ঢাকার যত গঞ্জ
বরুণ দাস || রাইজিংবিডি.কম
বরুণ দাস: ঢাকা নগরীর রাস্তাঘাটের নামগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ। নামের শেষে কোনোটিতে পুর, কোনোটিতে পুরা, কোনোটিতে নগর বা গঞ্জ; আবার কোনোটির শেষে টুলি বা টোলা, কোনোটিতে বাগ-বাগান বা বাগিচা, কোনোটিতে পুল বা বাড়ি যুক্ত রয়েছে। ঢাকার অনেক পুরাতন মহল্লা ‘গঞ্জ’ নামে পরিচিত। সাধারণভাবে গঞ্জ অর্থ বাজার বা বিপণি কেন্দ্র। সেই অর্থে হাট-বাজার-গঞ্জ অনেকটা একই ধরনের। ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহল্লায় বিভিন্ন সময়ে গঞ্জ গড়ে ওঠে। ঢাকা ও এর আশেপাশে কমপক্ষে বিশটিরও বেশি স্থানের নাম রয়েছে যার শেষে ‘গঞ্জ’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। যেমন- আলমগঞ্জ, ফরাশগঞ্জ, এনায়েতগঞ্জ, করিমগঞ্জ, ইমামগঞ্জ।
আলমগঞ্জ: ঢাকা মহানগরীর সবচেয়ে পুরনো স্থান হিসেবে পরিচিত মিলব্যারাক-এর কাছে একটি স্থানের নাম ‘আলমগঞ্জ’। অবলুপ্ত ধোলাই খালের পূর্ব প্রান্তে বর্তমান পোস্তগোলা-জুরাইন অঞ্চলে আলম মার্কেট নামে একটি বিপণি বিতান দেখা যায়। এটি আলমগঞ্জ নামে পরিচিত। নামের উৎস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একটি মতে, মোগল বাদশাহ আলমগীরের নামানুসারে এর নাম আলমগঞ্জ হয়েছে। অন্যমতে, মহল্লাটি প্রাক-মোগল আমলে গড়ে উঠলেও আলমগঞ্জ নামটি মোগলদের শাসনামলে স্বীকৃতি পায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের আগেই মিলব্যারাকে বেগ মুরাদ খাঁ কেল্লা নামে একটি দুর্গ ছিল। এটি সুলতানি শাসনামলের তৈরি সেনানিবাস। মোগল শক্তি এই কেল্লা থেকে যথেষ্ট প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছিল। যাইহোক, এক সময় কেল্লাটি সুবেদার ইসলাম খাঁর হস্তগত হয়। এরপরের ইতিহাস মোগলদের দীর্ঘ শাসনের ইতিহাস। অনুসন্ধানে এর নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার যুদ্ধের শেষে শাহজাদা আলমগীর জয়ী হন। তিনি আওরঙ্গজেব নামধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিজয়কে স্মরণ করে সুবা বাংলার মোগল কর্মচারীরা মিলব্যারাক বা কেল্লার পাশাপাশি স্থানটির নাম রাখেন আলমগঞ্জ। ধারণা করা হয়, এখানে একসময় বড় ধরনের ব্যবসা কেন্দ্র বা গঞ্জ-এর অবস্থান ছিল। আলমগঞ্জ রোড এবং আলমগঞ্জ লেন নামে এখানে দুটি রাস্তা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন নাকরণ করা হলেও সবাই একে আলমগঞ্জ নামেই এক নামে চেনেন। আবাসিক এলাকার পাশাপাশি বর্তমানে এখানে অনেক ক্ষুদ্র কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সময়ের গর্ভে জায়গাটির জৌলুস হারিয়ে গেলেও আলমগঞ্জ সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের স্মৃতি বহন করে চলেছে।
ইমামগঞ্জ: পুরনো ঢাকার মিটফোর্ড-এর কাছে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পাশে মোগল আমলের শেষভাগে প্রতিষ্ঠিত একটি গঞ্জ বা বাজারের নাম ইমামগঞ্জ। ঢাকার বেশিরভাগ নাবাব এবং নায়েব সুবেদার ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের। শিয়া মুসলমানেরা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)-এর দুই পুত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনর অনুসারী ছিলেন। এই অনুসারীরা উক্ত ইমামদ্বয়কে উচ্চমর্যাদা দিয়ে থাকেন। ফলে তারা বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই মহরম অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। একসময় ঢাকার নায়েব নাজিমরা নবাব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন; যার মধ্যে প্রথম নবাব ছিলেন জিসারাত খাঁ। তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের ইবাদতখানা হোসেনি দালানের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর উত্তরাধিকার নবাব নুসরত জং শিয়াদের পরম শ্রদ্ধেয় ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের স্মরণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন যার নামকরণ করা হয় ইমামগঞ্জ।
একটি চিঠি থেকে জানা যায়, এই গঞ্জের আয় দিয়ে নির্বাহ করা হতো সেই সময়কার ঢাকার বৃহত্তম মুসলিম পর্ব মহরমের যাবতীয় খরচ। ব্রিটিশ আমলে এখানে নানা ধরনের রশি, মাদুর, শীতলপাটি, তামা-কাঁসার ব্যবসা ছিল। তবে পরর্তীকালে এখানে রং-বার্ণিশ ও তেলের আড়ৎ গড়ে ওঠে। অতীতের মতো বর্তমানেও ইমামগঞ্জ এলাকাটি মূলত একটি ব্যবসাপ্রধান স্থান। কত যুগ আগে ঢাকার বনেদি নবাবেরা মারা গেছেন, অনেক ঢাকাবাসীর কাছেই তারা বিশ্রুত ইতিহাস। তবে তাদের প্রতিষ্ঠিত ইমামগঞ্জ এখনো রয়েছে।
ফরাশগঞ্জ: সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফরাসিরা সর্বপ্রথম ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে সুরক্ষিত বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৬৯০ সালে তারা চন্দন নগরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে এবং ১৭১৯ সালে ব্যবসা করার অনুমতি লাভ করে। তখন ফরাসি বণিকেরা পারস্যে চাল, চিনি এবং কাপড় রপ্তানি করতো। এর আগে যদিও ফরাসি বণিক দেসলান্দেস ঢাকা থেকে পণ্য ক্রয় করতেন এবং ঢাকায় বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন; কিন্তু তখন ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হবার কারণে সেটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ঢাকায় ফরাসি বসতির প্রথম সূত্রপাত হয় মূলত ১৭৫০ সালের দিকে ইংরেজ মালিকানাধীন একটি কারখানা দখলের মাধ্যমে। তখন তারা ঢাকা থেকে পাঠাতো নামকরা মসলিন কাপড়, রুমাল এবং মোটা কাপড়।
বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে গড়ে ওঠা ফরাসি বণিকদের স্মৃতিবিজড়িত এলাকাটির নাম ফরাশগঞ্জ। পুরানো ঢাকার সূত্রাপুর থেকে যে রাস্তাটি বাম দিক দিয়ে নর্থব্রুক হলের দিকে চলে গেছে তার গোড়াতেই ফরাশগঞ্জ-এর অবস্থান। ঢাকার তৎকালীন নিমতলী কুঠির নায়েবে নাজিম বা উপ-নবাব নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের অনুমতি নিয়ে ১৭৮০ সালে ফরাসিরা একটি গঞ্জ বা বাজার প্রতিষ্ঠা করে। নামকরণ করা হয় ফ্রেন্সগঞ্জ।
ফরাসি বণিকরা তখন এখানে কাঁচা হলুদ, আদা, রসুন ও মরিচের পাইকারি আড়ৎ গড়ে তোলে। তবে সাধারণ মানুষ এটিকে প্রথম বলতো ‘ফরাসিগঞ্জ’ এবং একসময় এটি লোকমুখে ফরাশগঞ্জ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ১৭৮৪ সাল নাগাদ ঢাকার ফরাসি কুঠি উঠে গেলে এই এলাকায় ফরাসি আধিপত্য কমে যায়। একসময় ইংরেজ শাসনেরও অবসান হলে তারাও ফিরে যায়; কিন্তু অনেক স্মৃতিবিজড়িত ফরাশগঞ্জ আজো রয়ে গেছে। এই এলাকায় বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। তার মধ্যে নদীর তীর ঘেঁষে নির্মিত রূপলাল হাউজ, ফরাশগঞ্জ মহল্লার দীর্ঘ প্রবেশদ্বার এবং নীলকুঠি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উলটিগঞ্জ: ফরাশগঞ্জের কাছে বিবিকা রওজার সন্নিকটে নদী তীরবর্তী একটি এলাকার নাম উলটিগঞ্জ। অনেক আগে এটি ‘শ্মশানঘাট’ নামে পরিচিত ছিল। পরে অবশ্য শ্মশান সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পোস্তগোলায়। এই শ্মশান তথা ডোম ঘাট এলাকাটি ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ পদস্থ অফিসার মি. উলটিন সাহেবের নামানুসার উলটিগঞ্জ হয়। তিনি এখানে একটি বাজার স্থাপন করেছিলেন বলে বাজারটি তাঁরই নামানুসারে হলেও নামটি খানিকটা বিকৃত হয়ে অর্থাৎ উলটিন নামের স্থলে উলটিগঞ্জ হয়ে যায়। এবং এই নামে পৌরসভার নথিতে নামটি রেকর্ডভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে বাজারটি অপসারিত হয়ে এখানে কাঠ ব্যবসায়ীদের বাজার স্থাপিত হয়।
এনায়েতগঞ্জ: ঢাকার লালবাগ থানার অন্তর্গত সিটি কর্পোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত একটি প্রাচীন এলাকার নাম এনায়েতগঞ্জ। এর পাশের সড়কটির নাম এনায়েতগঞ্জ রোড। ধারণা করা হয়, একসময় এখানে একটি বাজার বা ব্যবসার প্রধান এলাকা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর ঢাকার একটি মানচিত্রে দেখা যায়, নবাবগঞ্জ ও পিলখানার সীমানা বরাবর ছিল এনায়েতগঞ্জের অবস্থান। তবে নামকরণ নিয়ে দুটি মতবাদ পাওয়া যায়। একটি মতবাদ অনুসারে, মোগল আমলে ঢাকার শুল্ক বিভাগের প্রধান খাজা এনায়েত উল্লাহর প্রধান দপ্তর ছিল এখানে। এই জায়গায় তিনি একসময় একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করে তার নামকরণ করেন এনায়েতগঞ্জ। অবশ্য এর স্বপক্ষে তেমন কোনো যুক্তি বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্য একটি মতানুসারে, জামালপুর পরগণার জমিদার শেখ এনায়েতউল্লাহর নামে এই এলাকার নামকরণ হয় এনায়েতগঞ্জ।
কমিটিগঞ্জ: আঠারো শতকের শেষদিক পর্যন্ত ঢাকায় কমপক্ষে ছয়টি বাজারের মধ্যে একটি করে সরকারি বাজারের প্রচলন ছিল। ঐ বাজারটি ছিল পৌর পরিচালিত। ঢাকা পৌরসভার একটি বাজারের জন্য নির্দিষ্ট যে জায়গা ছিল তা ‘কমিটিগঞ্জ’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯২১ সালে গোপীনাথ দত্ত কবিরাজ কমিটিগঞ্জের একাংশের বিজলী বাতি সম্প্রসারণের জন্য ঢাকা পৌরসভাকে পাঁচশ টাকা দান করেন। এ কারণে কমিটিগঞ্জের বিরাট একটি এলাকার নাম বদলে ‘গোপীনাথ কবিরাজ লেন’ রাখা হয়।
আমীরগঞ্জ: কালের গর্ভে কতকিছুই যে হারিয়ে যায়! যেমন- লালবাগ দুর্গের পশ্চিমে আমলী গোলা নামে একটি মহল্লা ছিল। এখন এই নামে পরিচিত হলেও এলাকাটি ছিল মূলত আমীরগোলা বা ‘গোলাহ আমীরগঞ্জ’ নামে। ১৭৬০ সালের একটি ট্যাক্স কালেকশন নথিতে এই এলাকার নাম ‘গোলাহ আমীরগঞ্জ’ বলে উল্লেখ রয়েছে। মোগল আমলে এখানে রাজ্যের আমীর-ওমরাহগণ বাস করতেন। সুবেদারের দুর্গ প্রাসাদ কাছাকাছি অবস্থিত ছিল বলে এখানে গড়ে উঠেছিল মহল, বিশালাকার ইমারত আর দালান-কোঠা। এ অঞ্চলে যারা বাস করতেন তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, ধনদৌলতের কমতি ছিল না। সব দিক দিয়েই এই অঞ্চল ছিল সমৃদ্ধশালী। তবে যখন ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করা হলো তখনই এই অঞ্চলে নেমে আসে কালো মেঘের ঘটা। একে একে আমীর-ওমরাহগণ পাড়ি জমান মুর্শিদাবাদের দিকে। ফলে এই শূন্যস্থানগুলো পূরণ হতে থাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা হিন্দু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হলে নতুন পড়শিরা এর নামকরণ করেন স্থানীয় একটি প্রাচীন আমলী মানে তেঁতুল গাছের নামানুসারে আমলীগোলা।
নবাবগঞ্জ: মোগল আমলে যে এলাকাটিতে নবাব পরিবার, আমীর-ওমরাহ, পদস্থ রাজ কর্মচারী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বসবাস ছিল সেই এলাকাটি আজকের ‘নবাবগঞ্জ’ নামে পরিচিত। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত একটি প্রাচীন এলাকা এই নবাবগঞ্জ। অবশ্য একটা সময় এটি ‘নবাববাগিচা’ নামেই বেশি পরিচিত ছিল, কারণ এখানে নবাব রশীদ খাঁ একটি বড় বাগ বা বাগান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৫৯ সালের ঢাকার মানচিত্রে বাগে হোসাইন উদ্দিন খান বলে এটির উল্লেখ পাওয়া যায়। নবাবী আমলেই এ এলাকায় সদর রাস্তার ধার থেকে নদীর তীর পর্যন্ত একটি অংশে বাজার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় বাজারটি নবাবগঞ্জ নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে এই এলাকায় ছোট ও মাঝারি রকমারি কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এটি ঢাকার অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত।
রহমতগঞ্জ: নবাব শায়েস্তা খাঁ-র আমলে রহমত উল্লাহ ওরফে রহমত খাঁ ছিলেন বেতন বণ্টনকারী রাজকর্মচারী। কিছুকাল তিনি বাংলার অস্থায়ী সুবেদারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ঢাকার উন্নয়নে ছিলেন বেশ উৎসাহী এবং এখানে একটি গঞ্জ স্থাপন করা হলে তার অবদানের কথা মাথায় রেখে সেটির নাম রাখা হয় ‘রহমতগঞ্জ’। অবশ্য এই অঞ্চলটির পূর্ব নাম ছিল বাগে মীর মোমেনা। তখন এই এলাকায় অনেক ইরানী মানুষের বাস ছিল।
ঢাকার কাঁসারহাট এলাকায় ছিল রহমত খাঁনের নওয়ারি প্রাসাদ; যদিও এখন সেই প্রাসাদের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে অক্ষয় হয়ে আছে রহমতগঞ্জের মধ্য দিয়ে রহমত খাঁনের নাম। এই এলাকায় একসময় কুস্তি ও লাঠি খেলার বেশ চর্চা ছিল। এখানে একটি বিশাল ফুটবল মাঠ রয়েছে যার নাম রহমতগঞ্জ ফুটবল মাঠ।
দোলাইগঞ্জ: মোগল শাসনামলের আগে আমাদের এই ঢাকা নগরী এখনকার মতো সমতল ছিল না। জায়গায় জায়গায় নালা, ডোবা এবং ঝিলের মতো ছিল। এসব জায়গায় বর্ষার পানি কমে এলে মশা-মাছি আর পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যেত। ফলে তখনকার ঢাকায় কলেরা-বসন্ত, ডায়েরিয়া লেগেই থাকতো। পরিবহণ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন সাধন কল্পে ঢাকার প্রথম সুবেদার ইসলাম খাঁন, বুড়িগঙ্গা থেকে একটি কৃত্রিম খাল খনন করান। শুরুতে এর উৎপত্তিস্থল ছিল বাবুবাজারের পাকুড়তলিতে। খালটি জিন্দাবাহার, গোয়ালনগর, নবাবপুর, নারিন্দা, জালুয়ানগর, সরাফতগঞ্জ হয়ে সূত্রাপুরের লোহার পুলের নিচ দিয়ে আবারো বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মিশতো। এই খালটি ঔপনিবেশিক আমলে দুইবার ১৮৬৪ এবং ১৮৬৫ সালে পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয়েছিল। এই খাল খননের ফলে মাল আদান-প্রদানে শহরবাসী যেমন উপকৃত হয়েছিল, পাশাপাশি শহরের ময়লা পানি নিষ্কাশনের ব্যাপারেও যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দোলাই খাল ছিল বেশ বড় একটি খাল। দোলাই খালের নামানুসারে একটি এলাকায় খালের পূর্বপাড়ে যেখানে নানারকম জিনিসপত্র বেচাকেনা করা হতো তা ‘দোলাইগঞ্জ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
সরাফতগঞ্জ: অনেকের কাছে এখন শুনতে অবাক মনে হলেও এটি সত্যি যে, ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকা একসময় আখক্ষেত দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। তবে এর পাশের এলাকায় লোকবসতি ছিল। ঐ এলাকায় সরাফতউল্লাহ নামে একজন বিত্তশালী মানুষের বাস ছিল, যিনি ওখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন থেকেই এলাকাটি ‘সরাফতগঞ্জ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। অনেক আগেই বাজারটি বিলুপ্ত হলেও ঢাকা পৌর কর্তৃপক্ষের রেকর্ডপত্রে এটি সরাফতগঞ্জ নামে নথিভুক্ত রয়েছে। সরাফতগঞ্জে সরাফত লেন নামে এটি রাস্তা রয়েছে। বর্তমানে এটি একটি জনবহুল স্থান। সরাফতগঞ্জসংলগ্ন অন্যান্য স্থানগুলো হচ্ছে- ডিস্টিলারি রোড, দীননাথ সেন রোড, কেশব ব্যানার্জী রোড, রজনী চৌধুরী রোড।
গোবিন্দগঞ্জ: গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা থেকে এঁকেবেঁকে যে রাস্তাটি জয়কালী মন্দিরের দিকে চলে গেছে তার আদি নাম ছিল ‘গোবিন্দগঞ্জ’। তবে সবার কাছে সেটি ‘দয়াগঞ্জ’ নামেই বেশি পরিচিত। অধ্যাপক আব্দুল করিমের মতে, ১৭৬৫ সালের আগে দেওয়ান মানিকচাঁদ তার পুত্র দায়ীচাঁদ বা দয়াচাঁদের নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করে নাম দেন দয়াগঞ্জ। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে দয়াচাঁদ এর মালিক হলেও সরকারি পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হবার কারণে গঞ্জটি নিলামে কিনে নেন জনৈক ভিখন লাল ঠাকুর। এরপর বেশ কিছুকাল পর্যন্ত বাজারটি ভিখন ঠাকুরের বাজার নামে পরিচিত করার চেষ্টা করা হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা দয়াগঞ্জ নামেই পরিচিত। ১৮৬৪ সালে এলাকাটি পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খাল পরিবেষ্টিত দয়াগঞ্জ দীর্ঘকাল অনুন্নত ও পৌর সুবিধাবঞ্চিত ছিল। পরবর্তী সময়ে খাল ভরাট হলে এটি এক সময় দক্ষিণ যাত্রাবাড়ির সঙ্গে মিশেছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ এপ্রিল ২০১৯/তারা
রাইজিংবিডি.কম