ঢাকা     রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৯ ১৪৩১

শীতল পাটির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে চান গোলাপী

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৪, ৭ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৭:৪৫, ৭ জুলাই ২০২৪
শীতল পাটির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে চান গোলাপী

আবহমান বাংলার ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শীতল পাটি। সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এ কুটির শিল্পটির খ্যাতি একটুও কমেনি আজও। বাংলাদেশের শীতল পাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যেরও অংশ। সম্প্রতি ইউনেস্কো এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও দিয়েছে।

গরমের সময় এ শীতল পাটির ঠান্ডা পরশ প্রশান্তি দিয়ে সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়। বিশেষ এই বৈশিষ্ট্যের জন্য এক সময় বিশ্বব্যাপী শীতল পাটির খ্যাতি ছিল। এ পাটিকে ঘিরে যুগে যুগে কত গান, কাব্য রচিত হয়েছে— তার ইয়ত্তা নেই। শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় ফুটে উঠে বর্ণিল ফুল, ফল, পশু-পাখি প্রিয়জনের অবয়ব, জ্যামিতিক নকশা, মসজিদসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

এমনই এক শিল্পী হলেন টাঙ্গাইলের মেয়ে গোলাপী রানী দে। তিনি টাঙ্গাইল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্ন করার পর ঢাকা জেলার সাভারে অবস্থিত গণবিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। একই বছর তিনি পারিবারিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বর্তমানে স্বামী-সন্তান ও সংসার সামলানোর পাশাপাশি শীতল পাটি তৈরি করেন এ উদ্যোক্তা।

পথ চলার গল্প জানাতে গিয়ে গোলাপী রানী বলেন, আমার স্বামী একটি কোম্পানিতে কর্মরত আছেন। আমিও একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম। ছেলে জন্মের পর চাকরিটা ছেড়ে দিই। কারণ ছেলেকে সময় দেওয়াটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সংসার-সন্তান সামলিয়ে কাটছিল ভালোই। এর মাঝে ছোট ছোট বিভিন্ন স্কুলে চাকরির অফার আসে, কিন্তু আমি আর চাকরি করতে চাইনি। এরপর ফেসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে দেখি অনেক নারী ঘরে বসে সংসার-সন্তান সামলিয়ে নানা কাজ করছেন। সেটা দেখে আমিও পারিবারিকভাবে শেখা শীতল পাটি নিয়ে কাজ শুরু করি।

তবে, এ নারী উদ্যোক্তা শুরুতেই শীতল পাটি নিয়ে কাজ শুরু করেননি। তার শুরুটা ছিল রেডি ব্লাউজ নিয়ে। সেখানে তিনি প্রায় ৩৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। অনলাইনে নানাভাবে প্রচারের পরও আশানুরূপ ফল পাননি। হতাশ না হয়ে সনাতন পদ্ধতিতে হাতে তৈরি ক্রিম করে বানানো খাঁটি গাওয়া ঘি ও শীতলপাটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। এ কাজে তার স্বামী সব সময়ই সাহস যুগিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি কাজ শুরু করি ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে। শীতল পাটি তৈরির কাজ পারিবারিকভাবে শিখেছি বলে কোথাও প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়নি। নিজস্ব তত্বাবধানে কয়েকজন লোক রেখে শীতল পাটি তৈরি করি। আর ঘি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রামে আমার আত্মীয়-স্বজন তৈরি করে। আমি তাদের কাছ থেকে নিয়ে আসি।

তিনি আরও বলেন, আমরা সাভারে থাকি। গ্রামে (টাঙ্গাইলে) দুই বিঘার বেশি জমি আছে। পুরো জমিতেই মূর্তা বা বেত চাষ করা হয়। ওই মূর্তা নিয়ে এসে শীতল পাটি তৈরি করি। মূর্তা থেকে পাটি ছাড়াও জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি করি। নিয়মিত টাঙ্গাইলে যাতায়াত করি। এজন্য মূর্তা বা ঘি নিয়ে আসতে সমস্যা হয় না। 
 
তবে এ নারী উদ্যোক্তা কখনো প্রশিক্ষণ না নিলেও তিনি মনে করেন, প্রশিক্ষণ ছাড়া উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলা অসম্ভব। সংসার ও উদ্যোগ সামলিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো সময় পাননি তিনি। তবে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চান, যার মাধ্যমে আরও অনেক মেয়ের কর্মসংস্থান হবে। এজন্য তিনি নিজের উন্নতির জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন।

এ কুটির শিল্পী বলেন, শীতলপাটি আমার হাতের কাজ। কোনো সোর্স থেকেও সংগ্রহ করতে হয় না। আমি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো ধরনের নকশার পাটি তৈরি করে দিতে পারবো।

প্রতিবন্ধকতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, সংসার আমার জন্য প্রতিবন্ধকতা হয়নি কখনো। এটা সত্য যে, সংসারের কাজ, ছেলের স্কুল-পড়াশোনা— সবটা মিলিয়ে যথেষ্ট সময় আমার উদ্যোগের পেছনে দিতে পারি না। একটু বেশি সময় দিলে হয়তো আরও এগিয়ে যেতে পারতাম। তবে একটা সমস্যা হলো, অনেকেই পাটির দাম বেশি মনে করেন, তারা কোয়ালিটি চিন্তা করেন না। একটা শীতলপাটি শেষ করতে দুজন লোকের দুদিন সময় লাগে, শ্রমিকের মজুরির কারণে দাম বেড়ে যায়।

তার উদ্যোগের পেছনে পরিবারের সদস্যরা অনেক সহযোগিতা করেন। এজন্যই তিনি উদ্যোগটা চালিয়ে যেতে পারছেন। পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে সব সময় সফলতার স্বপ্ন দেখেন এ কুটির শিল্পী। একই সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে চান আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী পণ্য শীতল পাটি।

/এনএইচ/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়