ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৮ ১৪৩১

চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা, মাসে পণ্য বিক্রি ২০ লাখ টাকা

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২২, ২২ মে ২০২৪   আপডেট: ১২:২৮, ২২ মে ২০২৪
চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা, মাসে পণ্য বিক্রি ২০ লাখ টাকা

রংপুর ক্রাফট এর স্বত্ত্বাধিকারী স্বপ্না রানী সেন ও স্বামী নয়ন মনি। ছবি: রাইজিংবিডি

শতরঞ্জি বা ডুরি একসময়ের বিত্তবানদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে আসন, শয্যা, বিছানায় ব্যবহৃত হতো। বিশ্বের বুনন শিল্পের প্রাচীনতম ধারা এই শতরঞ্জি দিয়ে ইদানিং ব্যাগ, পার্স, টেবিল ম্যাটসহ নানা সৃজনশীল পণ্য তৈরি করা হচ্ছে।আবহমান কাল থেকে চলে আসা রংপুরের শতরঞ্জি গত ২০২১ সালের ১৭ জুন বাংলাদেশের একটি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

এটা নিয়ে কাজ করে যাওয়া রংপুর ক্রাফট এর স্বত্ত্বাধিকারী স্বপ্না রানী সেন গত রোববার (১৯ মে) ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই ফাউন্ডেশন) উদ্যোক্তা পুরস্কার-২০২৩ পেয়েছেন। জাতীয় এসএমই পণ্যমেলা-২০২৪ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে বর্ষসেরা নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার নেন তিনি। পরে রাইজিংবিডির সঙ্গে উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলার নানা গল্প তুলে ধরেন তিনি।

ঠাকুরগাঁওয়ের বনেদী পরিবারে বেড়ে ওঠা স্বপ্না ১৯৯৭ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৯৮ সালে বিয়ের পর স্বামীর চাকরির সুবাদে রংপুরে থাকা শুরু করেন এবং কারমাইকেল কলেজে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। সংসার সামলানোর পাশাপাশি লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে ভোলেননি। সদ্যজাত সন্তান নিয়ে ২০০১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন।

আরো পড়ুন:

তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, বাড়ির বড় ছেলের বড় মেয়ে আমি। দাদা-দাদিসহ ২২ জনের যৌথ পরিবার ছিল আমাদের। ওই সময় বাল্যবিয়ের খুবই প্রচলন ছিল। নবম-দশম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় আমার বেশ কয়েকবার বিয়ের জন্য লোক আসে। কিন্তু আমার মা একেবারেই সেটা চাননি। কারণ আমার মা বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিলেন। বিয়ের পর ১৯৭১ সালে তিনি মেট্রিক পাস করেন। তিনি যেখানে ধাক্কা খেয়েছিলেন, আমাকে এ বিষয়ে মুখোমুখি হতে দেননি। তিনি খুব কঠোরভাবে বিষয়টি দেখভাল করেছেন এবং স্নাতকের আগে আমাকে বিয়ে দেবেন না বলে ঘোষণা দেন। আমি মূলত আমার মায়ের কারণে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পেয়েছি।

স্নাতকোত্তরের ফল বের পর কিছুদিন পরই একটি বেসরকারি পদে চাকরি শুরু করেন। সেখানে তিনি নির্যাতিত ও অসহায় নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করতেন। তবে বাবা শিক্ষক হওয়ায় তারও শিক্ষক হওয়ার খুব শখ ছিল। প্রাইমারির শিক্ষক হওয়ার জন্য কয়েকবার পরীক্ষাও দিয়েছিলেন।

স্বপ্না বলেন, শিক্ষক হওয়ার খুব শখ ছিলো। কিন্তু ওভাবে প্রস্তুতি না থাকায় চাকরি হয়নি। পরে সন্তান-সংসার, বিভাগের পড়াশোনা নিয়ে সেভাবে আর প্রস্ততি নেওয়া হয়নি। তারপর বেসরকারি চাকরি ঢুকলাম। এখানে আমার পজিশন, বেতন সব মিলিয়ে ভালোই ছিল। সেখানে বাল্যবিবাহ রোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, আদালতে নারীদের সহায়তা দেওয়া, নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন ইত্যাদি কাজগুলো আমি করতাম। এজন্য পরে আর ওদিকে যাওয়া হয়নি।

বিয়ের পর তার স্বামী নয়নমনি সরকার লেখাপড়া, চাকরি থেকে শুরু করে সব বিষয়ে এখন পর্যন্ত ছায়ার মতো পাশে থেকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। একটা সময়ে এসে তারা চিন্তা করেন, বেসরকারি চাকরিতে নির্ভর করে জীবন পরিচালনা করা ঝুঁকি। এজন্য তারা এমন কিছু করার চিন্তা করেন, যার মাধ্যমে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কিছু মানুষকে কর্মসংস্থান করা যায়। বিশেষ করে নারীদের যাতে কর্মসংস্থান হয়। সে ভাবনা থেকে ২০১১ সালে শতরঞ্জি নিয়ে উদ্যোগ শুরু করেন।

ঢাকায় এসএমই মেলায় রংপুর ক্রাফট

তিনি বলেন, চাকরি করা অবস্থায় অসহায় ও নির্যাতিত নারীদের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছে আমার মনে জাগ্রত হয়। আর আমাদের সমাজে নারীরা সারাদিন পরিবারের পেছনে একটা বড় সময় ব্যয় করেও সে অনুযায়ী মর্যাদা পান না। কিন্তু তারা একটা কাজের মধ্যে থাকলে নির্যাতন থেকে দুরে থাকবেন এবং পরিবারের সময় দেওয়ার পাশাপাশি কিছু আয় করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবেন। এসব নানাকিছু ভেবে তাদের নিয়ে কাজ শুরু করি। আমার পোস্টিং ছিল দিনাজপুর। প্রথমে পীরগঞ্জ উপজেলার কিছু আদিবাসী নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করি। ওই এলাকায় আমার স্বামীও এক সময় চাকরি করতেন। এজন্য এলাকা সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা ছিল।

পীরগঞ্জ এলাকায় চাকরিরত অবস্থায় তিনি নারীদের শতরঞ্জি, কোমর তাঁতসহ নানা কাজ বেশ ভালোভাবে অবলোকন করেন। তাদের নকশা, হাতের কাজ তাকে বেশ অনুপ্রাণিত করে। তখন তার মনে হয়েছিল, এটা নিয়ে কাজ করলে হয়তো তিনি ভালো করবেন। বিশেষ করে নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি এ কাজ করতে পারবেন।

প্রথমে তিনি ১০ জন নারী নিয়ে কাজ শুরু করেন। ওই নারীরা আগে থেকেই হাতের কাজ পারতেন। স্বপ্না রানীও অবশ্য বরাবরই হাতের কাজ পারতেন। মায়ের কাছ থেকে তথা পারিবারিকভাবেই শতরঞ্জি, নকশি কাঁথাসহ নানা ধরনের হাতের কাজ শিখেছিলেন।

২০১১ সালে উদ্যোগ শুরুর পরই চাকরি ছাড়েননি। তিনি বলেন, চাকরির পাশাপাশি এটা শুরু করি। কারণ, তার পুঁজি দরকার ছিল। তবে শ্বশুরের অনেক থাকার পরও আমরা তার কাছে চাইনি। আমরা চেয়েছি, নিজেদের চেষ্টাই স্বাবলম্বী হতে।

বিয়ের পর স্বামীর পোস্টিং রংপুরে এবং তার পোস্টিং দিনাজপুরে হওয়ার কারণে তারা আলাদাই থাকতেন। ব্যবসা পরিচালনা ও স্বামীর কর্মস্থলের জন্য আগে থেকেই রংপুরে চলে যাওয়ার চিন্তা করছিলেন তিনি। পীরগঞ্জের ওই ১০ জন নারীদের নিয়ে তৈরি করা পণ্য বিক্রি ও প্রদর্শনীর জন্য রংপুরে একটা দোকান ভাড়া নেন। চাকরির পাশাপাশি উদ্যোগ পরিচালনার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু দিনাজপুর থেকে রংপুরে ট্রান্সফার নিতে না পারায় তিনি চাকরিটা ছেড়ে দেন। বর্তমানে রংপুরেই স্থায়ী হয়েছেন।

এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, রংপুরে দোকান দেওয়ার সময় পণ্যের খুব বেশি পরিচিতি ছিল না। এজন্য তেমন বিক্রিও হতো না। চাকরি করে দোকান ভাড়া এবং দোকান দেখাশোনার জন্য যে ছেলেকে রেখেছিলাম, তার বেতন দিতাম। মূলত পণ্যের পরিচিতির জন্যই এ ভর্তুকিটা দিয়েছি। এতে বেশ লাভ হয়েছে।

তিনি বলেন, রংপুরে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ, শতরঞ্জি রংপুরেই তৈরি হয়। অধিকাংশ মানুষ না করলেও শতরঞ্জি এ জেলার আদি কাজ। ব্যবসায়িকভাবে না করলেও নিজেদের ব্যবহারের জন্য তারা শতরঞ্জি তৈরি করতো। কোথায় কাজ করা যায় না যায়, কিভাবে কি শুরু করা যায়, এসব বিষয়ে আমি ও আমার স্বামী সমীক্ষা করে ২০১৩ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে ব্যবসার কাজ শুরু করি।

রংপুর সিটি এলাকায় শতরঞ্জি পল্লী নামে একটা গ্রাম আছে, যেখানে এ কাজগুলো বেশি হয়। সেখানে স্থানীয় কিছু পুরাতন ব্যবসায়ী আছেন, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না গিয়ে পার্শবর্তী রাধাকৃষ্ণপুর নামে একটা গ্রাম বেছে এ উদ্যোক্তা দম্পতি। সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তা করেন। এসময় ‘উই এসএমএস’ ও ‘প্রাকটিক্যাল অ্যাকশান’ নারীদের প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী পণ্য মার্কেটিং করে দিবে এমন শর্তে চুক্তিবদ্ধ হন।

স্বপ্না রানী বলেন, আমাদের প্রশিক্ষক দরকার ছিল ও প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ যোগান দেওয়ার মতো উপায় খুঁজছিলাম। ওই সময় ‘উই এসএমএস’ ও ‘প্রাকটিক্যাল অ্যাকশান’ সার্বিক বিষয়ে বেশ সহযোগিতা করেছিল। প্রথমে আমরা ২০ জনকে প্রশিক্ষণ দিই, তারপর ২৫ জন এবং ৩০ জনের গ্রুপ করে প্রশিক্ষণ দিলাম। এভাবে তিন মাস মেয়াদী এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বছরে তিন-চারটা গ্রুপ হয়ে যায়।

এ সফল উদ্যোক্তা বলেন বলেন, আমার স্বামী নিজেই তাঁতের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। কারণ তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই সময় সেরিকালচারের ওপর ডিপ্লোমা করেছিলেন। সেখানে লুমের কাজ শিখেছিলেন। এজন্য তাঁত বিষয়ে তার একটা ভালো ধারণা তৈরি হয়।

এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা অনেক দক্ষ কর্মী পান। এসব কর্মীরাই এখন তাদের কারখানায় কর্মরত আছেন। এসব কর্মীদের মাসিক চুক্তিতে বেতন দেওয়া হয় না। পোডাকশনের ওপর মজুরি দেওয়া হয়। যে পরিমাণ পণ্য প্রস্তুত করে দিবে তার ওপর টাকা নির্দিষ্ট মজুরি। এতে দেখা যায়, সবার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা কাজ করে। বর্তমানে স্বপ্নার তিন শতাধিক দক্ষ কর্মী রয়েছে।

তিনি বলেন, এক ব্যাচের ট্রেনিং শেষ হলে ২০১৩ সালে চাকরি ছেড়ে রংপুর চলে আসলাম এবং রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামে একটা জমি ভাড়া নিলাম। সেখানে টিনশেডের চালা দিয়ে আটটি তাঁত স্থাপন করলাম। শতরঞ্জির পাশাপাশি সেখানে কোমর তাঁতের কাজও করা হতো। এছাড়া ববিন করার জন্যও আলাদা মেশিন ছিল। এভাবে এক বছরের মধ্যেই ৪০টি তাঁত স্থাপন করলাম। করোনা মধ্যে বাবার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে ৫০টি তাঁত নিয়ে একটা কারখানা তৈরি করেছি। বর্তমানে তিনটি কারখানায় মোট ১৫০টি তাঁত রয়েছে।

এ উদ্যোক্ত দম্পতি কারখানা প্রতিষ্ঠার পর এসএমই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বিভিন্ন মেলাগুলোতে অংশগ্রহণ শুরু করেন। এতে তাদের পণ্যের মার্কেটিংটা খুব সহজভাবে হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যেই রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্যের পরিচিতি ও চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

মেহেদী হাসানের সঙ্গে কথা বলছেন স্বপ্না রানী সেন

তার পণ্যের মধ্যে শতরঞ্জির টেবিলের রানার, প্লেস মেট, বিভিন্ন লেডিস ব্যাগ, মোবাইল ব্যাগ, সাইড ব্যাগ ইত্যাদি রয়েছে। পরবর্তীতে জুট রাগ (পাটের আঁশকে নকশার উপর ভিত্তি করে গিঁট ও বুননের মাধ্যমে এই ‘জুট রাগ’ তৈরি করা হয়) নিয়েও কাজ করেন তিনি। কারণ মানুষের এটার প্রতি চাহিদা রয়েছে এবং তার কারিগররাও এ বিষয়ে বেশ দক্ষ।

কাঁচামালে উৎস সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, পাটের ফেব্রিক্স আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করি। পাট দিয়ে অফিসিয়াল ট্রেনিং রিলেটেড ব্যাগ, ফ্লোর রাগ, বাস্কেট ইত্যাদি তৈরি হয়। ফ্লোরের আইটেম তৈরির জন্য সরাসরি পাট কিনি। তবে ব্যাগ তৈরি করার সময় ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ থেকে জুটের থান কিনতে হয়।

রংপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক মোড় ও কারখানার পাশে তাদের শো-রুম আছে। এ দুটো শো-রুম থেকেই তাদের পণ্যগুলো বিক্রি হয়। সাধারণত তারা খুচরা বা অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন না। তিনি বলেন, স্থানীয়দের কাছে খুচরা বিক্রি করতে তো হয়ই। তবে প্রধান হলো হোলসেল। গোটা বাংলাদেশে আমার পণ্যগুলো চলে যায়। কিন্তু অনলাইনে পণ্য বিক্রি করি না। আমার রংপুর ক্রাফটের একটা ওয়েবসাইট আছে, সেটাও তেমন অ্যাক্টিভ না। কারণ আমি যে দামে দিতে পারবো, কেউ তা পারবে না। করোনার কারণে অনেক অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়ী হয়ে গেছে। এতে করে আমার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যারা অনলাইনে ব্যবসা করে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি স্বল্প লাভে অধিক পরিমাণে বিক্রি করি।

তার পণ্যগুলো রংপুর থেকে পাইকারদের মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের প্রত্যেকটি জেলায় চলে যায়। সব মিলিয়ে তিনি প্রতি মাসে ১৫-২০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন।

বায়ারদের মাধ্যমে তার পণ্যেগুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। করোনার মধ্যে কেনিয়ায় ৩ হাজার পিসের একটা অর্ডার গেছে। এছাড়া জাপান, আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে তার গিফট আইটেমগুলো বায়ারদের মাধ্যম প্রচুর রপ্তানি হয়ে থাকে। এখন তিনি সরাসরি পণ্য রপ্তানি না করতে পারলেও সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

এ সফলতার যাত্রায় প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথম দিকে পুঁজি ও দক্ষ কারিগরের খুব অভাব ছিল। তবে সদিচ্ছা থাকায় পুঁজির অভাবটা অতোটা মনে হয়নি। আর কাঁচামালের অভাব আগেও ছিল, এখনো আছে। যে কাঁচামাল দিয়ে শতরঞ্জি তৈরি করি, সেটা আমদানি করতে হয়। গার্মেন্টের সেক্টরের অনেক বড় বড় আমদানিকারকরা নিয়ে এসে সেগুলো কয়েক ধাপে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে ছাড়ে। আমরা তাদের থেকে নিই। বাজেটসহ নানা কারণে সবাই আমদানি করতে পারে না। এছাড়া সূতার ডাইং, কালারিংসহ নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। এসব বিষয়গুলো আমার স্বামী দেখাশোনা করেন।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ব্যবসা হয়ে গেছে খুবই প্রতিযোগিতামূলক। আবার অনেকে গুণগত মানও রক্ষা করে চলে না। যারা গুণগত মান রক্ষা করে না, তাদের কারণে আমাদের মার্কেটে টিকে থাকা কষ্ট হয়ে যায়। কারণ গুণগত মান রক্ষা যারা করে না, তারা তুলনামূলক কম দামে পণ্য বিক্রি করে দেয়। রং, ডিজাইন সব একই, শুধু সূতার মান খারাপ। কিন্তু গ্রাহকরা তো জানে না কোনটা ভালো, আর কোনটা খারাপ। তারা যেখানে কম পায়, সেখানে গিয়ে পণ্য ক্রয় করে। কিন্তু ঠকে যায়।

কখনো ঋণ নিয়েছেন কিনা জানাতে চাইলে তিনি বলেন, শুরুতে আমি কোনো ঋণ নিইনি। তবে করোনার সময়ে প্রণোদনা ঋণ ১৫ লাখ টাকা পেয়েছিলাম, ওটা শোধ হয়ে গেছে। এখন ব্র্যাক ব্যাংকের একটা ঋণ আছে ওটা চালাচ্ছি।

উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেছেন স্বপ্না। এসএমই ফাউন্ডেশনের আঞ্চলিক মেলাগুলোতে অংশ নিয়ে পরপর তিনবার প্রথম এবং কয়েকবার দ্বিতীয়ও হয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় একটা শিল্প মেলার আয়োজন করেছিল, সেখানেও তিনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে প্রথম হয়েছিলেন। 

প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ পুরস্কার আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। কখনো কল্পনাও করিনি এটা পাব। সবকিছু স্বপ্নের মতো।

‘এসএমই ফাউন্ডেশন উদ্যোক্তা পুরস্কার-২০২৩’ বিজয়ীরা

নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাদের দেশে চাকরির খুবই সংকট। তরুণরা কিছু করলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান হবে। সবকিছু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না। উদ্যোক্তা হতে গেলে তরুণদের কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। সেগুলো মোকাবিলার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। শুধু মুখে হবো বললে উদ্যোক্তা হওয়া যাবে না। সবার আগে জরুরি সদিচ্ছা। যে বিষয়ে কাজ করতে চায়, তাকে ওই বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা থাকতে হবে। উদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল দেশে আছে কিনা বা সহজলভ্য কিনা সেটা বিবেচনা করতে হবে। পুঁজিটা অনেক বড় গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। অনেক সময় সদিচ্ছা থাকলেও পুঁজির কারণে হয়ে ওঠে না। আর অবশ্যই সততা ও অঙ্গীকার থাকতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে হবে। সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সবার আগে পরিশ্রমী হতে হবে। এখনকার সন্তানরা পরিশ্রমী হয় না। এই প্রজন্ম স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে স্মার্ট মোবাইলকেই বোঝে। তারা মোবাইলের সুবিধা ভোগ করছে না। বর্তমানে গুগলে সার্চ দিলেই ভালো ভালো অনেক কিছু পাওয়া যায়। সেগুলো লক্ষ্য করলেই একজন ভালো উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হওয়া যায়।

/এসবি/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়