ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

‘স্বপ্নচ্যুত’ শাফাতের মাসে বিক্রি ৫০ লাখ টাকা

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৩০, ২ জুন ২০২৪   আপডেট: ২২:৪০, ৬ জুন ২০২৪
‘স্বপ্নচ্যুত’ শাফাতের মাসে বিক্রি ৫০ লাখ টাকা

এসএমই মেলা হাত বাক্সের স্টলে শাফাত কাদির ও তার সহকারী

দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরা চান, তাদের সন্তানরা কোনো একটি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরি করুক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাফাত কাদিরও তার ব্যতিক্রম নন। ২০১৫ সালে ঢাবি থেকে এমবিএ করার পর স্বপ্ন ছিল করপোরেট চাকরি করার। ‘স্বপ্নচ্যুত’ হয়ে তিনি এখন সফল উদ্যোক্তা।

সম্প্রতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই ফাউন্ডেশন) উদ্যোক্তা পুরস্কার-২০২৩ পেয়েছেন। জাতীয় এসএমই পণ্যমেলা-২০২৪ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে বর্ষসেরা পুরুষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার নেন তিনি।

শাফাতের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা অন্যদের মতো নয়, একেবারেই আলাদা। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের শেষ দিকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) দুই দিনব্যাপী একটা কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। শর্ত অনুযায়ি সেখানে আমাদের একটি করে ব্যবসা পরিকল্পনা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমার ব্যবসা করার ইচ্ছা ছিল না। আমার ইংলিশ মিডিয়াম ব্যাকগ্রাউন্ড, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্টও ভালো। ইচ্ছে ছিল কর্পোরেটে জব করবো। তারপরও ব্যবসা পরিকল্পনা দিতে হলো।

কিন্তু তিনি কি ব্যবসা পরিকল্পনা দিবেন বুঝতে পারছিলেন না। এমন সময় তার চাচা ২০০১ সালে আমেরিকা থেকে ফেরার সময় তাদের বাসায় একটা গিফট ব্যাগ পাঠান। ব্যাগে চকলেট, সাবানসহ নানা জিনিসের সঙ্গে একটা ছোট্ট বাক্সে স্ট্যাচু অব লিবার্টির একটা মিনিয়েচার ছিল। এ বিষয়টা শাফাতের মাথায় বেশ কাজ করে।

সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান ব্যাংকার বাবা আব্দুল কাদিরের কাছে। এ রকম মিনিয়েচার নিয়ে কেউ কিছু করে কিনা জানতে চাইলে তার বাবা না-সূচক জবাব দেন। তারপর তিনি সে অনুযায়ি একটা ব্যবসা পরিকল্পনা দাঁড় করে তার উপর প্রেজেন্টেশন দিয়ে খুবই প্রশংসিত হন।

শাফাত বলেন, তৎকালিন ডিসিসিআই এর সভাপতি সবুর খান স্যার সনদ দেওয়ার সময় আমাকে খুবই উৎসাহ দেন বিষয়টি নিয়ে। ওখান থেকেই মূলত মাথায় ব্যবসা করার চিন্তা মাথায় আসে। করপোরেট জব করার চিন্তা থেকে সরে আসি।

দেশে একেবারে নতুন হওয়ায় এর ডিজাইন কে করবে, কাঁচামাল কি হবে, প্রডাকশন কিভাবে হবে- এসব নিয়ে উদ্যোগের শুরুতে খুব সমস্যায় পড়ে যান তিনি। হাতেখড়িতই তার একটা বড় সময় চলে যায়।

তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না, কোনো প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা ছিল না। বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। তবে ঢাবি শিক্ষার্থী হওয়ায় আমার জন্য কিছুটা সহজ হয়েছে। আমার পরিচিত চারুকলা বিভাগের রবিউল ইসলাম স্যারের কাছে গিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে সহযোগিতা চেয়েছিলাম। তিনি রবিউল হোসেন নামে তারই এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। রবিউল ভাইই আমার স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দেন। এখন তিনি আমার উদ্যোগের ক্রিয়েটিভ হেড ও কো-ফাউন্ডার।

হাত বাক্সের নানা পণ্য

এই উদ্যোক্তা ‘হাত বাক্স’ নাম দিয়ে ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমবারের মতো তিনি বাজারে আনেন স্মৃতিসৌধ, কার্জন হল, অপরাজেয় বাংলা, আহসান মঞ্জিল ও লালবাগের মিনিয়েচার। প্রথমদিনে ছোট্ট পরিসরে অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করেন।

মূলত এই হাত বাক্সের মোট চারজন অংশীদার, যাদের সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে শাফাতের শেয়ার ৪০ শতাংশ, বাকি অংশ অন্য সবার। কারখানায় পোডাক্টগুলো বানানো জন্য ১৫ জন লোক আছে। আর রংয়ের কাজের জন্য আছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ১৮ শিক্ষার্থী।

শাফাত বলেন, প্রথম দিকে পরিবারের কেউ পক্ষে ছিল না। বাবা চাচ্ছিলেন বিসিএস দেই, মায়ের ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হই। কিন্তু আমার স্বপ্নের কাছে কম্প্রোমাইজ করিনি। মূলধন জোগাড় করার জন্য সাপ্লাইয়ার ব্যবসার সঙ্গে আমরা চারজনই যুক্ত হই, কারণ আমাদের কারও পরিবারই মেনে নেয়নি। ওই ব্যবসা থেকে যে লাভ আসতো, সেটা জমাতাম। সাপ্লাইয়ার হিসেবে কাজ করি ২০১৭ সাল পর্যন্ত।

তিনি বলেন, সব প্রতিকূলতা শেষে ২০১৮ সালে যখন মার্কেটে পোডাক্ট নিয়ে আসলাম, তখন দেখলাম কেউ এর সঙ্গে পরিচিতও না। মানুষকে এটার সঙ্গে পরিচিত করানোটা খুবই কষ্টের ছিল। পুরো ২০১৮ সাল এটা নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ওই সময়টা আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

একটা সময় এসে তারা খুবই হতাশ হয়ে যান এবং ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করেন। কারণ ইতোমধ্যে বাসাভাড়া বাকি হয়ে গেছে, কর্মচারির বেতন দিতে পারছিলেন না, পণ্য বিক্রি নেই। এমন সময় কিছু বিজ্ঞাপন সংস্থায় স্যাম্পল হিসেবে দেওয়া পণ্য দেখে একটা কোম্পানি বড় ওর্ডার দেয়। ওখান থেকেই তারা ব্যবসা এগিয়ে নেওয়ার একটা পুঁজি পান। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

হাত বাক্সের কর্পোরেট সেল সবচেয়ে বেশি। প্রধানমন্ত্রীরর কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক, অন্যান্য কোম্পানিগুলো এর প্রধান ক্রেতা।

বর্তমানে হাত বাক্সের মোট ১২ ধরনের পণ্য আছে। প্রত্যেকটি পণ্যের আবার অসংখ্য ডিজাইন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্রিজ ম্যাগনেট পোডাক্ট। সবমিলিয়ে প্রতিমাসে অন্তত ৫০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। দেশের সৌখিন পণ্য সংগ্রহকারীদের কাছে হাত বাক্স একটা খুবই জনপ্রিয় নাম।

এ উদ্যোক্তা বলেন, প্রতিকূলতা থাকার পরও আমি শুরু করতে পেরেছিলাম, কারণ আমি একটা ভালো টিম পেয়েছিলাম। আমাদের শাহজাহানপুর হওয়ার পরও ভাড়া কম হওয়ায় লোকেশন হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম পুরান ঢাকা এলাকা। ওখানে ফ্যাক্টরি সেটআপ দিয়ে ফেলেছি এবং এখন সুপ্রতিষ্ঠিত।

রাইজিংবিডির মেহেদী হাসানের সঙ্গে উদ্যোক্তা শাফাত কাদির

পণ্যের কাঁচামাল সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেন, কাঁচামাল আমাদের দেশে খুব সহজেই পাওয়া যায়। আমি সাধারণত পুরান ঢাকা থেকেই সবকিছু সংগ্রহ করি। তবে প্রথমে আমরা মাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেগুলো সহজেই ভেঙ্গে যেত। এটা নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে যায়। পরে আমরা ইন্টারনেটে খুব ঘাটাঘাটি করে ‘মার্বেল স্টোন ডাস্ট’ এর খোঁজ পেলাম। আমরা এখন এটা ব্যবহার করে পণ্য তৈরি করি। আমাদের কারখানা-অফিস মিলিয়ে মোট চারটি সেপআপ রয়েছে। মূল কারখানা রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে।

প্রথমদিকে শো রুম নেওয়ার মতো সামর্থ ছিল না। তখন তাদের কাছে সবচেয়ে সহজলভ্য ছিল ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম, যার মাধ্যমে পণ্যগুলোর প্রদর্শনী করেছিলেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানাতে গিয়ে এ তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, আমরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তিনটা। প্রথমত, আমি নিজস্ব আউটলেট করতে চাই। দ্বিতীয়ত, আমাদের পণ্যগুলো রিসেলারের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মেক্সিকো ও আমেরিকায় যাচ্ছে। এখন আমরা সরাসরি রপ্তানীতে যেতে চাই। ইতোমধ্যে এটা নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, হাত বাক্সের একটা নিজস্ব ই-কমার্স সাইট আছে। এর পাশাপাশি আমরা একটা ওপেন প্লাটফর্ম ই-কমার্স সাইট করতে চাচ্ছি। যার মাধ্যমে সবাই তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।

ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য মূলমন্ত্র কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের চারজনের এ টিমটা না থাকলে এতোদূর আসতে পারতাম না। আমরা চারজন আলাদা আলাদা বিষয়ে পারদর্শী। আমাদের সবার কর্মদক্ষতায় এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। এজন্য বলবো, সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য হয় পরিবার অথবা ভালো অংশীদার দরকার। তবে অবশ্যই সহপাঠি বা কাছের বন্ধুদের সঙ্গে নয়। কারণ অবশ্যই অংশীদার হতে হবে এমন কেউ, যে আপনার কথা গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন এবং আপনিও তার কথাকে গুরুত্ব দিবেন। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের এসব থেকে সবসময় দুরে রাখতে হবে।

বর্তমানে কি ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূলধনী সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঋণ নিতে হবে, কিন্তু সুদ অনেক বেড়ে গেছে। তারপরও নিতে হবে, ব্যবসা বড় হচ্ছে। সরকার নানা সুবিধা দিলেও সবক্ষেত্রেই সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের মতো যারা ২-১টি ধাপ পেরিয়ে একটু সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের জন্য যদি সহজ শর্তে ও কম সুদে লোন দিলে অনেক ভালো হতো। তবে করোনা পর এসএমই ফাউন্ডেশনের একটা ফান্ড আমরা কম সুদে পেয়েছিলাম। ইতোমধ্যে সেটার ৬০% শোধও করে ফেলেছি।

এর আগে, ২০২২ সালে শাফাত কাদির এসএমই ফাউন্ডেশনের মেলায় বেস্ট স্টল ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছিলেন। একই বছর মিরর ম্যাগাজিনের বিজনেস পার্সোনালিটি অব দ্য ইয়ার ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পান।

এবার সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হত থেকে পুরস্কার নেওয়ার অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, কিছু অনুভূতি থাকে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। স্টেজে ওঠার সময় মাথায় অনেক কিছু আসছিল। ভাবছিলাম, দু’একটা কথা বলবো; পারিনি। প্রধানমন্ত্রী খুবই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সামনে গেলেই তার মহিমা বোঝা যায়। তিনি আমাদের শুভ কামনা জানিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘তুমি খুবই তরুণ বয়সে অনেক বড় সম্মাননা অর্জন করেছো। এটাতে আমি খুবই খুশি। তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে, সেখান তুমি একটা রোল মডেল হতে পারো।’ তার এ কথাগুলোই আমার জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা।

তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয়েছে, যেহেতু আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছি, সেজন্য দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা বেড়ে গেছে। আমাকে দেশের জন্য আরও ভালো পোডাক্ট দিতে হবে এবং অনেক বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

নতুন করে যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে শাফাত বলেন, দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার একটা ট্রেন্ড চলছে। কিন্তু আমি বলবো, হুজুকে কোনো কাজ করা ভালো না। অনেককে দেখেছি, অনেককিছু নিয়ে কাজ শুরু করতে। কিন্তু ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে হারিয়ে গেছে। যদি আপনার প্রেষণ হয় ব্যবসা, যদি চান আপনার একটা প্রতিষ্ঠান হবে, লোকজনকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন, তাহলে কষ্টের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি শাফাত কাদির একদিনে এখানে আসিনি, এর পিছনে ছয় বছরের ইতিহাস আছে। আমিও একসময় ভাড়া দিতে পারতাম না, কর্মচারির বেতন দিতে পারতাম না। এখানে আসার পিছনে অনেক অধ্যাবসায় ছিল এবং প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। ত্যাগে মানসিকতা থাকলে যেকোনো আইডিয়া নিয়ে সামনে আগানো যাবে এবং সফল হওয়া সম্ভব।


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়