ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১১ ১৪৩১

চোখে তার শান্তির ধারা

বিতস্তা ঘোষাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২১, ২০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
চোখে তার শান্তির ধারা

সালটা ১৯৮৩ এর প্রথম দিক। সবে স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তখনি একদিন আবছায়া প্রায় অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে দোতলার একটা ঘরে উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম।

সিঁড়ির প্রথম ধাপ থেকে এত ভিড় কেন? যেন পেঁচালো সিঁড়ি বেয়ে শত শত সাপ। আমি এখন কী করে উপরে যাব? কিন্তু আজ আমাকে ওই ঘরটায় যেতেই হবে। কারণ পরের সপ্তাহ থেকে নতুন ক্লাস। নতুন বই আর স্কুল ব্যাগ আজ আমায় কিনতেই হবে।

কোনো রকমে ভিড় কাটিয়ে রেলিংটা সাবধানে ধরে দোতলা পৌঁছানো গেল। কিন্তু সেখানেও এত লোক দাঁড়িয়ে কেন? কী হয়েছে এখানে? প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে লাগল। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর হঠাৎ হারুমামা কোথা থেকে বেরিয়ে এলো। বলল, মুনাই আজ এখানে কেন? কার সঙ্গে এলে?

কালীচরণ কাকুর সঙ্গে এলাম। তোমার ভাগ্নেই আসতে বলেছে। বলো আমি এসেছি।

হারুমামা একটু গম্ভীর মুখ করে বলল, অদ্ভুত তো! আজ আসতে বলেছে তোমায়?

হ্যাঁ, তাই তো এলাম।

কিন্তু আজ অমাবস্যা। তার ওপর শনিবার। ভাগ্নে পুজোয় বসে গেছে। শেষ হতে হতে অনেক রাত। সবাইকে প্রসাদ দিয়ে দেখা করে বেরতে এখনো বহু দেরি হবে। তুমি বরং, একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, ওখানে বোসো। আর মুড়ি মাখা, চপ খাও। বুমাদি এনেছে।

বুমাদি মানে আমরা তাকে বুমাপিসি বলি, বাবার যেকোনও  অনুষ্ঠানে দেশাত্মবোধক গান গাইতেন। তার সামনের দুটি দাঁত ছিল সোনার। সেটা আবার খোলাও যেত। খুব রোগা শ্যামলা গড়ন বুমাপিসির হাসিটা ছিল ভারি উজ্জ্বল। আর বাঁধানো সোনার দাঁতের জন্য তা আরো দীপ্তময় হয়ে উঠত। এহেন পিসির দারুণ সুনাম ছিল মুড়ি মাখায়। নানান মসলা, চানাচুর, বাদাম নারকেল, তেল দেওয়া সে মুড়ির আকর্ষণ উপেক্ষা করা নাকি সকলের অসাধ্য!

মুড়ি খেতে খেতে শুনলাম ভেতরের ঘরে পূঁজা চলছে। বাবার মন্ত্র উচ্চারণ কানে আসছিল। এগুলোর সঙ্গে আমি পরিচিত। বাবা রোজ সকালে, রাতে এভাবেই পূঁজা করেন বাড়িতে।

বাবা শ্মশানে বসে সাধনায় মগ্ন থাকেন সেও দেখেছি ছোটো থেকেই। এমনকি বাবা কালীপূঁজাও করেন, ব্যারাকপুরের পুলিশ কোয়ার্টারে সত্যেন জ্যেঠু্র কালীপূজায় বাবা সারারাত ধরে পূঁজা  করেছিলেন, মায়ের হাতের কাটা মুন্ড থেকে রক্ত ঝরছিল, খুব আবছা মনে পড়ে সবাই সকালে বলাবলি করছিল শেয়াল এসে নাকি সেই রক্ত পান করেছিল। এমনকি পিটিএস পুলিশ লাইন কোয়ার্টারে সাদা সরস্বতীকে নীল সরস্বতীতে রূপান্তরিত করেছিলেন তাও নিজের চোখে দেখেছি। সেই থেকে বাবার প্রকাশনা সংস্থার নাম ‘নীল সরস্বতী’ তাও জানি। কিন্তু অফিসে পূঁজা কেন? আর অমাবস্যা বলে আলাদা কেন? এত মানুষের ভিড়ই বা কেন এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে লাগল।

সেখানে বসেই শুনতে পেলাম তিনজন রাষ্ট্রীয় মন্ত্রী ভেতরে। আর বাইরে যারা দাঁড়িয়ে তারা নাকি সব আমলা, আই এ এস, আই পি এস, করপোরেট জগতের বিখ্যাত মানুষ, শিল্পপতিও নাকি আছেন। এদের বেশির ভাগ মানুষকেই আমি চিনি না। খুব অবাক লাগছিল তাদের কথা শুনতে।

একজন বললেন, আজ যেন দাদার কৃপা পাই, আরো একজন বললেন, আমি গত সপ্তাহে ওনার ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠা করেছি। যত শুনছিলাম তত প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল। কে এই দাদা? তিনি কি কোনো মহাপুরুষ? রামকৃষ্ণ –বিবেকানন্দের মতো কেউ?

আমাদের ২১০-বি/১–ই, কালীচরণ ঘোষ রোডের বাড়ির তিনতলার ঠাকুর ঘরে বেশকিছু মানুষ গভীর রাতে আসেন লালবাতি দেওয়া গাড়িতে। সঙ্গে আসেন পুলিশ। ওপরের সেই রুদ্ধ কক্ষে কী আলোচনা হত জানি না আজও। কিন্তু পরদিন পাড়ার লোকেরা বলতেন, তোদের বাড়িতে শিক্ষামন্ত্রী কিংবা  তথ্যসংস্কৃতি মন্ত্রী! কি করেন এখানে তারা?

তখন আমাদের বাড়িতে টিভি ছিল না। কাজেই কাউকেই চিনতাম না। খবরের কাগজ পড়ারও তখন বয়স নয়। কাজেই কে রাষ্ট্রীয় মন্ত্রী, কে শিক্ষামন্ত্রী জানতাম না। আরো জানতাম না আমলা বা করপোরেট জিনিসটা কী? কিন্তু প্রশ্নের অভিমুখ দেখে মনে মনে আনন্দ হত এই ভেবে যে, কিছুদিন আগেও এদের জানার বিষয় ছিল বাবা কি কোনো বিখ্যাত কেউ? আজ আর সে প্রশ্ন নেই। কারণ তখন নানা পুরস্কারে (রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, আন্তর্জাতিক মাতা কুসুমকুমারী পুরস্কার, জাতির শিক্ষক পুরস্কার প্রমুখ) ভূষিত হওয়ায় বাবা প্রায়ই খবরের শিরোনামে।

সেদিন দেখলাম সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষকে, মনে হচ্ছিল কোনো সাধক। পূঁজা শেষ হবার পর সব প্রতীক্ষারত মানুষকে এক এক করে প্রসাদ দেবার পর দেখলো আমায়। হাসলো। সেই বোকা বোকা হাসি। যেটার সঙ্গে আমরা পরিচিত ছোটো বেলা থেকেই। বললো, অনেক রাত হয়ে গেল নারে! ঘুম পেয়েছে তোর? খাবি কিছু?

আমি খালি বললাম, এখন কী বাড়ি যাবে?

বললো, আর আধ ঘণ্টা বোস।

অনেক রাতে সেই সিঁড়িটা দিয়ে যখন নেমে এলাম তখন সমস্ত কলেজ স্ট্রিট নিঝুম।

সেই দোতলার ঘরটা ছিল ৭৯, মহাত্মা গান্ধী রোডের ‘অনুবাদ পত্রিকার’ দপ্তর। রাষ্ট্রীয় মন্ত্রী ছিলেন মাননীয় প্রণব মুখোপাধ্যায়। আমলারা হলেন তৎকালীন মৎসসচিব সুজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডি জি অর্চিস্মান ঘটক, অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার সত্যেন গুহ, মণিশ গুপ্ত। বাকিদের নাম আর এখন মনে নেই (এগুলোও অবশ্য অনেক পরে জেনেছি, তাও অন্যান্য অনুরাগীদের মুখে। কারণ বাবা বাড়িতে কখনো কারোর কথা বলতেন না, এমনকি কোনো লেখককেও আমরা চিনতাম না, যদিও নানান দেশি-বিদেশি বইয়ের মধ্যেই ডুবে থাকতাম আমরা আর সেই ‘দাদা’, ‘ভাগ্নে’ এবং আমি যার কাছে এসেছিলাম তিনি হলেন অনুবাদ পত্রিকার সম্পাদক)

বড় হয়ে জেনেছি অনুবাদ পত্রিকার দপ্তরটি আসলে ছিল বিবিধের মাঝে মিলনের ক্ষেত্র। সবার জন্য অবারিত দ্বার সেখানে।

না, সেদিন স্কুল ব্যাগ বই কোনোটাই কেনা হয়নি। মা পরের দিন পাড়ার বইয়ের দোকান থেকেই কিনে দিয়েছিলেন সব।

মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখি ওই সিঁড়িটা বেয়ে আমি ওপরে ওঠার চেষ্টা করছি। আর বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছি।

এমনি একদিন ঘুম থেকে উঠে লিখলাম-

..অবশেষে পৌঁছনো গেল

পথটা সহজ ছিল না

গলি, উপগলি, মাঠ, আলপথ...

একটা হাতছানি-

সেই সন্যাসীর-

চোখে তার শান্তির ধারা, ঠোঁটেতে গায়ত্রী

ছোঁয়ার নেশায় ছুটছি

এখন সবে গোধূলি

সামনে সাত সমুদ্র সিঁড়ি...

এখন বুঝি ওই সিঁড়িটা ছিল আমার ঈশ্বরের কাছে পৌঁছাবার এক রাস্তা...।

লেখক: কথাসাহিত‌্যিক ও সম্পাদক, অনুবাদ পত্রিকা, কলকাতা


ঢাকা/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়