ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সদরঘাটের মাঝির নৌকা চলে, জীবন চলে না

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৮, ১ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সদরঘাটের মাঝির নৌকা চলে, জীবন চলে না

জাহিদ সাদেক : ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের মাধ্যমে মৎসজীবীদের দুঃখ আমাদের সকলের জানা। কিন্তু রাজধানী ঢাকা তথা দেশের অন্যতম নদীবন্দর সদরঘাটের মাঝির দুঃখের খবর আমরা ক’জন জানি? আমরা জানি না কীভাবে জীবনযাপন করেন তারা! তাদের অনেকের জীবনের গল্প ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের কুবেরের গল্পকেও হার মানাবে। অথচ সবারই কৈশোর আর যৌবনের লালিত স্বপ্ন ছিল- একদিন সুখের দিন আসবে। কিন্তু দিন ফুরিয়ে জীবন সায়াহ্নে অনেকেই পান না সুখ নামের সোনার হরিনের দেখা।

পুরান ঢাকার সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, বাদামতলীর ঘাট, শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন ঘাটে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন প্রায় হাজার দুয়েক মাঝি। জীবিকার তাগিদে ভোরের আলো জেগে ওঠার আগেই মাঝিরা বুড়িগঙ্গার বুকে ভাসিয়ে দেন নৌকা। তবে দিনদিন তাদের উপার্জন কমছে। মুখে নেই হাসি, কণ্ঠে হতাশার সুর! তারপরও বুড়িগঙ্গার বুকে নৌকা চালিয়ে এখনো বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন তারা। ইজারাদারের টাকা, মালিকের টাকা, পাহারা ও সিরিয়ালের টাকা-সব দাবি মিটিয়ে যা থাকে, তা দিয়ে বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে নৌকা চলে তো জীবন চলে না।

 

সদরঘাটে প্রায় ৪০ বছর ধরে খেয়া পারাপার করেন মজিদ আলী। আলাপের শুরুতেই অনেকটা আবেগ মাখা কণ্ঠে বললেন, ‘নদীই ফকির করেছে আর এই নদীই বাঁচিয়ে রেখেছে।’ পরে তিনি জানালেন, তার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের জাজিরায়। ছোটবেলায় সব জমি গেছে পদ্মার পেটে। সেই থেকে সদরঘাটের মাঝি। এখন সারাদিন খেয়া পারাপার করে রাতে পরিবার নিয়ে থাকেন কেরানীগঞ্জের খেজুরবাগ এলাকায়। তিন ছেলে থাকলেও কেউ এখন খবর নেন না। তাই এই বয়সেও বাইতে হচ্ছে জীবনের ঘানি। ঘরে থাকে আরেকটি জীব। সে তার স্ত্রী। এই দুজনের সংসার চলে যায় তার একার উপাজর্নে।

কথা হয় মাঝি সাবের মিয়ার সাথে। তিনি সদরঘাটে নৌকায় যাত্রী পারাপার করেন ২০ বছর। সাবের মিয়া কথা বলার সময় হঠাৎ নৌকা নিয়ে দিলেন ছুট। কারণ পাড় থেকে যাত্রীরা ডাকছে। কথা বলার সময় কোথায়? পাশের তরুণ মাঝিটিও একইভাবে পাল্লা দিয়ে নৌকা ভাসালেন যাত্রীর ডাকে। এভাবেই কেটে যায় তাদের দিন।  যাত্রী না পেলে হয়তো মিলবে না একবেলা খাবার। সদরঘাটের আরেক মাঝি বকশ সরদারের সাথে আলাপকালে তিনি জানালেন, পাঁচ সন্তানের বাবা তিনি। তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় ছেলেটি উচ্চমাধ্যমিক পাস। তিন মেয়েকে সপ্তম অষ্টম পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলেটি পড়ালেখা করেনি। জানালেন, ‘ট্যাকা জমাইছিলাম। তিন মাইয়ারে বিয়া দিয়া হাত খালি। দ্যাশের বাড়ি শরীয়তপুরে জায়গাজমি আছে। কিছু ট্যাকা হইলে দ্যাশে যামুগা।’ বুড়িগঙ্গার দূষণ নিয়ে তার অভিযোগ- টাকা পয়সা যার বেশি সেই বেশি ক্ষতি করছে এই বুড়িগঙ্গার। আমরা যারা নৌকা চালিয়ে পেট চালাই বুড়িগঙ্গা না বাচঁলে আমরাও  বাচঁবো না।

সদরঘাটে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে যুবক প্রায় হাজার দুয়েক মাঝি প্রতিদিন খেয়া পারাপার করেন বলে জানালেন ইজারাদারের প্রতিনিধি। এই পারাপার দুই ধরনের। কিছু মাঝি যাত্রীদের দূরে নোঙর করা লঞ্চ ধরিয়ে দেন আর কিছু কেরানীগঞ্জ ঘাটে যাত্রী পারাপার করেন। বেশির ভাগ মাঝি অন্যের নৌকা ভাড়া চালান। সদরঘাটে ৪০ বছর ধরে যাত্রী পারাপার করছেন সহিদুল মাঝি। তিনি বলেন, তহন শেখ সাহেব বাঁইচা আছলো। একজন পার হতে ১০ পয়সা লাগত। তখন থেকে এখন পর্যন্ত এই ঘাটেই আছি। এখন একজন পার হতে ৫ টাকা। আর রিজার্ভ নিলে ২০ টাকা।

 

এখন কেমন দিন যাচ্ছে? জানতে চাইলে সহিদুল মাঝি বলেন, ‘নৌকা ভাড়া ৭৫ টাকা। ঘাটের ইজারাদারের ভাড়া ৮৫ টাকা। রাইতে নৌকা পাহারা ১০ টাকা। সিরিয়াল বাবদ ৫ টাকা। প্রতিদিন খাবারের পেছনে ২০০ টাকা খরচ। সব বাদ দিয়ে প্রতিদিন ৪০০ টাকা থাকে।’

দুইভাবে যাত্রী পারাপার করেন এসব ঘাটের মাঝিরা। দলগতভাবে ৮-১০ জন যাত্রী নিয়ে যেসব নৌকা যাত্রী পারাপার করে তারা প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে ২-৫ টাকা ভাড়া নেন। আর এককভাবে যে যাত্রী নৌকায় পার হয় তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ২০-২৫ টাকা। যে প্রমত্তা বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ঢাকা নগরী, চিরচেনা সেই বুড়িগঙ্গা আজ তার যৌবন-জৌলুস সবকিছুই হারিয়েছে কিছু প্রভাবশালী মানুষের লোভের কারণে। তারা দখল করেছে এই নদীর দুই তীর। নদী তীরে গড়ে তুলেছে কল-কারখানা। আর এসব কল-কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলে দূষণ করছে নদীর পানি। তারপরও বুড়িগঙ্গার বুকে নৌকা চালিয়ে এখনো বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন অনেক মানুষ।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়