ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যে দ্বীপে বিয়ে-তালাক পুতুল খেলা!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৯ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যে দ্বীপে বিয়ে-তালাক পুতুল খেলা!

রফিকুল ইসলাম মন্টু: দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল। চারিদিকে কুকুরদলের ঘেউ ঘেউ শব্দ। আর কী ঘুমানো যায়! চারিদিকে অন্ধকার। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো মেঘনার বুকে জেগে থাকা দ্বীপ মদনপুর। যার চারিদিকে থই থই পানি, আর মাঝখানে কিছু মানুষের বিপন্ন বসবাস।

ভোরে কুকুরদলের ঝগড়ায় ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরই ওদের দ্বীপে আসার গল্পটা মনে পড়ে গেল। তরতাজা গল্প। লুতু পাটোয়ারী, দ্বীপে যার বাড়িতে আছি, তার মুখেই শুনছিলাম কুকুর-বিড়াল আসার কাহিনি। এ দ্বীপে প্রথমদিকে যেসব মানুষজন এসেছেন- এদের মধ্যে লুতু পাটোয়ারী একজন। জনবসতি স্থাপনের অনেক সমস্যা সমাধান করেছেন তিনি। কিছু বসতি স্থাপনের পর দেখা গেল এখানে কুকুর বিড়াল নেই। ফলে অনেক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। অতি প্রয়োজনীয় এই প্রাণী দুটোর তাগিদ তখন বুঝতে পারেন দ্বীপের মানুষ। দামসহ নৌকা ভাড়া দিয়ে এখানে কুকুর বিড়াল আনা হয়েছে। লুতু পাটোয়ারীর কাছে পাওয়া গেছে এমন আরও অনেক গল্প। সেগুলো আমরা অন্য কোনো পর্বে বলতে পারবো।

দ্বীপে থাকলে সূর্যোদয়ের দৃশ্যটা আমাকে দেখতে হবে। এখানেও তাই। সূর্য ওঠার আগেই আমি তৈরি, আমার ক্যামেরা তৈরি। আগের রাতেই ঠিক হয়েছে দ্বীপের বাসিন্দা আবদুল খালেক মাঝি আমাকে এলাকা ঘুরিয়ে দেখাবেন। তার আসতে আরও দেরি। আমি বের হই। পুব আকাশে লাল আভা। সূর্যটা হয়তো এখনই উঠবে। অপেক্ষা। আরও অপেক্ষা। না, মেঘে ঢেকে আছে পুবের আকাশ। ক’দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ফসলি মাঠের মাটি ভেজা। সূর্যের ছবি তুলতে না পারার কষ্ট নিয়েই আমি চারিদিকে তাকাই। নড়বড়ে এক সাঁকো দিয়ে এগোই তিন নম্বর ওয়ার্ডের দিকে। আমার মনে পড়ছে, দ্বীপে একবার জোয়ারের সময় এসে এই সাঁকোটির দু’টো বাঁশের মাথা দেখা যাচ্ছিল। ফসলি মাঠ, বাড়িঘর, সব ডুবেছিল পানিতে। কোথায় খাল, কোথায় ক্ষেত খামার, তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। সেদিনের সেই ডুবন্ত স্থান দিয়ে হাঁটছি আজ।

সাঁকো পার হয়ে সামনে এগোই। মাঠ ফাঁকা। সয়াবিন উঠে গেছে। কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে সয়াবিনের মাড়াইয়ের অপেক্ষায় স্তূপ সয়াবিনের আঁটি। কিছু ক্ষেতে এখনও মরিচ। লাল সবুজ মরিচগুলো ভোরের মৃদু বাতাসে দুলছে। কিছু স্থানে ধনচে ক্ষেত। কিছু ধনচে আবার কাটাও হয়েছে। জোয়ারে ডুবে থাকা মদনপুর আর শুকনো সময়ের মদনপুরে বিস্তর ফারাক। মাঠের মাঝখানে সরু মাটির রাস্তার দিয়ে হাঁটছি আর কথাগুলো ভাবছি। কিছুদূর এগোতেই আবদুল খালেক মাঝির সঙ্গে দেখা। পাশেই তার বাড়ি। এই সময়েই তার বের হওয়ার কথা। আগের রাতে পাটোয়ারী বাজারে হাসানের টেইলারিংয়ের দোকানে আলাপের সময় খালেক মাঝি রাজি হয়েছিলেন আমাকে সহযোগিতা করতে। ফজরের নামাজ শেষে ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন তিনি। পরনে পাঞ্চাবি, মাথায় টুপি। এসেই আমাকে কিছু ধারণা দেন। এলাকার বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, যাতায়াত, সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে বলেন। আমি শুনি, কিছু নোট নেই। এত ভোরে বাইরের লোক, আবার এত আলাপ দেখে জড়ো হন আরও কয়েক জন। পাশের ধনচে ক্ষেত থেকে আমাদের কথাগুলো শুনছিলেন কমরউদ্দিন। মাথায় প্যাঁচানো গামছা, হাতে কাঁচি। সেই ভোর থেকে ধনচে ক্ষেতে কাজ করছিলেন। এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, একটু ঘুরে দেখে যান আমরা কেমন আছি? সাহেবেরা তো এখানে এসে চলে যায়। আমরা কেমন আছি দেখেন না। 

মদনপুরের বাসিন্দা আবদুল খালেক মাঝি এবং আমি। পাশাপাশি হাঁটছি। দ্বীপের নানান বিষয়ে ধারণা দিচ্ছেন খালেক মাঝি। একবাড়ি, দুই বাড়ি, অনেক বাড়ি। চোখে পড়ে ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর। কোথাও হাঁটাচলার পথ আছে কোনোমতে, কোথাও নেই। এক বাড়ির ওপর দিয়ে আরেক বাড়ি যেতে হয়। শুকনোয় এভাবে চলাচল সম্ভব হলেও বর্ষায় নৌকা ছাড়া বিকল্প থাকে না। কয়েকজন নারী চোখে পড়ে; সকালে ঘরের কাজে ব্যস্ত। কেউ পানি আনছেন পাশের টিউবওয়েল থেকে। কেউ ঘরের পাশের ডোবায় ময়লা পানির ভেতরেই হাড়িপাতিল মাজছেন। শিশুরা মক্তব থেকে কেবল বেরিয়েছে। রাজহাঁসের দল কেবল ছাড়া পেয়েছে। পাখনা মেলে তারা ব্যস্ত ডুবসাঁতারে। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি মসজিদের সামনে। খালেক মাঝি এই মসজিদেই নামাজ পড়ে বেরিয়েছেন। ভাঙাচোরা, টিনের ছাপড়া। চালার ওপরে লম্বার বাঁশের মাথায় মাইক। মসজিদের পাশে আবার একটা নড়বড়ে সাঁকো। জোয়ারের পানি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই অবকাঠামো ঠিক থাকে না। মসজিদটি কতবার যে স্থান বদল করেছে- তার হিসেব নেই। মানুষের বাড়িঘরের অবস্থাও সেরকমই। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কে কীভাবে বসবাস করে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।

অনেকগুলো বাড়ি পার হয়ে আমরা মো. আজাদের বাড়ি এসে দাঁড়াই। একবাড়ির উঠোন ডিঙিয়ে, আরেক বাড়ির রান্নাঘরের গা ঘেঁষে, আরেকবাড়ির পুকুরের সরু পাড়ের ওপর দিয়ে আরও একটি শুকনো ডোবা ডিঙিয়ে সে বাড়িতে উঠি। খালেক মাঝির কাছ থেকে আগেই নানান ঘটনা জেনে নিয়েছিলাম। তারই ভিত্তিতে এ বাড়িতে আসা। মো. আজাদের বড় মেয়ে শারমিনকে একটি শিশু সন্তানসহ বাবার এই ঘরে ফেলে রেখে গেছে স্বামী মো. হাসান। শারমিনের পায়ে একটু সমস্যা থাকলেও সব কাজই সে করতে পারে। শুধু ঘরের কাজ নয়, বাইরে রোজগারের কাজেও যায় সে। বিয়ের পর দু’বছর এ বাড়িতেই ছিল হাসান। ছোট্ট ঘরের মাঝখানে আরেকটি বেড়া দিয়ে মেয়ে জামাইয়ের জন্য আলাদা কক্ষ বানিয়ে দিয়েছিলেন মো. আজাদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শারমিনকে ফেলে হাসান একদিন চলে যায়। আর ফিরে আসেনি। ফুটফুটে শিশু সন্তান নিয়ে এখন বিপাকে শারমিন। প্রথমে গিয়ে আমরা শারমিনকে পাইনি। কথা বলি তার বাবা আজাদ আর মা সাহেদা খাতুনের সঙ্গে। কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন সাহেদা। শুনি আর ভাবি, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের দেশে অনেক কাজ হচ্ছে- গঠিত হয়েছে অনেক সংগঠন। বেসরকারি পর্যায়ে দাতাদের টাকায় প্রকল্পও কম বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সে সবের ঢেউ দ্বীপ-চরের এই প্রান্তিকে পৌঁছাচ্ছে না।

সাহেদা চোখ মুছতে মুছতে বলতে থাকেন- হাসান অন্য এলাকা থেকে এলেও এখানে প্রায় স্থায়ী বাসিন্দার মত। মিস্ত্রির কাজ করতো। ৫-৬ বছর ধরে এখানে থাকে। তার মামার সাথে কথার ভিত্তিতে শারমিনের বাবা এ বিয়েতে রাজি হয়। স্থানীয় কাজির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবেই বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর কাজকর্মও করছিল। টাকা পয়সাও ছিল হাতে। কিন্তু জুয়া খেলে সব রোজগার উড়িয়ে দিত। মেয়ের সুখের জন্য বাবা নিজের ঘরেই রাখে তাদের। হাসান শ্বশুড়ের ঘরে থেকেছে, আর মেয়েকে বছরে মাত্র দুখানা শাড়ি দিয়েছে। সাহেদার কথায় যোগ করেন শারমিনের বাবা আজাদ। বলেন, আমি একদিন জানতে চেয়েছিলাম- তুমি টাকা পয়সা কী করো? শ্বশুরের কথায় ক্ষোভ ঝাড়ে হাসান- আমি কী করি, তা আপনার জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। এই নিয়ে গন্ডগোল শুরু। এক পর্যায়ে উধাও হাসান। তার আর কোনো খোঁজ নেই।

আলাপ শেষ হতে না হতেই খবর পেয়ে নদী থেকে চিংড়ির রেনু ধরা বন্ধ রেখে ছুটে আসে শারমিন। নিজের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনা খুলে বলে। কথার বিরুদ্ধে কিছু বললেই হাসান তাকে মারধর করতো। শারমিন তা বলেনি কাউকে, সয়ে থেকেছে। হয়তো ঠিক হবে। হাসান এভাবে চলে যাবে- বুঝতে পারেনি শারমিন। কথা বলতে বলতে কাবিননামা বের করে দেখায় আর চোখ মুছে। কোলের শিশুটির কান্না থামাতে থাকে। আমি ছবি তুলি। নোট নেই। উঁচু ভিটের ওপরে শারমিনের বাবার ঘর থেকে ধীর পায়ে বের হই আর ভাবতে থাকি- বিয়ে, তালাক এই জনপদে কোনো ব্যাপারই না। ইচ্ছে হলো বিয়ে করলো, আবার ছেড়ে চলে গেল মন চাইলেই। আবদুল খালেক মাঝি বলেন, কে কার খোঁজ রাখে, এগুলো দেখার তো কেউ নেই। আইনের শাসন নেই। খবরের কাগজেও এগুলো জায়গা পায় না।

শারমিনের বাবা মো. আজাদের ঘরের পাশের ঘরেই আরেক কান্ড। তার নাম আছিয়া। বয়স কতই বা ২৮-৩০। এরই মধ্যে বিধবা জীবনে প্রবেশ। স্বামী দুলাল মিয়া নিরুদ্দেশ হয়েছে অনেক আগে। রেখে গেছে চারটি সন্তান। বড় মেয়ে দুটো জান্নাত ও মরিয়মকে অনেক কষ্ট করে বিয়ে দিয়েছেন আছিয়া। সঙ্গে আছেন ছোট দুই ছেলে নূর হোসেন আর ইমাম হোসেন। ১২ বছর বয়সে মাকে সাহায্য করতে কাজে নেমেছে নূর হোসেন। আর ৭ বছরের ইমাম হোসেন এখন পর্যন্ত স্কুলে যাচ্ছে। কতদিন যেতে পারবে- জানেন না আছিয়া। কথা বলার সময় বারবার চোখ মুছছিলেন আছিয়া। বলেন, মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। তাও যৌতুক থেকে রেহাই পাইনি। বড় মেয়ের জামাইকে ৩৫ হাজার আর ছোট মেয়ের জামাইকে ৩০ হাজার টাকা যৌতুক দিতে হয়েছে। দুই ছেলে নিয়ে অতি কষ্টের জীবন তার।

উঁচু ভিটের ওপরে আছিয়ার ছোট্ট ঘর। নিজের নয়, স্থানীয় বাসিন্দা আমীর হোসেনের। জমিতে থাকার বিনিময়ে বছরে ৫০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। ঘর তুলে নিয়েছেন নিজে। ঘর তো নয়, যেন ঝুপড়ি। চালা পড়ো পড়ো। তবুও কষ্ট করে হলেও বর্ষা আসার আগে একবার নতুন খড় দিতে হয়। অনুদানে পাওয়া সৌরবাতি আলোকিত করে আছিয়ার ঘর। কিন্তু আছিয়ার জীবনটা পুরোপুরি অন্ধকারে ঢাকা। কী করবেন, কোথায় যাবেন, কীভাবে কাটবে আগামী দিনগুলো, জানেন না আছিয়া। কথা বলতে বলতে নূর হোসেন আর ইমাম হোসেন ছুটে আসে, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে। ইমাম হোসেন লেখাপড়া করতে চায়, আর নূর হোসেন ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে চায়। কিন্তু পারবে কী! নাকি নুয়ে পড়া এই দরিদ্র পরিবারের বোঝা টানতে ইমাম হোসেনকেও নামতে হবে কাজে? কে জানে!

দ্বীপ জেলা ভোলার দৌলতখান উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন মদনপুরে আছি। উপকূলীয় আর দশটি দ্বীপের মত এ দ্বীপও ডুবে আছে হাজারো সংকটে। বিয়ে-তালাক এ দ্বীপে যেন পুতুল খেলা। দ্বীপে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন আসে। কাজ করে। আবার চলে যায়। কাজের সঙ্গে বিয়েটাও করে নেয়। বাচ্চা জন্মদানের পর কোথায় চলে যায়- কে জানে। অন্য জেলা থেকে এখাকে এসে কেউ বিয়ে করলে তাকে ধরাও মুশকিল। তার আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ পাওয়া কঠিন। যেমনটা আছিয়া বেগমের স্বামীর বাড়ি মেঘনার ওপারে লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার জগবন্ধু গ্রামে। কিন্তু আছিয়ার বাবার বাড়ি মদনপুর দ্বীপে। ফলে স্বামী ফেলে চলে যাওয়ার পর আছিয়ার কিছুই করার ছিল না।

মদনপুর দ্বীপের এই ঘটনাগুলো শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ে মৌসুমী বিয়ের কথা। উপকূলীয় এইসব দ্বীপাঞ্চলের এক সময় মৌসুমী বিয়ের প্রচলন ছিল। বাইরে থেকে লোকজন কাজকর্মে এসে বিয়ে করতো এক মৌসুমের জন্য। কাজ শেষ- বিয়েও শেষ। আছিয়ার বাড়ির ভিটে পেছনে রেখে এগোই সামনের দিকে। ভাবি- মদনপুরের ঘরে ঘরে যে কত ঘটনা আছে। অল্প সময়ে আমরা কতটুকুই বা জানতে পারবো।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়