ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জন্ম বাংলায়, খেলেছেন ভারতে, উপাধি চীনের প্রাচীর

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ২০ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জন্ম বাংলায়, খেলেছেন ভারতে, উপাধি চীনের প্রাচীর

কলকাতার বাবুঘাটে গোষ্ঠ সরণিতে স্থাপিত গোষ্ঠ পালের মূর্তি। ইনসেটে গোষ্ঠ পাল (ছবিগুলো মোহনবাগান ক্লাবের একটি স্মরণিকা থেকে নেওয়া)

হাসান মাহামুদ : ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই পুরো ভূখণ্ড ছিল ব্রিটিশদের দখলে। এই শতাব্দীতে পৃথিবীতে ঘটেছে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু পুরো ভারতবর্ষের মানুষ ব্যতিব্যস্ত ছিল ব্রিটিশদের শাসন বা অত্যাচার সহ্য করার আর গুটিকয়েক আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টায়। এর মধ্যেই কিছু আন্দোলন ছিল গর্ব করার মতো, কিছু কিছু অনুষঙ্গ ছিল ভাল লাগার, কিছু কৃতিত্ব ছিল প্রশংসনীয়, যেসব পরবর্তী সময়ে ইতিহাসে পরিণত হয়। তেমনি এক কৃতিত্বের স্বীকৃতি ‘চীনের প্রাচীর’ উপাধি।

গ্রেগরিয় পঞ্জিকা অনুসারে ১৮০১ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কাল ঊনবিংশ শতাব্দী। এই শতাব্দীতে স্পেনিয়, পর্তুগিজ ও উসমান সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় এবং রোমান সাম্রাজ্য ও মোঘল সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ হয়। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধগুলো শেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের নেতৃত্বে আবির্ভূত হয়। বিশ্বের এক চতুর্থাংশ জনগণ ও এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড এ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল। সারা বিশ্বে দাস প্রথা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। বিদ্যুৎ, স্টিল ও পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার বেড়ে যায় ও একটি দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে। যার ফলশ্রুতিতে জার্মানি, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং এরা নিজ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীন অন্যান্য বিশ্বশক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। ফলে এ সাম্রাজ্যগুলোতে সামাজিক নৈরাজ্য বেড়ে যায়।

এই পুরো শতাব্দীতে ভারতবর্ষ জুড়ে ছিল ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য। সেই সময়ে এই বাংলায় জন্ম নেয় এক রহস্য বালকের। তখন খেলাধুলার খুব একটা প্রচলন ছিল না। কিন্তু সেই বালক ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলা আরম্ভ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। হয়েছেন জাতীয় ক্লাবের অধিনায়ক। পেয়েছেন ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি। খেলোয়াড়ি জীবনে ভূষিত হয়েছেন ‘চীনের প্রাচীর’ উপাধিতে। তিনি গোষ্ঠ পাল।

গোষ্ঠ পালের জন্ম ১৮৯৬ সালের আজকের দিনে (২০ আগস্ট)। তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের মাদারীপুর সাব ডিভিশনের ভোজেস্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামলাল পাল ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু আদরের একমাত্র সন্তান বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ফুটবলের প্রতি আসক্ত এটি দেখে বাবাও আর না করেননি।

মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি কলকাতার একটি ক্লাবে খেলার সুযোগ পান। এই বয়সেই তিনি কুমারটুলির হয়ে মাঠে নামেন। ১৯০৭ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার কুমারটুলি ক্লাবে খেলেছেন। মোহনবাগানের খেলোয়াড় রাজেন সেনের সহায়তায় তিনি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগান দলে যোগ দেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগানের হয়ে তিনি প্রথম খেলেন। এরপর ২৩ বছর ধরে মোহনবাগানের হয়ে খেলেছেন। পরাধীন ভারতে সবুজ-মেরুন রঙের জার্সি গায়ে মোহনবাগান রক্ষণে তার বিক্রমকে ভয় পেত বুট পরা ইংরেজ ফুটবলাররাও।

গোষ্ঠ পাল খেলতেন রাইট ব্যাক পজিশনে। খেলার সময় বুট পরা ইউরোপিয় খেলোয়াড়দের তিন খালি পায়ে খেলে প্রতিরোধ করতেন। ভারতীয় দল নিয়ে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহলে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) যান। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। পরে তিনি আঘাতের কারণে যেতে পারেন নি। ১৯২৪ সালে ভারতীয় জাতীয় দলেরও অধিনায়কত্ব পান। তিনি হকি খেলাতেও দক্ষ ছিলেন এবং ক্রিকেট এবং টেনিসও খেলতেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৬২ সালে ভারত সরকার গোষ্ঠ পালকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ভারতের প্রথম ফুটবল খেলোয়াড় যিনি পদ্মশ্রী উপাধি পেয়েছেন। মোহনবাগান ক্লাব ২০০৪ সালে তাকে মরনোত্তর ‘মোহনবাগান রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে। কলকাতায় তার নামে একটি রাস্তা গোষ্ঠ পাল সরণি আছে। এই রাস্তায় তার একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। মোহনবাগান ক্লাবের ভেতরে তার নামে একটি সংগ্রহশালা ‘গোষ্ঠ পাল সংগ্রহশালা’ তৈরি হয়েছে। তার উপর ভারতে ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছে।

গোষ্ঠ পাল ফুটবল খেলে উপমহাদেশে সেই বিংশ শতাব্দীতে নাম কুড়ালেও কখনোই বাংলাকে ভোলেননি। এমনকি তার আত্মজীবনীতেও তিনি বারবার লিখেছেন বাংলার কথা, তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) কথা। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘পূর্ব বঙ্গের ফরিদপুরের মাদারীপুর সাব ডিভিশনের ভোজেস্বর গ্রামে আমার জন্ম হয়, দিনটি ১৮৯৬ সালের ২০শে আগস্ট, দিনের আলো ফুটিবার আগেই আমি ধরিত্রীর মুখ দেখিয়াছিলাম, আমার পিতা সেই সময় ঘরে ছিলেন না, পিতৃদেবের নাম শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামলাল পাল, বরিশালের ঝালকাটি বন্দরে তেজারতির কারবার করিতেন, আমি পিতার প্রথম এবং একমাত্র সন্তান’

মোহনবাগানের ওয়েবসাইটে গোষ্ঠ পাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, আত্মজীবনীর ভাষার মতোই তার চরিত্রটি ছিলো সরল, সাধাসিধে এবং স্পষ্ট। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আরো কতগুলো বৈশিষ্ট- আত্মসম্মানবোধ, খেলোয়াড়ী মনোভাব, ওদার্য এবং আনুগত্যবোধ, যেগুলো আজ মাঠ এবং মাঠের বাইরে খুঁজেই প্রায় পাওয়া যায় না।

 

 

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ আগস্ট ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়