চরিত্র নিয়ে ভাবতে ভাবতেই গল্প লেখা হয়ে যায়: আফসানা বেগম
আফসানা বেগম : (ছবি : ছাইফুল ইসলাম মাছুম)
আফসানা বেগম। কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক। জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৭২ সালে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বই ঝাঁপ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ), রোমান সাম্রাজ্য (অনুবাদ), জীবন যখন থমকে দাঁড়ায় (নভেলা), দশটি প্রতিবিম্বের পাশে (ছোটোগল্প), লেখালেখি তাদের ভাবনা (অনুবাদ)। ‘দশটি প্রতিবিম্বের পাশে’ পাণ্ডুলিপির জন্য জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৪ লাভ করেছেন তিনি। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় রাইজিংবিডির স্টলে আমরা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সেখানেই সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন তিনি। কথোপকথনে ছিলেন সাইফ বরকতুল্লাহ।
সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলা কেমন দেখলেন?
আফসানা বেগম : যখন ছাত্রাবস্থায় ছিলাম, তখন ছোট্ট একটা জায়গায় মেলা হতো। বাংলা একাডেমিতে একপাক ঘুরলেই সব বই দেখা হয়ে যেত। চেনা হয়ে যেত কোথায় কী বই আছে, তালিকা করে বই কিনতাম। প্রতিদিনই আড্ডা দিতে যেতাম বইমেলায়। আড্ডা শেষে যাওয়ার সময় একটা দুটো বই কিনে নিয়ে যেতাম। এত কাছাকাছি স্টলগুলো ছিল, বড় কোনো লেখক হেঁটে গেলে আমরা কাছাকাছি পেতাম ওটাই ছিল তখনকার আনন্দ। এখন মেলা বিস্তৃত হলেও সেরকম আপন ভাবটা এখন পাইনা। সেই মিলনটা যেন কোথাও মিস করছি বইমেলায়।
সাইফ বরকতুল্লাহ : ইতিমধ্যে এবারের মেলায় তিন হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে। একটা সমালোচনা কিন্তু সব সময়ই হচ্ছে যে অধিকাংশ বই সম্পাদনা ছাড়া বের হচ্ছে? আপনার ভাবনা কী?
আফসানা বেগম : এত বই যে বের হচ্ছে সব বই মানের দিক দিয়ে ভালো এটা আমি মনে করি না। সম্পাদনা ছাড়া বের হচ্ছে দ্বিতীয়ত আসলেই কী সেই লেখাটা বইটা বেরোনোর জন্য যোগ্য ছিল- এই বিষয়টা কে বিচার করবে? তো পাঠক কিন্তু বিভ্রান্ত হচ্ছে, প্রচুর পাঠক। এখন এটা দুইভাবে দেখা যায়, অনেকেই প্রচুর বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু আসলেই সে কী পড়ছে? এখানে কী শুধু সংখ্যাটা দেখব-কত বেশি বই আমাদের হাতের সামনে আছে সেটা না কি কোন বইটা পাঠকের জন্য উপযুক্ত বা কতটুকু প্রয়োজনীয়। আমার মনে হয় কোয়ানটিটি না দেখে কোয়ালিটি বিচার, নিয়ন্ত্রণ করা হতো তাহলে আরো অনেক সুন্দর হতো, পাঠক হিসেবে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না।
সাইফ বরকতুল্লাহ : আমরা যারা সারা বছর সাহিত্যের খোঁজখবর রাখি, আমরা দেখি যে সময়কাল নিয়ে সাহিত্য রচনা কম হচ্ছে...
আফসানা বেগম : আমার তো মনে হয় যখন যে লিখছেন তিনি বর্তমান সময়টাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। এখনকার সময় বলেন আর আগের সময়ের কথা বলেন, কিংবা ঔপন্যাসিক হোক, গল্পকারই হোক তার কাজই কিন্তু তার লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তোলা। এ বিষয়ে আমি খুব হতাশাবাদী নঅ। প্রচুর কথাসাহিত্যিকের লেখায় কিন্তু এ সময়কার চিত্র ফুটে উঠছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সমাজ ভাবনা সব বিষয় উঠে আসছে সঙ্গে আশার আলোও তুলে ধরা হচ্ছে।
সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি কথাসাহিত্য রচনার পাশাপাশি অনুবাদও করছেন। আমরা বিদেশি অনেক লেখকের বই বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় অনুবাদ পাচ্ছি। বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত সাহিত্য রচনা রয়েছে যেগুলো বিদেশে অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। আপনা ভাবনা..
আফসানা বেগম : দুই তিনটা সংগঠন এরকম উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। বাংলা ভাষার সাহিত্যগুলো অনূদিত হয় সেরকম কাজ করছে তারা। অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে করছে। আমার কাছে যখন মনে হয় যে এটা করা জরুরি, তখন আমি নিজেই সেটা করি। কিন্তু এটাকে আমি যথেষ্ট মনে করি না। আগের কথায় বলুন কিংবা এখনকার কথায় বলেন আমাদের বলুন অনেক ভালো সাহিত্য আছে। আমি যখন বাইরের দেশের কোনো লেখা পড়ি (ইংরেজিতে বা বাংলা অনূদিত), তখন অনুভব করি যে আমাদের দেশে এরকম বিষয়ে অনেক ভালো লেখা আছে কিন্তু ইংরেজিতে অনূদিত হলো না বলে বাইরের দেশে গেল না। এই দুঃখটা আমাদের থেকেই যাচ্ছে।
সাইফ বরকতুল্লাহ : এখন তো তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। দেখা যাচ্ছে যে ফেসবুকে অনেকেই সাহিত্যচর্চা করছেন। সেখানে অনেকেই ভালো ভালো লেখা দিচ্ছে, সেটা ছোট হোক, এখানেও কিন্তু বাংলা সাহিত্যের একটা উন্মেষ হচ্ছে। এ বিষয়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আফসানা বেগম : এটাতে আমি দ্বিমত পোষণ করি না।
সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনার অনেক গল্পেই জীবনের প্রতিচ্ছায়া খুঁজে পাই। আপনার গল্পগুলো পড়লে মনে হয় যেন দৈনন্দিন দিনযাপনের চিত্র চলে আসে। এরকম লেখার অনুপ্রেরণা কীভাবে পেলেন?
আফসানা বেগম : এটা ওই চরিত্রটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই এরকম লেখা হয়ে যায়। এরকম কোনো একটা চরিত্র নিয়ে আমি ভাবছি, কোনো একটা গল্প লেখার সময় কাহিনি তৈরি করে ফেলি তা না। শুধু চরিত্র নিয়ে ভাবতে ভাবতেই গল্প হয়ে যায়। আবার অনেক সময় ছোট্ট একটা লাইন থেকে চরিত্র চলে আসে। কখনো গান শুনছি তার একটা কলি থেকে একটা ছবি চলে আসে সামনে। সেই ছবি থেকে হয়তো আমি একটা চরিত্র বের করে ফেলি। এভাবে গল্প লেখার চেষ্টা করি।
সাইফ বরকতুল্লাহ : এবার আপনার কী কী বই আসল?
আফসানা বেগম : চারটি নতুন বই এসেছে। এর মধ্যে দুইটি মৌলিক ও দুটি অনুবাদ গ্রন্থ। মৌলিক বই দুটির মধ্যে একটি গল্প সংকলন, ‘আমি অথবা আমার ছায়া’, এটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। অন্যটি উপন্যাস, ‘পাশে হলো না যাওয়া’, এটি প্রকাশ করেছে গ্রন্থকুটির। অনুবাদগুলোর মধ্যে দুইটি ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ রোমান প্রজাতন্ত্র (আইজাক আসিমভ) প্রকাশ করেছে সন্দেশ ও ‘ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে’ (ফিদেল ক্যাস্ত্রো) বইটির প্রকাশক সংহতি।
সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলা নিয়ে প্রত্যাশা..
আফসানা বেগম : যারা সত্যিকারের সাহিত্যচর্চা করছেন না, শুধুমাত্র ব্যবসার জন্য বইমেলাকেন্দ্রিক তাদের যে আয়োজন এটা বন্ধ হওয়া দরকার। আর বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা চাই।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ/ইভা
রাইজিংবিডি.কম