ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৩ ১৪৩১

তাহসানের নববধূর সংগ্রামের গল্প, পুরোনো স্ট্যাটাস ভাইরাল

বিনোদন ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৮, ৫ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১৬:১০, ৫ জানুয়ারি ২০২৫
তাহসানের নববধূর সংগ্রামের গল্প, পুরোনো স্ট্যাটাস ভাইরাল

স্বামীর সঙ্গে রোজা আহমেদ

হঠাৎ বিয়ে করে হইচই ফেলে দিয়েছেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী-অভিনেতা তাহসান খান। তার স্ত্রীর নাম রোজা আহমেদ। তিনি পেশায় একজন মেকআপ আর্টিস্ট। রোজা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাকে নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ব্রাইডাল মেকআপ নিয়ে কাজ করছেন রোজা। গত বছরের ৪ জুন তার মেকআপ স্টুডিওর কাজ সম্পন্ন হয়। সেদিন নিজের একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দেন। যাতে নিজের পরিবার ও সংগ্রামের গল্প বলেছেন এই তরুণী। পুরোনো সেই স্ট্যাটাস এখন নেট দুনিয়ায় ভাইরাল।  

এ স্ট্যাটাসের শুরুতে রোজা আহমেদ বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ! এই মাত্র নিউ ইর্য়ক সিটিতে আমার রোজাস ব্রাইডাল মেকওভার অ্যান্ড বিউটি কেয়ার সেলুনের ডেকোরেশন এবং সেটআপের কাজ শেষ হলো। সেলফিটা একটু আগেই তুলেছি। সাধারণত আমার অনেক ছবি তোলা হয়। কিন্তু আজ এই সেলফিটা তোলার সময় চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। অনেক সময় কাঁদলাম। কিন্তু কি মনে করে কাঁদছি বা কেন কাঁদছি তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।”

আরো পড়ুন:

প্রয়াত বাবার কথা স্মরণ করে রোজা বলেন, “আমি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান তাই সব থেকে আদরের ছিলাম সবার। আর বাবা আমাকে সব সময় বলত, ‘আমার ছোট্ট পরিটা কইরে।’ সেই সময় বরিশাল শহরে আমাদের পরিবারের বেশ প্রভাব ছিল। ছোটবেলায় কখনো কমতি পাই নি। এর বাসায় দাওয়াত, তার বাসায় দাওয়াত আর যেতেই হবে কারণ আমাদের ছাড়া দাওয়াত অসম্পূর্ণ হবে। এমন দিন গিয়েছে দিনে ৪টা দাওয়াতেও অংশ নিয়েছি। শুধু দেখা করে আসার জন্য।”

বাবা মারা যাওয়ার পর রোজার অনেক আত্মীয়-স্বজনেরাও দূরে সরে গিয়েছেন। বাবার অনুপস্থিতিতে কাছের মানুষদের এমন আচরণে আবাক হন রোজা ও তার মা। তারই একটি ঘটনা উল্লেখ করে রোজা আহমেদ বলেন, “হঠাৎ বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ওপারে। যতদিনের হায়াত তিনি নিয়ে এসেছেন ততদিন ছিলেন আমাদের সাথে। অভিযোগ তো অনেক জমা আছে, বাবার সেই ছোট্ট পরিটার। কিন্তু অভিযোগ কার কাছে করব? আর বাবা শুধু আমাদের ছেড়ে চলে যায়নি, সাথে সাথে যে মানুষগুলো আমাদের এত সম্মান করতেন তাদের ভালোবাসাও চলে গেল আমাদের উপর থেকে। আর সেইদিনটাতেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম, যে ভালোবাসা আমরা পেয়েছি তা সবই বাবাকে ঘিরে আর সাথে অনেক অনেক স্বার্থ। বাবা চলে যাবার ঠিক ২ মাসের মাথায় আমার এক রিলেটিভের বিয়ে। আমরা অনেক ঘনিষ্ট ছিলাম একে ওপরের। কিন্তু বিয়েতে দাওয়াত পেলাম না। যে রিলেটিভরা সেই বিয়েতে অংশ নিয়েছে সবাই ফোন করতে শুরু করল মাকে। কেন আমরা গেলাম না, কোথায় আমরা? বরিশালে আছি কিনা এই সেই। সেদিন সারারাত বসে দেখেছি মায়ের সেই সরল মনের কান্না।”

“আপনারা লেখাটা পড়ে ভাবতে পারেন, দাওয়াত পাইনি বলে কাঁদছি? কিন্তু দাওয়াতের জন্য নয়, একি দালানে সবাই আনন্দ করছে, আমি, মা আর ছোট ভাই উৎস তখন বাসার এক কোণে। খুব চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, বাবা তুমি একটু দেখে যাও, যাদের জন্য এত করেছ তারা আমাদের সব ফিরিয়ে দিচ্ছে।” বলেন রোজা।

রোজার বাবা অনেক কিছুই রেখে গেছেন। তার দাদা ভাইয়ের অনেক আছে কিন্তু কিছুই গোছানো না। কে জানতেন যে এত অকালে রোজার বাবা চলে যাবেন। আর রোজার দাদার সব সম্পত্তিতেই চাচা-ফুফুদের ভাগ আছে। তার মায়ের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছে। পড়াশোনার সুযোগ পায় নি। এরই মাঝে রোজার জন্ম হয়। এসব তথ্য উল্লেখ করে রোজা আহমেদ বলেন, “আমার মা খুব সরল মনের, দিন-দুনিয়ার কিছুই বুঝে না। সে যে নিজের ভয়েস রেইস করবে বা তার সেটা রেইস করার অধিকার আছে, সেটা তার ধারণার বাইরে। কখনো তার সেই সাহসটাই ছিল না যে, তার শ্বশুরকে বলবে, বাবা আমাদের সম্পত্তিটুকু আমাদের বুঝিয়ে দেন। আর উৎস তো তখন অনেক ছোট। আমরা দুই ভাই-বোন তখন পিচ্চি পিচ্চি। আমাদের পড়াশোনার খরচ তখন একদম হিসাব করে টায় টায় দেয়া হতো মায়ের হাতে। তাই কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলতাম না, যাতে উৎস যেটা চায় সেটা যাতে পায়। আমার দিক থেকে একটু কম হলেও সমস্যা নেই।”

অধিকার নিয়ে মা কথা না বলতে পারলেও প্রতিবাদ করেন রোজা। সেই ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, “বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রস্তাব আসা শুরু করে। এই রিলেটিভ একে আনে ওই রিলেটিভ ওকে আনে। সেই সময় আমি প্রথম ভয়েস রেইস করেছি, যে আমার বয়স কম আর বাবা মারা গিয়েছে কি হয়েছে বাবার আর আমার স্বপ্ন তো মারা যায়নি! ওই দিন কথাটায় খুব মাইন্ড করেছিল আমার কাছে্র লোকজন। বড়দের মুখে মুখে কথা, আমি আর মানুষ হব না। আর সেই থেকেই রটানো হয় কত কথা। সারাদিন নাকি ছেলেদের সাথে ঘুরি, আমার বন্ধু-বান্ধব সার্কেল ভালো না, পর্দা করি না আরো কত কি। মেয়ে তো নিশ্চয়ই প্রেম করে আর না হলে এত ভাল প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়? আর প্রতিদিন এভাবেই বাসায় অভিযোগ আসা শুরু করে। কিন্তু আমার ভয়েস রেইসে সবাই এইভাবে রিয়াক্ট করবে বুঝতে পারিনি।”

দাদার অসুস্থতার কথা স্মরণ করে রোজা আহমেদ বলেন, “আমার মা এত অভিযোগ শুনতে শুনতে বলল, ‘তুই আমাকে ছুঁয়ে বল এই সব অভিযোগ কি সত্যি।’ আমি মাকে ছুঁয়ে বললাম, ‘না মা’ সব মিথ্যে। আমিতো স্কুল আর বাসা বাদে কোথাও যাই না। এই বলে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলাম মায়ের সাথে। ওইদিনের পর থেকে মা আমার সাথে নিয়মিত কোচিংয়ে যেত আবার এসে বাসার সবার জন্য রান্না করতে হতো, খুব কষ্ট হয়ে যেত তার। তখন নিজের কাছে মনে হত আমি সবার জন্য একটা বোঝা, সব ক্ষেত্রেই আমার দোষ। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। হঠাৎ দাদাভাই অসুস্থ হয়ে পড়েন, আর সেই থেকে আমার সাথে কোচিংয়ে যাওয়া বন্ধ করে মা কারণ তাদের সেবা যত্ন করতে হতো মাকেই।”

কোচিংয়ে পড়া বাদ দিয়ে টিউশন শুরু করেন রোজা। এ ঘটনা বর্ণনা করে রোজা বলেন,  “তখন থেকেই একা একা চলা শুরু করলাম। একটা ফ্রেন্ড বলল, ও স্টুডেন্ট পড়ায় আমি বললাম আমাকে একটা খুঁজে দিবি আমিও শুরু করতে চাই। বেশ একজন খুঁজতে গিয়ে দুজনকে পেয়ে গেলাম, কেজিতে পড়ে খুব অল্প টাকা বেতন। আর কোচিংয়ে পড়া আমার ভালো লাগত না, তাই আমি নিজে নিজে বুঝে পড়তাম। কিন্তু বাসার কথা ছিল কোচিংয়ে পড়তেই হবে। তাই কোচিংয়ের সময়টা আমি স্টুডেন্ট পড়াতাম লুকিয়ে লুকিয়ে আর সেই টাকা জমিয়ে উৎসকে ঘুরতে নিতাম, কিছু একটা পছন্দ করলে কিনে দিতাম। বাবার যে আদর আমি পেয়েছি ও সেই আদর পায়নি তাই বাবার আদর হয়তো দিতে পারতাম না, তবে কখনো যাতে আফসোস না করে সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। আবার নিজের খরচটাও একটু বাড়ল, ওয়াইফাই ছিল না তাই এমবি কিনে ফেইসবুকিং শুরু করি। এভাবেই তিন মাস চলল।”

কোচিং ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারটা বাসায় জানতে পারে। এরপর পরিস্থিতি মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। তা জানিয়ে রোজা বলেন, “হঠাৎ বাজারে দাদা ভাইয়ের সাথে স্যারের দেখা, স্যার তো বলল রোজা আসে না কেন? এরপর কি হতে পারে যারা ফেইস করেছেন তারা বুঝবেন। শুরু হয়ে গেল বাসায় বিচার সালিশ। যেহেতু সত্যি আমি কোচিংয়ে যাইনি তাই আমার জোর গোলায় কথা বলার মুখ ছিল না। আর কোচিংয়ের টাকা বন্ধ করে দিল আর বলল, তুই তো একা একাই সব পা্রো তো কোচিংয়ে পড়তে হবে না। আর টিউশন দুইটাও বাদ দিতে হলো। এখন স্কুল আর বাসা।”

মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে যাত্রা শুরুর গল্প স্মরণ করে রোজা আহমেদ বলেন, “স্কুলে আমি অনেক পপুলার ছিলাম নাচের জন্য। ওহ ক্লাস থ্রিতে থাকতে নাচের জন্য আমি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। আর তখন থেকেই একা একা সাজতাম আর যারা আমার সাথে নাচ করত ওদেরকেও সাজিয়ে দিতাম। আর সবাই আমার সাথে চলতে চাইত বিশেষভাবে মেয়েরা। কারণ আমি খুব ভালো সাজাতে পারি। আমার এক দূরের কাজিনের বিয়ের প্ল্যান ছিল ঢাকা থেকে আর্টিস্ট আনবে, তখন বরিশালে ফ্রিল্যান্সার আর্টিটিস্টের নামটার সাথে কেউ পরিচিত ছিল না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মেয়েটা ঢাকার আর্টিস্ট আনতে পারেনি। আমাকে কল দিয়ে খুব মন খারাপ করে বলল, ‘পরিবার বিয়েতে অনেক খরচ করছে, এত বড় আয়োজন। কিন্তু মেকআপের জন্য এত টাকা দিবে না আর বরিশালের কোনো পার্লারের সাজ আমার পছন্দ না, তোর সাজটা আমার খুব ভালো লাগে।’ আমি একটু চুপ থেকে বললাম, আপু তোমার এত বড় বিয়ের আয়োজনে আমার কাছে সাজবা শিওর তুমি? বলল, ‘হ্যাঁ তোর মতো করে আমাকে সাজিয়ে দিস তাহলেই হবে।’ সেই থেকে মেকআপের প্রফেশনাল জার্নিটা শুরু।”

বধূ সাজিয়ে পারিশ্রমিক নেওয়ার তথ্য উল্লেখ করে রোজা বলেন, “এরপর আপুকে সাজালেও খুব ভয় হচ্ছিল আমি কি বিয়েতে যাব? কারণ কেমন না কেমন হয়েছে সাজ? মা জোর করে নিয়ে গেল। সবার প্রসংশা আর ফিডব্যাক পেয়ে আমি নিজেই হতভম্ব। এরপর থেকেই আপুর অনেক ফ্রেন্ড আমার কাছে সাজা শুরু করল। মাত্র ২০০০ টাকা করে নিতাম।”

সব ঠিক থাকলেও ফের রোজার বাসায় সমস্যা তৈরি হয়। তবে সেসবে পাত্তা দেননি। তা জানিয়ে রোজা বলেন, “সেই বাসার সমস্যায় আবার পড়লাম। দাদা ভাইকে বলা হলো, আমি পার্লারে কাজ করি, পার্লারের মেয়ে আমি। আমি বললাম, হ্যাঁ তো? পার্লারে যারা কাজ করে ওরা কি মানুষ না? তাদের কি পরিবার নাই? দেখ, তোমাদের মতো এক একটা পরিবার চালায় তারা। আমি তাদের সম্মান করি। সেদিন সবাই অনেক উচ্চ কণ্ঠে আমাকে বলল, ‘এই মেয়ে আমাদের মানসম্মান ডুবাবে।’ সেদিন অনেক জেদ হলো! শুরু করলাম ফ্রিল্যান্সার মেকাআপ আর্টিস্টের কাজ। বরিশাল শহরে কেউ এই টার্মটার সাথে পরিচিত ছিল না। কিন্তু এখন শত মেয়ে ফ্রিল্যান্সার মেকাআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছে দেখে খুব গর্ব হয়। যেহেতু বিয়েগুলো দুপুরে হতো মেক্সিমাম তাই অনেক সময় ব্রাইডের কাজ করতে গিয়ে স্কুল বন্ধ দিতাম। স্কুল ব্যাগে মেকাআপ প্রোডাক্ট নিয়ে চলে যেতাম সোজা ক্লায়েন্টের বাসায়, ছুটির সময়ে চলে আসতাম বাসায়। আর সেই খবর বাসায় চলে আসে। ওইদিন রাতে বুঝে যায়, আমাকে যদি কিছু বলতে আসে আমি কাউকে ছাড় দিব না। তাই এবার আর আমাকে না বলে আমার মাকে অনেক মন্দ বলে। মায়ের সেই সরল কান্না যতবার দেখেছি নিজের জেদকে আরো শক্তিশালী করেছি। নিজেকে তৈরি করেছি মানুষ হিসেবে, একবারো নারী হিসেবে নয়।”

মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ শুরুর পর যেসব আত্মীয়-স্বজন বিরোধিতা করেছিলেন, সুনাম ছড়ানোর পর তারাই প্রশংসা করেন। এ তথ্য উল্লেখ করে রোজা আহমেদ বলেন,   “ব্রাইডের পরিমাণ বাড়তে থাকে বরিশাল থেকে পুরো দেশে নাম ছড়িয়ে পড়ল। বাসায় অর্থনেতিকভাবে অংশগ্রহণ শুরু করলাম। বাহ এবার আমার পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে গর্ব করছে, পরিচয় দিচ্ছে। আমি সবার মধ্যমণি। কিন্তু ওই দিনটাতে বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল যে, বাবা তোমার মৃত্যুর পর যতটা কষ্ট পেয়েছি তোমাকে হারিয়ে তার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে।”  

বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে কাজ করে ফের বরিশালে চলে যেতেন রোজা। সেই জার্নির কথা জানিয়ে রোজা আহমেদ বলেন, “ব্রাইডাল মেকআপ ট্রান্সফরমেশন ভিডিও আপলোড শুরু করলাম, নিজের ব্লগ, সবকিছু মিলিয়ে ভাইরাল হওয়া শুরু হলো। ঢাকা থেকে ক্লায়েন্টের নক আসা শুরু করল। কিন্তু ঢাকাতে তো কারো বাসায় উঠব না, অন্যদিকে পরের দিন বরিশালে ৪-৫টা ক্লায়েন্ট তাই সারাদিন কাজ করে রাত ৯টায় লঞ্চে করে ঢাকা এসে সারাদিন কাজ করে আবার বরিশালে ব্যাক করি। এই যাতায়াতে করতে গিয়ে রাস্তাঘাটে কত মানুষের কথা শুনেছি, তবে আমাকে কেউ নারী বলে হেনস্তা করার সাহস পায়নি। কারণ আমার চোখ তাদের বলে দিত যে, আমি জীবনে কাউকে ছাড় দেই না, দেব না। তা বাসায় হোক আর বাহিরে হোক। ঢাকার ক্লায়েন্টের পরিমাণ বাড়ল, বাজেট বাড়ল। বিবিএ’র স্টুডেন্ট ছিলাম, কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে বেশ একটা কঠিন সময় যাচ্ছিল।”

বরিশাল থেকে ঢাকায় স্টুডিও সেটআপ তৈরি করেন রোজা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “যাই হোক, খুব সাহস করে বসুন্ধরাতে একটা ছোট বাসা নিয়ে স্টুডিও সেটআপ দেই। বাড়িওয়ালা খুব ভালো ছিলেন। তার পরিবার নিয়মিত আমার ব্লগ দেখতেন। কিন্তু এত ক্লায়েন্ট আসত যে পাশের বাসা থেকে অভিযোগ আসা শুরু করল। পরে বাসাটা ছেড়ে একটু বড় পরিসরে বাসা নিয়ে আবার নতুন সেটআপ দেই। এবার দারোয়ান মামাকে বেশ ভালো বকশিস দেই, তাই আর ঝামেলা হয় না। এভাবেই আস্তে আস্তে রোজাস ব্রাইডালকে ক্লায়েন্টের দৌড় গোঁড়ায় নিয়ে যাই। ঢাকা-বরিশাল সব সময় ক্লায়েন্ট। পরে ফ্লাইটে যাতায়াত শুরু করি, এমন হয়েছে সকালে বরিশালে ক্লায়েন্ট করে দুপুরে ঢাকাতে ক্লায়েন্টের কাজ করেছি। আর তা সবসম্ভব হয়েছে মনের মধ্যে একটা জেদ ছিল।”

কারণ ব্যাখ্যা করে রোজা আহমেদ বলেন, “এই সেক্টরের মেয়েরা অনেক অবহেলিত। আমাকে যে কথা শুনতে হয়েছে আমি আর একটি মেয়েকেও সেই কথা শুনতে দিতে চাই না। তাই শুরু করলাম মেকআপ ক্লাস। এক বছরে ৫০০+ মেয়েকে মেকআপ শিখালাম। শত শত মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াল। হঠাৎ একদিন মায়ের কল, ইউএসএ অ্যাম্বাসিতে দাঁড়াতে হবে ভিসার জন্য। বড় মামা অনেক আগে থেকে আবেদন করেছিলেন। দেখতে দেখতে ভিসা হয়ে গেল। উৎস আর মায়ের জন্য দেশ ছাড়তে হবে। নিজের সাজানো সংসার বলা যায়, তা ছেড়ে যেতে যেমন লাগে দেশ ছেড়ে আমার যেতে ঠিক তেমন লেগেছে। একটু একটু করে এ দেশে নিজের অবস্থান তৈরি করেছি আর সেই সব ছেড়ে যাব?”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর দিনের ঘটনা উল্লেখ করে রোজা আহমেদ বলেন, “মজার কথা হলো, যেদিন আমার ফ্লাইট ওইদিনও আমি ব্রাইডের কাজ করি। দেশে আমার সার্কেলটা খুব ভালো, দেশ ছাড়ার সময়ে আমি নিজের লাগেজ পর্যন্ত গুছাইনি। যা কিছু করার সব ওরা করেছে। ওদের ছেড়ে থাকাটাও আমার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। নিজের ক্যারিয়ার, নিজের সার্কেল আর নিজের স্বপ্ন সব ফেলে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত নিয়ে চলে আসলাম ইউএসএ-তে।”

নিজেকে দাঁড় করাতে যে সংগ্রাম বাংলাদেশে করেন, একই সংগ্রাম যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েও শুরু করেন রোজা। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “এখানে আমি আসার আগেই বার্গারের দোকানে কাজ থেকে শুরু সব কাজ আমার জন্য দেখা হয়েছিল, আমাকে না জানিয়েই। আমি তো করবই না, ওই যে আমি খুব জেদ শুরু করলাম নিউ ইর্য়উকে প্রচারণার। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ক্লায়েন্ট পেলাম। আস্তে আস্তে ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানের প্রবাসীরাও আমার কাছে সাজা শুরু করল, ক্লাস করা শুরু করালাম। নিজেকে আবার এই দেশেও একজন প্রতিষ্ঠিত নারী উদ্যোক্তা হিসেবে দাঁড়া করালাম। কসমেটোলজির মাধ্যমে স্কিন, হেয়ার এবং মেকআপ রিলেটেড স্টাডি করলাম কলেজে। আর সেখান থেকেই আজকের স্টুডিও। কসমেটোলজির উপর নতুন করে আবার পড়াশোনা, লাইসেন্স নেয়া সব চ্যালেঞ্জ নতুন করে আবার ফেইস করেছি। সেলুনে সব থেকে এক্সপেন্সিভ এবং কোয়ালিটিফুল প্রোডাক্ট দিয়ে সাজিয়েছি সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট।”

গর্বিত রোজা আহমেদ মায়ের কথা স্মরণ করে বলেন, “বাবা মারা যাবার পর জীবনে উচ্চস্বরে কথা বলতে পারে নাই মা, কখনো হাসতে দেখিনি। আর আজ সেই মা উচ্চ গলায় সবাইকে ফোনে বলে, ‘হ্যাঁ আমার বড় মেয়ে রোজাই তো আমাকে দেখছে।’ আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ অনেক ভালো রাখছেন আমাদের। সে হয়ত স্বপ্ন দেখতে পারেনি। কিন্তু তার মেয়ে হিসেবে একটু হলেও নতুনভাবে বাঁচতে শিখাতে সাহায্য করেছি। আজ খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, বাবা তোমার সেই ছোট্ট পরিটা অনেক বড় হয়েছে! আমার সব স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু তুমি বাবা। আজ যখন সেলফিটা তুলি আমি একটার বেশি ছবি তুলতে পারিনি। কারণ এত কান্না আসছিল!”

সবার উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়ে রোজা আহমেদ বলেন, “আমি শুধু একটা কথা বলব, আপনাদেরকে ভেঙে দেবার জন্য হাজার মানুষ থাকবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপনাকে একাই চলতে হবে। নিজেকে এমনভাবে গড়তে শিখুন যে যতবার বাধা আসবে ততবার হাসিমুখে মোকাবেলা করুন। যাতে বাধা দেখলেও আপনাকে ভয় পায়।”

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়