ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত তরী এখন সস্তা হোটেল

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ৭ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত তরী এখন সস্তা হোটেল

জাহিদ সাদেক : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা এসেছিলেন দু’বার। দু’বারই তিনি অতিথি হিসেবে রাত কাটিয়েছেন নবাবদের প্রমোদতরীতে। কালের বিবর্তনে প্রমোদতরী হারিয়েছে আবেদন। তবে সেগুলোর আদলে তৈরি হয়েছে ভাসমান নৌকা। বুড়িগঙ্গার ধারে স্বগর্বে এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে সেই নৌকা। কিন্তু প্রমোদতরী হিসেবে নয়, সস্তা হোটেল হিসেবে।

রবীন্দ্রনাথের ঢাকা ভ্রমণের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ভাগ্যকুলের জমিদার ও ঢাকার নবাবদের একাধিক তরী বুড়িগঙ্গায় ভাসমান থাকত। এসব প্রমোদতরী রাষ্ট্রীয় সফরে ব্যবহার করা হতো। এর মধ্যে কবিগুরু ১৮৯৮ সালে ঢাকায় এসে কুণ্ডুদের প্রমোদতরী এবং ১৯২৬ সালে নবাবদের হাউস বোট ব্যবহার করেছিলেন। তাছাড়া ব্রিটিশদের ব্যবহৃত প্রমোদতরীও পাগলা ঘাটে ভাসমান হোটেল হিসেবে একসময় ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬০৮ সালে, মতান্তরে ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করে সুবেদার খাঁ চিশতীকে সেখানে পাঠান। চাঁদনী নামে এক বড় নৌকায় তিনি দলবলসহ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নামেন। সেই স্থানটি পরে ‘ইসলামপুর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর যেখানে চাঁদনী রাখা হতো, সেখানকার নামকরণ হয় ‘চাঁদনী ঘাট’। এখনও চাঁদনী ঘাট রয়ে গেছে কিন্তু সেখানে কোনো প্রমোদতরী দেখা যায় না। তবে প্রমোদতরীর আদলে তৈরি করা হয়েছে নৌকা। যেগুলো এই গ্রহের সবচেয়ে সস্তা হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে- একথা বলাই যায়। 

পুরাতন নৌকা দিয়ে বানানো ‘ফরিদপুর মুসলিম হোটেল’র অবস্থান বুড়িগঙ্গায়। যতদূর জানা যায়, এর যাত্রা শুরু ১৯৬৮ সালে। সত্তর দশকে ভাসমান হোটেলগুলো বেশ জমজমাট ছিল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা হিন্দু ব্যবসায়ীদের অনেকে রাতে থাকার জন্য বেছে নিতেন এই ভাসমান নৌকা। তাদের অনেকেই শহরের ভেতরে মুসলিম হোটেলে খেতেন না, রাত্রিযাপনও করতেন না। ফলে হিন্দু ব্যবসায়ীরা কাঠের তৈরি নৌযানকে কাজে লাগিয়ে ভাসমান হোটেল তৈরি করেন। স্বাধীনতার পর তা মুসলমান ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়। এগুলোই দেশের প্রথম ভাসমান হোটেল। হোটেলগুলোতে শুরু থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ২০০২ সাল থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই হোটেলে মানুষের রাত্রিযাপন এখনও বন্ধ হয়নি।

ম্যানেজার গোলাম মোস্তফা মিয়া প্রায় ৩৫ বছর ধরে ‘ফরিদপুর মুসলিম হোটেল’ তদারকি করছেন। তিনি জানালেন হোটেলের আদ্যোপান্ত। অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে হলেও শ্রমজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং শহরের আগন্তুকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এসব হোটেল। এত অল্প টাকায় রাত্রি যাপনের আর ভালো কোনো সুযোগ তাদের সামনে নেই। হোটেলে রয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষ। গোলাম মোস্তফার কথায় জানা গেল, ঈদ, পূজায়ও এই হোটেল বন্ধ হয় না। তিনি গত ৩৫ বছরে মাত্র ৭টি ঈদ উদযাপন করেছেন গ্রামের বাড়ি গিয়ে। ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে থাকে পরিবার। মা-বাবা, এক ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। মোস্তফা বলেন, ‘বছরে দু-একবার যাওয়া হয়। গিয়ে কি করবো, আমার পরিবার তো চলে এই হোটেলের টাকায়।’

 

ফরিদপুর মুসলিম হোটেল ছাড়াও এই জায়গায় আরো ৫টি ভাসমান হোটেল রয়েছে। বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং, শরীয়তপুর বোর্ডিং, উজালা বোর্ডিং এবং বাকি দুটোর কোনো নাম নেই! প্রতিটিতে রয়েছে ৩০ থেকে ৫০টির মতো কেবিন। প্রতিটি কেবিনে রয়েছে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। আছে লাইট ও ফ্যান। রয়েছে রাতযাপনের আনুষাঙ্গিক বেডিংপত্র। যদিও এগুলো তেমন মানসম্মত নয়। তবুও এ ব্যবস্থাটুকুই এখানে রাতযাপনকারী শ্রমিকদের কাছে অনেক বড় পাওয়া।

একসঙ্গে প্রায় ৪০ জনের মতো অতিথি রুম ভেদে ৫০ থেকে ১৫০ টাকার বিনিময়ে থাকতে পারেন এই হোটেলে। আবার এমন অনেকেই আছেন, যারা একটানা তিনমাসেরও অধিক সময় এসব হোটেলে থাকেন। যারা একটু বেশি ব্যক্তি স্বাধীনতা চান তাদের জন্য রয়েছে কেবিন। কেবিনে রাত কাটানোর জন্য গুনতে হয় ১৫০ টাকা। কথা হলো মানিক মিয়ার সঙ্গে। তিনি বরিশাল থেকে এসেছেন। তিনি নিজেই জানালেন, গত রমজানের ঈদের পর থেকে এই হোটেলে থাকছেন। সদরঘাটের কুলির কাজ করেন। কম টাকায় নিরাপদে থাকতে পেরে তিনি খুশি। ভাসমান হোটেলে এমন মানুষও পাওয়া যায় যারা প্রায় ২০ বছর ধরে এভাবেই বাস করছেন। অনেকদিন ধরে থাকায় মায়া জন্মেছে মনে। ফরিদপুর মুসলিম হোটেলে গিয়ে পাওয়া গেল এক বৃদ্ধকে। তিনি প্রায় ৪৫ বছর ধরে আছেন। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার পালং থানার বিনোদপুর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন। কিন্তু কোনো কাজ না পেয়ে সদরঘাট টার্মিনালে পান, বিড়ি, সিগারেট বিক্রি শুরু করেন। তারপর থেকেই এই হোটেলের নিয়মিত বাসিন্দা।

হোটেলে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এসব হোটেলে মালামাল রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে যেসব লোক দিনে হকারি করেন তারা রাতে মালামাল রেখে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন। শীত মৌসুম, ঈদ ও পূজায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদীপথে অনেক ব্যবসায়ী ঢাকা আসেন। তখন সব রুম ভাড়া হয়ে যায়। তবে এসব হোটেলে ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, ফল ব্যবসায়ীরাই বেশি থাকেন।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়