‘মানুষ ক্ষোভ পুঞ্জীভূত করে রেখেছিল’
গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। উত্তাল এই সময়ের হাওয়া দেশজুড়ে বইছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন উপস্থাপিকা, মডেল-অভিনেত্রী নীল হুরেজাহান। রাজপথেও সোচ্চার ছিলেন তিনি।
রাইজিংবিডি: এই বিজয় কীভাবে উদযাপন করছেন?
নীল হুরেজাহান: আমরা যখন জানতে পারলাম, ছাত্ররা যেটা চেয়েছেন সেটাই পেয়েছেন— এ খবর শুনে আমরা সবাই খুব খুশি হয়েছি। খবরটি শোনার কিছু মুহূর্ত আগেও আমরা ভাবছিলাম যে, এটা যদি না হয় তবে আরো অনেক মানুষ মারা যাবে। অনেকেই বাসা থেকে বের হওয়ার আগে নিজের নাম-ঠিকানা লিখে মোবাইলের কাভারের পেছনে রেখেছিল। আমি নিজেও আমার পরিচয় লেখা কাগজ প্যান্টের পকেটে রেখেছিলাম। এরকম অবস্থায় বিজয়ের সংবাদটা অনেক আনন্দের ছিল। মিছিল নিয়ে কারওয়ানবাজার পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত অনুভূতি একরকম ছিল। তারপর থেকে আমাদের জন্য পরিস্থিতি ভিন্নরকম হয়। কারণ গণভবনে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটতে শুরু করে। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, হিন্দুদের বাড়ি-ঘড়, মন্দিরে আক্রমণ শুরু হয়। তা ছাড়া ব্যক্তিগত আক্রোশ, রাজনৈতিক আক্রোশ নিয়েও অনেকে আক্রমণ করে। চোর-ডাকাত যারা আছে তারাও সুযোগ নিতে শুরু করেছে। কারণ এ সময়টাতে দেশে তো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নাই।
রাইজিংবিডি: চলমান পরিস্থিতিতে করণীয় কী বলে মনে করেন?
নীল হুরেজাহান: এই আন্দোলনের পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণের ব্যাপার আছে। এখন যেটা ঘটছে এটা যে একেবারে অপ্রত্যাশিত সেটাও কিন্তু বলা যাবে না। একটা সরকারের পতন হওয়ার পর এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। দেশের সব মানুষ যে ভালো এমন ভাবার কারণ নাই। আমরা এমন একটি দেশে বসবাস করি, যেখানে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেও জুতা চুরি যাওয়ার ভয় থাকে। তবে এ জন্য তো পুলিশ রয়েছে। আসলে সমস্যা হয়েছে, শেষ কিছুদিন পুলিশ এমন কিছু ভূমিকা পালন করেছে, যার জন্য এখন তারা মানুষের রোষানলে পড়েছে। এটা সাময়িক বলেই আমি মনে করি। উগ্রবাদীরা নানারকম কর্মকাণ্ড করছে, সবাইকে তো আপনি বোঝাতে পারবেন না। অনেক পুলিশকে তারা মেরে ফেলছে, হয়তো ওই পুলিশের কোনো দোষও ছিল না। থানা আক্রমণ করেছে, গাড়ি ভাঙচুর করেছে। তারপরও আমাদের ভাবতে হবে, এখন যদি আপনার বাসায় ডাকাত পড়ে, তাহলে কাকে ফোন দেবেন?
রাইজিংবিডি: এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে?
নীল হুরেজাহান: এ সবের সম্পূর্ণ দায় প্রাক্তন সরকারের। কারণ তারা এমন একটি পরিস্থিতি দাঁড় করিয়েছে যে, পুলিশকে মানুষের শত্রু বানিয়ে ফেলেছে। পুলিশের ওপরে মানুষের আস্থা নাই। যে কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের ওপরে আক্রমণ করছে। এতে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। উনি (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) যদি দেশকে ভালোবাসতেন, দেশ নিয়ে যদি চিন্তা করতেন, তবে আরো সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেটা উনি করেন নাই।
উনি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছেন। আমার মনে হয়েছে, উনি বুঝতেই পারেননি কী হচ্ছে! একটি গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। উনি পুলিশের আইজিপিকে দেখিয়ে অন্যদের বলেছেন, ‘পুলিশ পারছে আপনারা কেন পারছেন না। সেনাবাহিনী বা অন্যরা কেন থামাতে পারছে না!’ পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলছে, এটাকে উনি ‘ভালো কাজ’ বলেছেন! এই প্রতিবেদন পড়ে উনাকে আমার সুস্থ মনে হয় নাই।
সেদিন সকাল থেকে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যখন দেখেন লাখ লাখ সাধারণ মানুষ আসছে, তারপর উনি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এমনভাবে গেছেন যে, পুরো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে রেখে গেছেন। উনি উনার নিজের দলের নেতা-কর্মীর কথাও ভাবেন নাই। তার আগের দিনও ছাত্রলীগের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে ১০৯ জন মানুষ মারালেন। পুরো বিশৃঙ্খলার মধ্যে দেশটা রেখে গেছেন।
এই মুহূর্তে আমরা খুবই ক্রান্তিকাল পার করছি। এই সময়টা অপ্রত্যাশিত না। এই সময় দরকার ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’। অন্তবর্তীকালীন সরকার আসছে। সেনাবাহিনী আছে, তারা যত দ্রুত কঠোর হবে, তত দ্রুত সব ঠিক হয়ে যাবে। আশার কথা হচ্ছে, আমরা যারা আন্দোলনে ছিলাম, আছি তারা অনেকগুলো দলে ভাগ হয়ে কাজ করছি। যেমন— সংসদ ভবন পরিষ্কারের কাজ করেছে, রাস্তায় ট্রাফিক নেই, ছাত্ররা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে।
রাইজিংবিডি: আপনি কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন?
নীল হুরেজাহান: সম্পূর্ণভাবে গণতন্ত্র যাতে প্রতিষ্ঠিত হয় এরকম একটি বাংলাদেশ চাই। জবাবদিহিতা চলে গেছে বলেই সবার মধ্যে এত সহিংসতা। এটা ওপেন সিক্রেট যে, গত ১৫ বছরে কেউ ঠিকমতো ভোট দেন নাই। আপনি দিয়েছেন কিনা জানি না, তবে আমি দেই নাই। এজন্য মানুষ কিন্তু অতিষ্ঠ। নানা কারণে মানুষ ভেতরে অনেক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত করে রেখেছিল। আন্দোলনে মানুষ খুব উন্মাদ হয়ে যায়, প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে যায়। আমি কিন্তু এসব দেখতে কমফোর্ট ফিল করি না।
মানুষ বলছে, দেশে আইন নাই আমরাই সব ঠিক করব, আমরাই শাস্তি দেব। এই মানসিকতা কিন্তু ভালো না। সবাই যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তাহলে আইন বলতে কিছু থাকবে না। এজন্য যথাযথ একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যথাযথ একটি সরকার খুব দরকার। আর এজন্য সঠিক ভোটিং সিস্টেম দরকার। ভোটটা যাতে সঠিকভাবে হয়, এর সঙ্গে কোনো আপোস চলবে না। সেটা যে পার্টিই হোক।
আমি চাই, শিক্ষিত তরুণরা রাজনীতি-সচেতন হোক। এই সময়ে নতুন একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হোক, সবার অংশগ্রহণমূলক একটি ফেয়ার নির্বাচন চাই। নির্বাচন শেষে সব দল মিলে একসঙ্গে দেশের জন্য কাজ করবে। বিরোধী দল সরকারের সমালোচনা করবে আর সরকার সেসবের জবাব দেবে। গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই।