ঢাকা     শনিবার   ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১৫ ১৪৩১

চাটগাঁইয়া মেজবানের সেকাল-একাল

আহমদ মমতাজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২০, ২৫ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চাটগাঁইয়া মেজবানের সেকাল-একাল

আহমদ মমতাজ : ‘মেজবান’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ খুবই সহজবোধ্য, বহুল জনপ্রিয় ও পরিচিত। অতিথি সৎকারকারী বা আপ্যায়কই মেজবান আর মেজবানি হচ্ছে আতিথেয়তা, মেহমানদারি অথবা অতিথিদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা। চট্টগ্রাম অঞ্চলে মেজবান মূলত কোন উপলক্ষ কেন্দ্র করে আয়োজিত একটি গণভোজ। যার মধ্যে রয়েছে প্রিয়জনের মৃত্যু বা মৃত্যু দিবস, জন্ম বা জন্মদিবস, নিজেদের কোনো সাফল্য, নতুন কোনো ব্যবসা শুরু, নতুন বাড়িতে প্রবেশ, পরিবারে নতুন সদস্যের আবির্ভাব (শিশুর জন্ম), বিবাহ, আকিকা ও সুন্নতে খৎনা, মেয়েদের নাক-কান ছেদানী এবং নবজাতকের নাম রাখা উপলক্ষ্যেও মেজবানির আয়োজন করা হয়।

বৃহত্তর চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন উপলক্ষে বাৎসরিক মেজবানের আয়োজন করেন। হাজারো আমন্ত্রিতের অংশগ্রহণে মেজবান অনুষ্ঠান মিলনমেলায় পরিণত হয়। আয়োজক তার সর্বোচ্চ সাধ্য ও যত্ন নিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করেন। স্বনামখ্যাত বাবুর্চি এনে তিনি রান্নার কাজটি করেন, সে সাথে হৃষ্টপুষ্ট গরু, রান্নার সার্বিক উপকরণ ও আনুষঙ্গিক ব্যয়ে তিনি কার্পণ্য করেন না। আজকাল সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মেজবানি আয়োজন বড় ভূমিকা রাখে। এই সংস্কৃতি এতোদিন গ্রাম পর্যায়ে বহুলভাবে প্রচলিত ছিল, আজকাল শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি মেজবানে ভিন্নমাত্রা যুক্ত হয়েছে রাজনীতির ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দলীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতে, জনপ্রিয়তা দেখাতে কিংবা নির্বাচনোপলক্ষে দলীয় নেতা-কর্মী, সমর্থকদের আনুগত্য লাভ করতে, মনোবল চাঙ্গা রাখতে, বিশাল প্রস্তুতি ও পরিসরে মেজবানের আয়োজন করেন। এ ক্ষেত্রে দশ থেকে একশ গরু দিয়েও মেজবান খাওয়ানোর রেওয়াজ চালু হয়েছে।

চট্টগ্রাম শহরে কিং অব চিটাগাং-এর মতো বড় পরিসরের আরো অনেক কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে যেখানে কয়েক হাজার লোক গাড়ি নিয়ে এসে খাওয়া-গল্প, আড্ডায় অংশ নিতে পারেন। আলোচনা সভা ও সম্মিলন চলে পাশাপাশি। মন্ত্রী থেকে সাধারণ কর্মী, রাজনৈতিক নেতা সমর্থকরা দল বেঁধে মেজবানে অংশগ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির স্বার্থে পারস্পরিক মত বিনিময় ও সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাম্প্রতিককালে মেজবানের সংস্কৃতি জেলার বাইরে নিয়ে গেছেন। চট্টগ্রাম থেকে দলীয় নেতা-কর্মীরা টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে গিয়ে অন্তত ২০ হাজার লোককে মেজবান খাওয়াচ্ছেন। এটা সাধারণত বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজন করা হয়। ফলে বৃহত্তর ফরিদপুরের মানুষ চাটগাঁইয়া মেজবানের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। আজকাল বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি ও মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক প্রসারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে মেজবানের আয়োজন করছে। কোম্পানির স্বার্থসংশ্লিষ্ট লোকেরাই এসব মেজবানে দাওয়াত পান। সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না।  সেকালে চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে আমন ধান কাটার পর খোলা মাঠে বাঁশের ধারা বা পাটি  বিছানো হতো। সেখানে বসতেন মেজবান খেতে আসা আমন্ত্রিত মেহমানরা। মাটির বাসনে ভাত দেওয়া হতো, মাটির বাসনে তরকারি ও গোশত পরিবেশন করা হতো। গরুর গোশতের সাথে থাকতো কলইর ডাল এবং লাউ তরকারি। কখনো কখনো থাকতো আলু কিংবা মিষ্টি কুমড়া। লাকড়ির চুলায় রান্না করা গরুর গোশতের খুশবু আশপাশের পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়তো বাতাসের সাথে। মানুষ পরিতৃপ্তির সাথে খেতেন।

আজকাল এ দৃশ্য দেখা যায় না। শহরের মতো গ্রামে হাটে-বাজারে কমিউনিটি সেন্টার গড়ে উঠেছে। সেখানে টেবিল-চেয়ার সাজিয়ে রাখা হয়। চেয়ারে বসে মেহমানরা মেজবানি খানা খেয়ে যান। ডেকোরেশন কোম্পানির বয়-বাবুর্চিরা খানা পরিবেশন করেন। ফলে গ্রামের মানুষের আন্তরিক পরিবেশনা, হাঁক-ডাক, আদর-যত্ন ও খোঁজখবর নেওয়া- এসব প্রাণের ছোঁয়া পাওয়া যায় না। বরং খাওয়ার পর বয়দের বখশিস নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ও অনুনয়-বিনয়ের দৃশ্য কখনো কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সব মিলিয়ে মেজবানি সংস্কৃতির প্রসার যেমন ঘটেছে, তেমনি তার রং-রূপ বদলেছে। আজকাল মেজবানি উপলক্ষে ঢোল কিংবা টিঙের চুঙা ফুকানো হয় না, যেমন হয় না লোক মারফত পাড়া- মহল্লায় বাড়ি বাড়ি দাওয়াত পৌঁছানোর আনুষ্ঠানিকতা। পরিবর্তে ছাপানো কার্ড পৌঁছানো হয় লোক মারফত, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। বিশিষ্টদের মাঝে টেলিফোনে, মোবাইলে এবং ই-মেইলে মেজবানের দাওয়াত পাঠানো হয়।

সময়ের সাথে সাথে মেজবানের চরিত্র ও রূপ বদলে যাচ্ছে। সেকালে গ্রামে সম্ভ্রান্ত চৌধুরী, ভুঁইয়া ও মিঞা বাড়ির ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দোয়া পেতে, আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীদের সাথে সম্মিলন ঘটাতে ও সবার সাথে এক বেলা এক সাথে খাওয়ার আনন্দে অংশীদার হতে মেজবান আয়োজন করতেন। মেজবানের আগের দিন পান সলাৎ বা পান সল্লাহ করতেন। বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সর্দার-মাতব্বর এক সাথে বসতেন, মেজবানের সার্বিক দিক নিয়ে আলোচনা করতেন। কী করে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হবে- এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতো। সে অনুযায়ী পরদিন কার্যনির্বাহ করা হতো। কে, কোন দায়িত্ব পালন করবেন, আলোচনা হতো। রান্নার জন্য বিত্তশালীদের বাড়িতে মজুদ থাকত অধিকাংশ সরঞ্জাম- এক মনী, দু’মনী তামার ডেকচি, শামিয়ানা, মেইট্যা বাসন (মাটির তৈরি বাসন), পানি খাওয়ার কত্তি (মাটির তৈরি বদনার মতো), মেইট্যা পেয়ালা বাসন, তরকারির হাওত্যা (মাটির পাত্র), গোশত বেড়ে দেওয়ার জন্য মালা-কান্ডি (নারকোল মালার চামুচ) ও বড় বড় তামার রেকাবি। গোশত ও ভাত নাড়ার জন্য তৈরি করা হতো বাঁশ চেঁছে ‘কাডি’।

 



আমন্ত্রিতদের বসার জন্য থাকে বাঁশের তৈরি ধারা বা চাটাই। কয়েক দফা খাওয়ার পর গোশতের ঝোল পড়ে ধারা বা চাটাইয়ের এমন অবস্থা হয় যে, আর লোক বসার মতো অবস্থা থাকে না। এক সঙ্গে দশ-পনেরটা ডেকচিতে চাল গোশত চুলায় দেয়া হয়। মাটিতে সারিবদ্ধ চুলায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে। মসল্লা তেল ঘি দেয়ার পর ধীরে ধীরে মাংসে ঢুকে যায় ও ঘ্রাণ ভেসে আসতে থাকে। এদিকে ভাত হয়ে গেলে গরম ডেকচি নামানোর জন্য শক্ত বাঁশ দিয়ে বানানো হয় ‘ডেক বারি’। লাম্বা দুটি বাঁশের এক প্রান্ত বাঁধা থাকে শক্ত রশির গিরায়। গরম ভারি ডেকচির কানায় ‘ডেক-বারি’ জুড়ে চেপে ধরে দু’জন লোক অনায়াসে অভ্যস্ত হাতে নামিয়ে আনে বিরাট বিরাট তামার ডেকচি। তারপর ফুটন্ত ভাত বড় বড় বাঁশের টুকরি বা লাইতে ঢেলে ফেন গালা হয়। বাবুর্চিরা গরু জবাই থেকে শুরু করে মেহমানদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো রকম বিশ্রাম নেন না। আগুনের তাপ আর ধোঁয়ায় ক্লান্তিতে চোখ লাল হয়ে ওঠে। রান্না হয় ঝাল গোশ্ত, নলার সুরুয়া (পায়া)। মেহমানদের খাওয়ানোর আগে সুরা ফাতেহা পড়ে মোনাজাত করা হয়। তারপর সর্দার-মাতবর শ্রেণির লোকেরা বিসমিল্লাহ্ বলে মুখে দেন।

মেজবানকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘মেজ্জান’ বলা হয়। নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলে এই মেজবানি ‘জেয়াফত’ নামে বহুল প্রচলিত। এ ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায়ও বিভিন্ন উপলক্ষে ভোজের আয়োজন হয়। তবে মেজবানি চট্টগ্রাম অঞ্চলেই অধিক জনপ্রিয় ভোজ। এই অঞ্চলে ৫০ বছর পূর্বেও পান সালাৎ বা পান সল্লাহ মেজবানির দাওয়াত মহল্লায় মহল্লায় দায়িত্ব দিয়ে লোক মারফত প্রচার করা হতো। সে খবর ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতো এবং নির্দিষ্ট দিন দলে দলে হাজির হয়ে ছেলে-বুড়ো সবাই মেজবানির খাবার খেতেন। আজও চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ঘরে ঘরে বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে মেজবানির দাওয়াত পৌঁছান। মেজবান ও মেজবানি সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। চট্টগ্রামের লোকেরা বিভিন্ন উপলক্ষে ধনী-গরিব সাধ্যমত ভোজের আয়োজন করে থাকেন। মেজবানিতে সাদা ভাতের সঙ্গে তিন বা চার পদ তরকারি পরিবেশিত হয়। মেজ্জাইন্যা গোশতের রান্নার প্রকার যথাক্রমে: মরিচ ও মসলা সহযোগে রান্না করা ঝাল গোশ্ত। গরুর নলা দিয়ে কম ঝাল, মসল্লা-টক সহযোগে রান্না করা শুরুয়া বা কাঁজি, যা ‘নলা কাঁজি’ নামে পরিচিত। মাসকলাই ভেজে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে ঢেঁকিতে বা মেশিনে ডালের গুঁড়ো প্রস্তুত করে এই ডাল রান্না করা হয়। এটাকে ‘ঘুনা ডাল’ বলে। এবং বড় বড় মেজবানে কলই’র ডালের পরিবর্তে বুটের ডালের সাথে হাঁড়-চর্বি ও কম পরিমাণে গোশত দিয়ে হালকা ঝালযুক্ত খাবার। চট্টগ্রাম অঞ্চলে গরু, মহিষ, গয়াল ব্যতীত ছাগল দিয়েও মেজবানি দেওয়া হয়। তবে তা নবজাতকের খৎনা বা আকিকা উপলক্ষে। এ ছাড়া মাছের মেজবানিও হতো সেকালে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ত্রিপুরা, চাকলা রওশনাবাদ ও চট্টগ্রামের (ইসলামাবাদ) উত্তরাঞ্চলের শাসক শমসের গাজী তাঁর মা কৈয়ারা বেগমের নামে দিঘি খনন শেষে আশপাশের দিঘি এমনকি চট্টগ্রামের নিজামপুর অঞ্চলে দিঘি-পুস্করনী থেকে মাছ ধরে এনে মাটিয়ালদের জন্য বিশাল ভোজ দেন। গাজীর জীবনী পাঠ করে জানা যায় ১০ হাজার মাটিয়াল তিন মাস ধরে কাজ করে এই দিঘি (ছাগলনাইয়া উপজেলায় কৈয়ারাদিঘি) খননের কাজ শেষ করেন। এই ১০ হাজার লোককে গাজী মাছ দিয়ে মেজবান খাওয়ান। এই নিয়ে চট্টগ্রামের নওয়াবী শাসনকর্তার সাথে শক্রতা সৃষ্টি হয় এবং যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। শমসের গাজী নিজামপুরসহ কুমিরা পর্যন্ত দখল করেন।

চট্টগ্রামের অনেক স্থান হিন্দু অধ্যুষিত ও প্রভাবিত থাকায় সেকালে গরুর পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে মাছের মেজবান দেওয়া হতো। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় সেখানকার চট্টগ্রাম পরিষদের ব্যানারে মাছ, সবজি ও শুঁটকির তরকারি রান্না করে প্রতিবছর ৮-১০ হাজার লোককে মেজবানি খাওয়ায়। বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের লোকেরা কলকাতায় এসব অনুষ্ঠানে এসে দ্বিধায় পড়তে পারেন চট্টগ্রামেরই কোনো এলাকায় এসে পড়লেন কিনা ভেবে!

চট্টগ্রামের বাইরে মেজবানি সংস্কৃতি প্রবর্তন করেন ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি। ১৯১২ সালে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী বিভিন্ন পেশার চাটগাঁইয়াদের ভাব বিনিময়ের জন্য, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য এবং সুখে-দুখে মিলেমিশে থাকার জন্য সমিতি প্রতিষ্ঠা করে। প্রতি বছরই নানা অনুষ্ঠান উপলক্ষে চাটগাঁর লোকেরা মিলিত হতেন ও গরু জবেহ করে মেজবানি খানার আয়োজন করতেন। সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকে  সমিতি ঢাকায় স্থানান্তরিত হবার পরও। যতদূর জানা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৫ সালে সমিতির সম্পাদক ডা. আনোয়ার হোসেনের বাসায় সমিতি প্রথম মেজবান আয়োজন করে চাটগাঁর এমপি, গভর্নরদের সংবর্ধনা প্রদান উপলক্ষে। তবে ব্যাপক আকারে রাজধানী ঢাকায় মেজবানির প্রচলন শুরু হয় জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা’র সভাপতি (১৯৬৮-৮৩) থাকাকালে। প্রথমে ১৯৭৮ সালে ঢাকা কলেজ মাঠে মেজবান অনুষ্ঠিত হয়। সংসদ ভবনের হোস্টেল মাঠে ও বর্তমানে মোহাম্মদপুরের শারিরীক শিক্ষা কলেজের বিশাল মাঠে মেজবান অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে।

চট্টগ্রামের লোকেরা গরুর মাংস বলেন না, বলেন গোশত। মেজবানির গোশত খুবই সুস্বাদু ও জনপ্রিয়। শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মেজবানি বা মেজবানের খুশবু বহু বছর আগে চট্টগ্রামের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মেজবান ঘিরে চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন অসংখ্য ছড়া-কবিতা, গল্প-প্রবন্ধ। এই ঐতিহ্য চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যিকের কলমের আঁচড়ে সাহিত্যে অঙ্গীভূত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া লিখেছেন :

‘ওরে দেশের ভাই/খুশির সীমা নাই/জলদি আইয়ু সাজিগুজি/মেজবান খাইবার লাই।/বদ্দা আইবো বদ্দি আইবো/মামু জেডা-জেডি/ঢাকার ভিতর চাডিগাইয়াঁ/যত বেডাবেডি, বেয়াগগুনে খুশি হইবা/ইষ্ট কুডুম পাই।/জলদি আইয়ু সাজিগুজি/মেজবান খাইবার লাই।’

 



সাধারণত সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মেজবানি খাওয়ানো হয়। মেজবানের আগের সন্ধ্যার সময় গরু জবাই হয়, সারা রাত ধরে প্রস্তুতি নিয়ে সকাল ৯টার মধ্যে রান্না শেষ হয়। ১০টা থেকে অতিথি খাওয়ানো শুরু হয়। একটানা ৫-৬ ঘণ্টা ধরে চলে বিরামহীন এই মেজবানি খানা। আগের রাতে অনুষ্ঠিত হয় ‘আগ দাওয়াত’ বা আগদঅতী। মূলত পরদিনের মেজবান উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হলো মেজবানের আগের রাতে মেহমান ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক নিয়ে শলা-পরামর্শের জন্য মিলিত হওয়া। চট্টগ্রামের ভাষায় এটা আগদঅতী অনুষ্ঠান। ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলের লোকেরা এই অনুষ্ঠানকে ‘পান সলাৎ’ বলে। মগবাজারের বাবুল বাবুর্চি কয়েক বছর ধরে এই আগদঅতী অনুষ্ঠানের রান্নার দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৫ সালে তিনি এ জন্য ১৭-১৮ আইটেমের খাবার তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়।

চট্টগ্রামী মেজবানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, মুসলমানদের জন্য গরুর গোশতের পাশাপাশি হিন্দু-বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান এবং নন বিফ খাওয়া মেহমানদের জন্য খাসির মাংসের ব্যবস্থা থাকে। এটা শত শত বছর ধরে প্রচলিত এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার অনন্য দৃষ্টান্ত। চট্টগ্রামীরা মেজবানি উপলক্ষে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, শুভাকাঙ্খী, এমনকি প্রতিবেশী অন্য জেলার লোকদেরও আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। পারতপক্ষে কেউ মেজবানি খানা থেকে নিজেদের বিরত রাখেন না। চট্টগ্রাম সমিতির মেজবানির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, ঢাকায় রান্নার বাবুর্চি ও তাদের সহকর্মী-কর্মচারী সকলেই চট্টগ্রামের লোক। এমনকি মরিচ-হলুদ ইত্যাদি মসল্লা চট্টগ্রামের বিশেষ অঞ্চলে উৎপাদিত বিশেষ স্বাদযুক্ত। গোশত কাটা ও মসলার ওপরও রান্নার স্বাদের তারতম্য নির্ভর করে। মেজবানিতে মরিচ গুরুত্বপূর্ণ মসলা। সাধারণত হাটহাজারীর মাদার্শা, ছিপাতলী ও গড়দুয়ারার উৎপন্ন মরিচ ব্যবহৃত হয়। এই মরিচ মেজবানির অপরিহার্য মসলা হিসেবে ভূমিকা রাখছে।

অপরদিকে হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বী ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বড় বড় ভোজ দিয়ে মুসলিম মেহমানদের জন্য ধর্মীয় রীতি মেনে মুরগি-মাছ বা খাসির মাংসের ব্যবস্থা করে। চট্টগ্রামের এই সম্প্রীতি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের বাইরে পশ্চিমবঙ্গ, মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে চট্টগ্রামীরা যেখানেই বসবাস করেন সেখানেই তারা পারস্পরিক সাক্ষাৎ, সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা ও চাটগাঁর ঐতিহ্য রক্ষার জন্য মেজবানির আয়োজন করেন। কলকাতায় চট্টগ্রাম পরিষদের ব্যাপারে ১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছরই ৫-৬ হাজার প্রবাসী চাটগাঁইয়া মেজবানির আয়োজন করেন। তবে সেটা মাছ, বেগুন ভাজি ও ডাল সহযোগে। এছাড়া অন্যন্য দেশে গরু-খাসির মাংস রান্না করা হয়। মেজবানের খাবারের ভালো-মন্দ নির্ভর করে রাঁধুনি বা বাবুর্চির দক্ষতার ওপর। চট্টগ্রামের মেজবানি খানা রান্না করে বাবুর্চিরা খ্যাতি ও অর্থ দুই পেয়েছেন। দু’শ-পাঁচ’শ থেকে শুরু করে লক্ষ মানুষের খাবার রান্না করে এবং বিশেষ সুনাম অর্জন করেছেন এমন বাবুর্চির সংখ্যা খুব কম নয়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়