জেনেটের পণ্য যাচ্ছে তিন দেশে
রাশিদা খাতুন || রাইজিংবিডি.কম
জেনেট গোমেজ
জেনেট গোমেজ নামটা একটু অপ্রচলিত। তাই অন্যদের পক্ষে মনে রাখা খানিকটা কঠিন। তাকে নাম ধরে ডাকার দরকার হলেই অনেকে বলতেন, ‘ওই যে খ্রিষ্টান মেয়েটা, কি যেন নাম? ও হ্যাঁ জেনেট’। এই মেয়েটিই এখন জেনেট ক্রিয়েশনের স্বত্বাধিকারী। তার ফ্যাশন হাউসের সুতি, সিল্ক, টাই-ডাই, হ্যান্ডপেইন্ট, ব্লক প্রিন্ট ও এম্ব্রয়ডারেড পোশাক দেশ ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও পৌঁছে যাচ্ছে। জেনেট তৈরি করেন শাড়ি, ব্লাউজ, টুপিস,শাড়ির সাথে ম্যাচিং শার্ট- পাঞ্জাবিসহ আরও অনেক কিছু। তার সিগনেচার পণ্য হচ্ছে টাই-ডাই। দেশের বাইরেও পৌঁছে যাচ্ছে জেনেটের পণ্য।
অনেক সৌখিন নারী আছেন যিনি শাড়ি কিনে তার সঙ্গে মিলিয়ে চুড়ির খোঁজ করেন— সেইসব নারীদের শখ পূরণে শুধু শাড়ি আর চুড়িই নয় টিপও তৈরি করেন জেনেট গোমেজ। জেনেটস ক্রিয়েশন এর যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে। জেনেট ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালবাসতেন।সেই ভালোবাসার রেশ ধরেই তিনি এখন উদ্যোক্তা।
জেনেটের শৈশব কেটেছে গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে। মিশনারীজ স্কুল সেন্ট মেরীস থেকে এসএসসি তারপর ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্মে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। অনার্সে পড়াশোনার পাশাপাশি বাফা থেকে চারুকলার ওপর ৫ বছরের কোর্স সম্পন্ন করেন জেনেট। কাজিনের উৎসাহে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ব্লক-বাটিক এর ওপর সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজের দক্ষতাকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। এই প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরে জেনেট নিজের জন্য কামিজ এবং শাড়ি ডিজাইন করা শুরু করেন। অন্যরা জেনেটের শাড়ি-পোশাক দেখে তাকে উৎসাহ দেন এবং নিজেরা তার ডিজাইন করা পোশাক নেওয়ার প্রতি আগ্রহ দেখান। এরপর বরের কাছ থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে শাড়ি-পোশাক তৈরি শুরু করেন জেনেট। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে জেনেট ক্রিয়েশনের কাজের সঙ্গে বিভিন্ন সেক্টরে ৬ জন কাজ করছেন।
প্রথমে হ্যান্ডপেইন্টেড শাড়ির অর্ডার পান। এরপর একের পর এক অর্ডার আসতে থাকে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জেনেটের কাজের উৎসাহ আরও বাড়ে। পুরোদমে কাজ শুরু করেন। পণ্যের প্রচারে ই-মার্কেটিং কাজে লাগিয়েছেন তিনি। এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পেইজ এবং গ্রুপ পেইজ খোলেন জেনেট।
জেনেট গোমেজ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রথমে ছেলের নামে পেইজের নাম ছিল। তারপর কয়েকমাস পর পেইজের নাম পরিবর্তন করে জেনেটস ক্রিয়েশন রাখি। কারণ আমি মনে করি আমার একেকটা কাজ একেকটা সৃষ্টি, যেই সৃষ্টিতে থাকে আমার পরম যত্ন আর কঠোর পরিশ্রম মিলেমিশে আছে। এছাড়াও আর একটা কারণ হচ্ছে আমার নাম জেনেট গোমেজ কিন্তু অনেকেই এই মনে রাখতে পারতো না।(শুধু বলতো খ্রিষ্টান নাম কি যেন একটা নাম ওর)।তাই ভাবলাম উদ্যোগের নাম বলতে বলতে আমার নামও সহজে মনে রাখবে মানুষ।’
‘বিজনেসটা যেহেতু অনলাইন বেইজ তাই প্রচার ও প্রসারে নিজের প্রোফাইল, পেইজ, গ্রুপ ব্যবহার করি। এছাড়া ও নিদিষ্ট কিছু বিসনেস প্ল্যাটফর্ম বা গ্রুপগুলোতে নিজের উদ্যোগ সম্পর্কে জানাতে পোস্ট করি। বছরে ১ বা ২ বার মেলা কিংবা এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করি যেন কাস্টমারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারি, ক্রেতারাও যেন সরাসরি আমার পণ্যগুলো হাতে ধরে দেখে নিতে পারেন।’— যোগ করেন জেনেট গোমেজ।
উদ্যোগ এর লভাংশ থেকেই আস্তে আস্তে পুঁজি বাড়িয়ে সেগুলোই ইনভেস্ট করে জেনেট ক্রিয়েশনের কার্যক্রম বাড়িয়েছেন এই উদ্যোক্তা। পরিবারকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজের উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে চান জেনেট। তিনি জানান, সংসারের কাজের পাশাপাশিই উদ্যোগের কাজ করেন। জেনেট মনে করেন, সমাজ কিংবা পরিবারের প্রত্যেকের আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক সফলতা প্রয়োজন একই সঙ্গে একজন আরেকজনের প্রতি দায়িত্বশীল এবং ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ প্রদর্শনও প্রয়োজন। তাই সময়টা প্রয়োজন অনুসারে ভাগ করে নিতে আগ্রহী জেনেট।
জেনেট গোমেজ বলেন, ‘ছুটির দিনে আমি ফটোশুটের কাজটুকু করি। মডেল আমি নিজেই এবং ফটোগ্রাফার আমার বর। আমার ছেলেও আমার কাজে খুব সাহায্য করে প্রোডাক্ট পিকআপ নিতে আসলে ছেলে নিচে গিয়ে দিয়ে আসে। আমরা আসলে পুরো পরিবার মিলেমিশেই কাজ করি। এতে একসঙ্গে সময় কাটানোও হয়, আনন্দের সঙ্গে কাজটাও হয়ে যায়।’
জেনেট স্বপ্ন দেখেন, নিজের একটা স্টুডিও হবে। যেখানে প্রদর্শনীর মতো তার কাজগুলো সাজিয়ে রাখবেন। যাতে ক্রেতারা এসে হাতে ধরে দেখে ক্রয় করতে পারেন জেনেট ক্রিয়েশনের পণ্য।
মানুষ যখন ভালোলাগার কাজটি করতে পারে সেই কাজের সফলতা মানুষ অনুভবও বেশি করতে পারে। জেনেট বলেন, ‘ এ পর্যায়ে এসে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে আর্থিক সফলতা। সংসারে আর্থিক কন্ট্রিবিউশন, বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে ছেলের পড়াশোনার খরচ, গান শেখা সবকিছুতে অবদান রাখতে পারছি। দেশ ছাড়িয়ে ও দেশের বাহিরে আমার টাই-ডাই পণ্য ছড়িয়ে দিতে পারছি এটাও একটা বড় অর্জন যেখানে মানুষ বাটিক, টাই-ডাই পণ্যকে ঘরে পরার কাপড় হিসেবেই জানতো সেখানে মানুষ এখন শখ করেও একটা টাই-ডাই শাড়ি কিনছেন অনেকে। মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। কিছু মানুষ এখন আমাকে শুধুমাত্র আমার কাজের জন্য আমাকে চেনেন বা চেনার প্রয়োজন মনে করেন। বেশিরভাগ ক্রেতাই আমার বোনের মতো, উনারা আমাকে ভালোবাসেন। এই পেশায় কাজ করতে এসে বেশ কয়েকজনকে পেয়েছি যাদের কখনো চিনতামই না তারা এখন কেনাকাটা ছাড়া ও যোগাযোগ রাখেন, বিপদ আপদে খোঁজ খবর নেন। দেশের বাহিরে থাকেন তারপর দেশে এসে দেখা করেন, আসার আগে জানতে চান কিছু লাগবে কিনা। এই পেশায় কাজ না করলে এই ভালোবাসার মানুষগুলোর সঙ্গে হয়তো কখনো কথাই হতো না।’
বড় প্রাপ্তিগুলো বার বার আসে না তবে সেগুলো আত্মবিশ্বাসের যোগান দেয়, হারতে দেয় না। জেনেট বলেন, ‘৭৫০০ টাকা বরের কাছ থেকে নিয়ে, কয়েক মাস পরই তাকে বিজনেস লভাংশ থেকে ফেরত ও দিয়েছি। কাজ শুরু থেকেই ভালোভাবে চলছিল। তবে ২০২৩ এর ডিসেম্বর মাসে ১১২ টা শাড়ীর অর্ডার পেয়েছিলাম, সেটা ছিল আমেরিকায় বসন্ত উদযাপন এর জন্য। ২০২৩ এর ডিসেম্বরে আয় ছিল প্রায় তিন লাখ টাকা, এটাই এখনো পর্যন্ত সবোর্চ্চ আয়।– এই ঘটনাটি ছিল আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তির।’
সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে জেনেটের পোশাকের রয়েছে আলাদা কদর। তিনি বলেন, আমি নিজে একজন খ্রিষ্টান। ক্রিসমাস উপলক্ষে নতুন নতুন কাজ করি। ক্রিসমাস উপলক্ষে ডিসেম্বর মাসে বিক্রি এবং আয় অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি থাকে।’
জেনেটের বর্তমানে প্রতি মাসে আয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। প্রতিদিনই তার পণ্য বিক্রি হয় এবং নতুন নতুন অর্ডারও পান। তাছাড়া ও দুই তিন মাস পর পর অফিসিয়াল প্রোগ্রাম কিংবা হলুদের অনুষ্ঠানে পরার জন্য একসাথে ৫০ থেকে ১০০ পিস কিংবা তার বেশি শাড়ির বাল্ক অর্ডার পেয়ে থাকেন। অনেকে বিদেশে থেকেই বাংলাদেশের শাড়ি-পোশাক বিক্রি করে থাকেন। তারা জেনেট ক্রিয়েশনের পণ্য সংগ্রহ করেন। এই সুবাদে জেনেট ক্রিয়েশনের পণ্য পৌঁছে গেছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাতে।
লিপি