বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস
|| রাইজিংবিডি.কম
আনু মোস্তফা
ঢাকা, ৫ জুন : প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে আছে বাংলাদেশ। প্রকৃতির বিরূপ মনোভাবের কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে এবং দেশটির সার্বিক উন্নয়ন তৎপরতাকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
কখনও কখনও প্রলয়ঙ্করী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আবার কখনও খরার কবলে পড়ছে দেশ। এসব প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে প্রাণ থেকে সম্পদহানি ঘটছে বছর বছর। এটা শুধু দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয় না, পরিবেশের বিপুল ক্ষতি করে।
এ দেশে বন্যার ইতিহাস যুগ যুগের ইতিহাস। কবে থেকে এ অঞ্চলে বন্যা শুরু হয়েছিল তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। অতীতের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ১৭৬৭ সালে এ দেশে একটি ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। এ সময় এ অঞ্চলে ভূমিকম্পও হয়। এরপর ১৯১৭ সালে একটি বড় বন্যা হয়েছিল। ১৯৪৩ সালেও একটি বড় বন্যার উল্লেখ রয়েছে।
মূলত: ১৯৫৪ সাল থেকে বন্যার দাপট শুরু হয়।
তখন থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩২টি বড় ধরনের বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টিকে মহাপ্রলয়ঙ্করী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৫৪, ৫৫, ৫৬, ৬২, ৬৮, ৭০, ৭১, ৭৩, ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৮০, ৮৪, ৮৭, ৮৮ এবং ৯৮-এর বন্যাগুলো মহাপ্রলয়ঙ্করী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ৯টি বন্যা হয়েছে। দেশটি জন্মও নিয়েছে প্রলয়ঙ্করী বন্যার বোঝা মাথায় নিয়ে। একদিকে যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর তান্ডব, অন্যদিকে কড়ালগ্রাসী বন্যার ছোবল দেশটির অর্থনীতিকে প্রায় ধ্বংস করে দেয় ।
১৯৭০ সালের মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে শুধু লোকই মারা যায় সরকারি হিসাবে ৫ লাখ। এ বন্যায় উপকূলের ১৬ হাজার র্বগমাইল এলাকা প্লাবিত হয় এবং ১২ লাখ ৯৮ হাজার টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়। ১৯৭১ সালে আরও একটি মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়।
এ বন্যায় ১৪ হাজার র্বগমাইল এলাকা প্লাবিত হয় এবং ১২ লাখ টন ফসল নষ্ট হয়। এ বছর মানুষ মারা যায় ১২০ জন। ২ লাখ ১৯ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ নষ্ট এবং ২ হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। এভাবে ৭২, ৭৩ ও ৭৪ সালে বন্যায় বিপুল ক্ষতি হয়।
১৯৮৮ সালের মহাপ্লাবনে ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৩০ হাজার র্বগমাইল তলিয়ে যায়। বন্যার করাল গ্রাসে সরকারি হিসাব অনুযায়ী লোক মারা যায় ৩৩৩ জন। আর বেসরাকরি হিসাবে এ সংখ্যা ৬০০-এর বেশি।
দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৭টিতে বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। ৪৬৮টি উপজেলার ২৯৩টি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ২ কোটি ১০ লাখ। বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৩ কোটি। বাস্তুহারা হয় ৩০ লাখ মানুষ।
বিগত ৩৫ বছরে বন্যা কবলিত হয়নি এমনসব উঁচু এলাকাও তলিয়ে গিয়েছিল ৮৮-এর মহাপ্লাবনে। এ বন্যায় দেশের প্রায় ৮০ লাখ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল। বন্যায় ১ কোটি কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পতিত হয়েছিল। প্রায় ২০ লাখ একর জমির ফসল পুরোপুরি এবং ১৫ লাখ একর জমির ফসল আংশিকভাবে ভেসে যায়।
বন্যায় সরকারি হিসাবে ফসল ক্ষতি হয় ২০ লাখ টন শস্য। প্রলয়ঙ্করী বন্যার ছোবলে দেশের ৬ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে ১ হাজার ১৭৫ কিলোমিটার ধ্বংস হয়। এ ছাড়া সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
দেশের ২৪৬টি সেতু ও কালভার্ট বিধ্বস্ত এবং প্রায় আড়াই হাজার ফুট রেলপথ বন্যায় ভেসে যায়। সর্বোপরি গাছপালা ভেসে যায় এবং পরিবেশের বিপুল ক্ষতি হয়।
সরকারি সূত্রে জানা যায়, ৮৮ এর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ মেরামতের জন্য তখন প্রায় ৪০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। এ ছাড়া কয়েক হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছিল। বন্যায় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। বন্যায় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সমগ্র দেশের সব যোগাযোগ বিচ্ছেন্ন হয়ে পড়েছিল।
এ বন্যায় রাজধানীরও অনেক এলাকা ডুবে যায়। ধানমন্ডি, শেরেবাংলা নগর, গুলিস্তান ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কিছু অংশ ছাড়া রাজধানীর প্রায় সব এলাকাই জলমগ্ন হয়েছিল। তখনকার হিসাবে ৬০ লাখ লোকের রাজধানী ঢাকা শহরের প্রায় ৫০ লাখই পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
ঢাকায় প্রায় ৪০০ ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছিল। এসব ত্রাণ শিবিরে প্রায় ৫ লাখ বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছিল।
বন্যার পানি বিমানবন্দরের রানওয়েতে উঠে যাওয়ায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে করা হয়েছিল। আবহাওয়া অফিস, আগারগাঁও সমপ্রচার ভবন, পঙ্গু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল প্রভৃতি স্থানে পানি উঠে গিয়েছিল।
পঙ্গু হাসপাতালে রোগী ভর্তিই বন্ধ রাখা হয়েছিল। মিডফোর্ট হাসপাতালে সব অপারেশন স্থগিত রাখা হয়েছিল। শ্যামলী এলাকায় আবাসিক ভবনের একতলা পর্যন্ত তলিয়ে গিয়েছিল ৮৮’র বন্যায়।
ডুবে যাওয়া ঢাকা শহরে তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছিল। ওয়াসার ২৭টি গভীর নলকূপ বিকল হয়ে পড়েছিল। ফলে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ২০ থেকে ২৫ ভাগ কমে গিয়েছিল।
বন্যাকবলিত ঘিঞ্জি এলাকাগুলোতে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠেছিল। কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছিল ডায়রিয়া, পেটের পীড়া। এতে ৭১ জনের প্রাণহানি হয়েছিল।
৮৮ সালের বন্যার মতো ৯৮ সালের বন্যাও দীর্ঘ সময় স্থায়ী ছিল।
১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় বিপুল ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সরকারের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম ছিল। তারপরও বন্যায় অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিকূল প্রভাব পড়ে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় কৃষি খাত। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অকৃষি খাতের অবকাঠামোও যথেষ্ট ক্ষতি হয়। এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় পরিবেশের বিপুল ক্ষতি হয়। বিশেষ করে নদীভাঙ্গন প্রকট হয়ে উঠে। পানির স্রোতে ভেসে যায় গাছপালা। আবাদি জমি নষ্ট হয়ে যায় বালির আস্তরণে।
১৯৯৮ সালের বন্যার কিছু খতিয়ান এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। এ বন্যার সময় একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয় ৯৮ সালের বন্যা ছিল ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। ভয়ঙ্কর এ বন্যায় বাংলাদেশের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫২টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দেশের ১২ কোটি মানুষের মধ্যে ৩ কোটি মানুষই ছিল বন্যা কবলিত। দেশের মোট ৬৫ হাজার হেক্টর জমি দীর্ঘদিন ধরে বন্যায় ডুবে ছিল। অন্যান্য ক্ষতির হিসাব বাদ দিলেও কেবল খদ্যো ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২১৮ লাখ মেট্রিক টন। বন্যায় মানুষ মারা গিয়েছিল ১ হাজার ৫০০ জন। গবাদি পশুর মৃত্যুর সংখ্যা ২২ হাজার।
এই বন্যা বিরতি দিয়ে স্থায়ী হয় ৮০ দিন। দেশের ৩ লাখ নলকূপ নষ্ট হয়ে হওয়ায় পানীয় জলের সংকট চরমভাবে দেখা দিয়েছিল। বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।
এ ছাড়া ২০০০ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এক আকস্মিক বন্যায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ৭টি এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় ২টি জেলার ৪১টি উপজেলার ২৮০টি ইউনিয়নে বন্যায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৮ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হওয়ার পাশাপাশি উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। বেসরাকরি হিসাবে মানুষ মারা গিয়েছিল ১৩০ জন। এদের বেশির ভাগ মানুষ সাপের কামড়ে, পানিতে ডুবে এবং পেটের পীড়ায় ভুগে মারা গেছে।
সরকারি বিবৃতিতে জেলা তথ্য কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানানো হয়, ৫৮ হাজার ৯০৫টি পরিবারের ৩১ লাখ ৯২ হাজার ৭৮৬ জন বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৮ লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে ৮ শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদিকে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সিডর প্রবাহিত হয়। এর আঘাতের কবলে পড়ে দেশের ২২টি জেলা।
সিডরে প্রায় ১৫ হাজার লোক মারা যায়। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, এটি ১৩১ বছরের ইতিহাসে বড় দশটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম।
এদিকে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশের জন্য আগামীতে রয়েছে বন্যার আরও অনেক অজানা শঙ্কা।
ইন্টারনেট অবলম্বনে
রাইজিংবিডি/এলএ
রাইজিংবিডি.কম