ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিল্প আন্দোলনের পুরোধা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ২৮ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিল্প আন্দোলনের পুরোধা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন

রুহুল আমিন : এদেশের শিল্প-আন্দোলনকে বহুমুখী সৃজন ও কর্মধারা দিয়ে সঞ্জীবিত করেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি যে কাউকে অনুপ্রাণিত করে।সবচেয়ে বড় কথা তিনি এই দেশের শিল্প-আন্দোলনকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনের পথিকৃত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ৪১ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।১৯৭৬ সালের ২৮ মে  পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ।

জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহুকুমার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা (সাব-ইন্সপেক্টর)।মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিণী। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে জয়নুল ছিলেন সবার বড়। পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারের অভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডলে।

খুব ছোট থেকেই তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। তিনি পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফলসহ আরও কত কি এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন।

ওই সময় চারুকলা নিয়ে পড়াশোনার বিষয়ে কোনো মুসলিম পরিবার থেকেই তেমন উৎসাহ ছিল না। ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারে ছবি রাখা, ছবি আঁকায় ছিল বাধা। তাছাড়া চারুকলায় পড়াশোনা করা এবং পাসের পর আর্থিক দিক থেকে অনিশ্চয়তাও একটা ব্যাপার ছিল। আর তার বাবা পুলিশের অল্প বেতনের কর্মচারী। কলকাতায় পড়ানোর মতো অর্থও ছিল না। তারপরও প্রাথমিক স্কুলজীবনের শেষ পর্বে ১৯৩৩ সালে এক অনমনীয় জেদ নিয়ে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন।

মজার ব্যাপার, এর আগে ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। আর্টস স্কুল দেখে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুলের মন বসছিল না। তখনই মাধ্যমিক (ম্যাট্রিক) পরীক্ষার আগে, স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান। অবশ্য মায়ের কিছুটা সমর্থন ছিল ছেলের প্রতি। ছেলের আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে সাহায্য করেন মা।

জয়নুল ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাখ করেন। ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায়ই চমৎকার নিসর্গচিত্র অঙ্কনে পারদর্শিতা অর্জন করেন তিনি। এই দক্ষতা ও স্বতন্ত্র চিত্রভাষা সৃষ্টিতে সাহায্য করে তাকে।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জয়নুল  তখন যুবক। দারিদ্র্যের এই লাঞ্ছনা তাকে প্রবলভাবে বিচলিত করেছিল। দরিদ্রপীড়িত মানুষদের নিয়ে তিনি ছবি আঁকলেন এবং সেগুলো প্রকাশিত হলো সংবাদপত্রে। যা তখন ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। এরপর ওই আলোড়ন থেকেই লঙ্গরখানা খোলা হয়। যে লঙ্গরখানা লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। আর দুর্ভিক্ষের এই চিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে খ্যাতিমান শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন জয়নুল। পরবর্তীতে যেকোনো জাতীয়  দুর্যোগ, সংগ্রাম ও স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। পাশাপাশি নানা মাত্রিক ও অঙ্গীকারের চেতনালগ্ন হয়ে ওঠে তার অঙ্কন।

 

জয়নুল আবেদিনের আঁকা একটি দুর্ভিক্ষের চিত্র


১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে চারুকলা-চর্চার অনুকূল পরিবেশ ছিল না। ধর্মীয় কারণে ছবি আঁকাকে নিরুৎসাহিত করা হতো। ওই রকম কঠিন সময়ে ১৯৪৮ সালে মাত্র দুটি কক্ষ নিয়ে পুরান ঢাকার জনসন রোডে স্থাপিত হয় গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউট। শুরুতে এর ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮। জয়নুল ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক। ১৯৫১ সালে এই আর্ট ইনস্টিটিউট সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালে আর্ট ইনস্টিটিউটটি শাহবাগে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৩ সালে এটি একটি প্রথম শ্রেণির সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’। তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নিরলস পরিশ্রমে গড়ে ওঠা শিল্পশিক্ষার এই উন্নত প্রতিষ্ঠানটি তাকে বিশিষ্ট করে রেখেছে।

এদেশের বর্তমান আধুনিক শিল্পচর্চার যে-পরিবেশ গড়ে উঠেছে তার রূপকার ছিলেন তিনি। সেজন্যই তাকে শিল্পাচার্যের সম্মান দেওয়া হয়েছে। জয়নুল এক বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন। সহজ ও স্বচ্ছন্দ ব্যবহার দিয়ে তিনি সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাঝে হয়ে উঠেছিলেন প্রিয়। খ্যাতিমান শিল্পী হয়েও শিক্ষকতা করার সময় তার ভেতর কোনো ধরনের অহংবোধ জন্মায়নি। তার আগ্রহে ও পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর ও ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করে।

তার বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো হলো- ১৯৫৭ সালে নৌকা, ১৯৫৯ সালে সংগ্রাম, ১৯৭১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা প্রভৃতি। তার দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯ সালে অঙ্কিত ‘নবান্ন’ ও ১৯৭৪ সালে অঙ্কিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম। ধারণা করা হয় তার চিত্রকর্মের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে তার ৮০৭টি শিল্পকর্ম সংগৃহীত আছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সংগ্রহে সংরক্ষিত আছে আরো প্রায় ৫০০ চিত্রকর্ম। ময়মনসিংহের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে ৬২টি চিত্রকর্ম। আর তার পরিবারের কাছে এখনো চার শতাধিক চিত্রকর্ম সংরক্ষিত। এ ছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় তার বিপুল পরিমাণ চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে বলে ধারণা করা হয়।

বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারে তার প্রচেষ্টা ছিল আমৃত্যু। দেশের চিত্রকরদের মধ্যে তিনি শিল্পগুরুও বিবেচিত হন। তার নামে চারুকলা বিভাগে একটি গ্যালারি রয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৫ নম্বর গ্যালারীতে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা স্থাপন করা হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন ২০০৯ সালের ৯ জুলাই বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ জয়নুল আবেদিনের মানবসভ্যতায় মানবিকমূল্যবোধ ও উপলদ্ধিকে গভীরতর করার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আবেদিন’ জ্বালামুখ নামে নামকরণ করা হয়। বিশ্বের প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ ব্রিটিশ নিলামকারী প্রতিষ্ঠান বনহামসে তার স্কেচ বিক্রি হয়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মে ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়