প নয়, এটা একটা ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের অংশ। এখানে অনেক গবেষণার বিষয় রয়েছে। উপযুক্ত শিল্পী বাছাই করে প্রচুর গবেষণা আর পর্যাপ্ত ট্রেনিং ছাড়া এ সিনেমাটি নির্মাণ অসম্ভব। যারা কাজটি পেয়েছেন তারা যদি যথাযথভাবে এগুলো না করে থাকেন তবে সেটা হবে ইতিহাসের সঙ্গে তামাশা। কোনোভাবেই প্রকৃত ঘটনা এড়িয়ে কারো মাহাত্ম্য দেখানো হবে শিখিয়ে দেওয়া বুলির মতো ঘটনা। এ প্রজন্ম খুবই সচেতন, তারা এগুলো লক্ষ্য রাখবে।’
পর্যাপ্ত গবেষণা, নির্মাণ প্রক্রিয়ায়, শিল্পী বাছাই গরমিল প্রসঙ্গে কিবরিয়া ফিল্মেসের পুরো প্রক্রিয়া ‘অরাজকতার’ সঙ্গে তুলনা করেছেন অপারেশন জ্যাকপটের জন্য গবেষণাকর্ম ও চিত্রনাট্য তৈরি করা মনপুরা’খ্যাত নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম। প্রায় আড়াই বছর আগে অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে প্রথম একটি চলচ্চিত্র তৈরির উদ্যোগ নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সেই সময় তারা চিত্র পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিমকে চিত্রনাট্য তৈরির দায়িত্ব দেয়। পরবর্তীতে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ তদারকির দায়িত্ব পায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর গত বছরের (২০২৩) আগস্ট মাসে তারা এই চলচ্চিত্র নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করে। সেই দরপত্রে অংশ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটি পায় ‘কিবরিয়া ফিল্মস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাতে গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘আশীর্বাদ চলচ্চিত্র’ অংশ নিলেও, আবেদন ‘বিধিসম্মত না হওয়ায়’ তাদেরকে বাদ দেয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।
ওই চিত্রনাট্য কমিটির সদস্য মোরশেদুল ইসলাম অভিযোগ করে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘এখানে যা হয়েছে, তা হলো দুর্নীতি। অনেক টাকার কাজ, সেটা দুর্নীতির মাধ্যমে তাদের দেয়া হয়েছে। টাকা পয়সার লেনদেন হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না।’
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই চিত্রনাট্য কমিটিতে ছিলাম। চারবছর ধরে সেলিমের স্ক্রিপ্ট মূল্যায়ন করেছি। কিন্তু এদের স্ক্রিপ্ট কোন কমিটি মূল্যায়ন করেছে, আদৌ করেছে কি না, তা তো আমরা জানি না। এভাবে তো হতে পারে না। টেন্ডারে লোয়েস্ট বিড দিলেই তো হবে না, তাদের স্ক্রিপ্ট কেমন, তা আমি জানি না। কিন্তু ফিল্ম মেকিং তো টেন্ডারের বিষয় না। তাদের স্ক্রিপ্ট তো মূল্যায়ন হতে হবে।’
ঢাকা/রাহাত/শান্ত