ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

খবর বিক্রেতার খবর কেউ রাখে না

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৮, ২০ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খবর বিক্রেতার খবর কেউ রাখে না

জাহিদ সাদেক : দিন-রাত, রোদ-বৃষ্টি, গরম-শীত সব ভুলে, ভোরে মোরগ ডাকার আগেই হকার ছুটে আসেন সমিতি কিংবা এজেন্টের কাছে। সেখান থেকে দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে আবার ছুটতে শুরু করেন গ্রাহকের দুয়ারে। দেশ, সমাজ, বিশ্বের খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যেন তার ব্রত। কিন্তু তাদের খবর আমরা কতটুকু রাখি? তারা থেকে যান অগোচরে। মানুষের অধিকার আদায়ের সংবাদ বিলি করলেও তারা নিজেরা নূন্যতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অথচ তারা খবরের কাগজের সম্পাদক ও পাঠক উভয়ের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। সমাজে ‘হকার’ নামেই তাদের পরিচয়।

রাজধানীতে বেশ কয়েকজন পত্রিকা হকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের দুঃখ, দুর্দশার কথা। সেই ভোর রাত থেকে তারা পথে নামেন। সারা দিনের পরিশ্রমের ফল সর্বসাকুল্যে মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। পত্রিকা যেদিন ভালো বিক্রি হয় সেদিন ৩০০ টাকা আয় হয়। পরিবার, পরিজন ও সন্তান লালন-পালন, তাদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ আবাসন ব্যয় মিটিয়ে ঢাকা শহরে তাদের টিকে থাকা কঠিন। জীবন বাজি রেখে খবরের কাগজ তারা পৌঁছে দেন ঠিকই কিন্তু দুর্ঘটনায় তাদের পাশে কেউ দাঁড়ান না। পুরনো পল্টন যাত্রী ছাউনীতে রাকিব পত্রিকা বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইও পত্রিকা বিক্রি করে। প্রতিদিন হাজারে একশ টাকা লাভ হয়। এজন্য পাশাপাশি অন্য ব্যবসা করতে হয়। এটা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব না।’

দৈনিক বাংলা মোড়ে পত্রিকা হকার মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিদিন ২৫০-৩০০ টাকা আয় হয়। এই আয় দিয়ে আসলে ঢাকা শহরে একজন মানুষের চলা মুশকিল। তার উপর পরিবার নিয়ে থাকা খুবই কঠিন ব্যাপার কিন্তু কোনো উপায় নেই।’ এজন্য নিজ ছেলেকেও শিখিয়েছেন এ কাজ। ফলে দুজনের সামান্য আয়ে কোনো রকম চলছে পরিবার। যেদিন অসুস্থ থাকেন সেদিন ছেলেকে একটু বেশি কাজ করতে হয়। পত্রিকা থেকে কোনো খোঁজখবর রাখে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর রমজানের ঈদের আগে একদিন সব পত্রিকা ফ্রি দেন। বছরের ওই একদিনই।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আজকাল কেউ কারো খবর রাখে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।’

নারিন্দা মোড়ে মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে পত্রিকা বিক্রি করেন বৃদ্ধ গফুর মিয়া। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে পত্রিকা বিক্রি করছেন তিনি। গফুর মিয়া জানান, পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে বাস করেন জুরাইনে। সকালে বাসায় বাসায় পত্রিকা বিলি করেন, বাকি সময় মোড়ে পত্রিকা বিক্রি করে যে টাকা পান তা দিয়ে কষ্টে দিন চলে। তবে এখন বয়স হওয়ায় আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকাশকের কাছ থেকে হকার্স সমিতি পত্রিকা প্রতি পায় ৩৫ শতাংশ কমিশন। এর মধ্য থেকে হকাররা পত্রিকা পান ৩২ শতাংশ কমিশনে। মাঠ পর্যায়ের হকাররা অনেক পত্রিকার ক্ষেত্রেই নির্ধারিত কমিশন পান না। মধ্যস্বত্বভোগীরা তাতে ভাগ বসায়। ১৯৭৪ সাল থেকে এই একই রেটে চলছে পত্রিকা বিপণন। অনেক সময় গড়িয়েছে। দুই টাকার পত্রিকা ১২ টাকা হয়েছে, সবার লাভ বেড়েছে। কিন্তু হকারদের আয় বাড়েনি। অনেকে পত্রিকার সংখ্যার কথা বলেন, কিন্তু হকাররা বলছেন- তাতে কাজ হচ্ছে না। এজন্য অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশার প্রতি ঝুঁকছেন। লক্ষ্মীবাজারে পত্রিকা বিক্রি করেন সাইদ। তিনি বলেন, আগে আমরা তিন ভাই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন শুধু আমিই আছি।

বাংলাবাজারে পত্রিকা বিক্রি করেন কুরবান আলী। তিনি এই পেশা ছেড়ে দেবেন বলে ভাবছেন। তিনি পত্রিকা কম বিক্রির কারণ হিসেবে ইন্টারনেটকে দায়ী করেছেন। এত সমস্যার পরেও যোগ হয়েছে নতুন হয়রানি- ফুটপাত থেকে পত্রিকা হকারদের তুলে দেয়া। সম্প্রতি ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে দুই সিটি কর্পোরেশন। ফুটপাতের অস্থায়ী দোকানের সঙ্গে ভেঙে দেয়া হচ্ছে ভাসমান পত্রিকা স্টল। পুনর্বাসন না করে প্রতিদিনই চলছে উচ্ছেদ অভিযান। এতে বেশি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন পত্রিকার হকাররা। উপার্জনের শেষ অবলম্বন হারিয়ে এখন চোখে সরষে ফুল দেখছেন তারা। হকাররা দাবি করেন, যত দিন পুনর্বাসন না করা হচ্ছে, অন্তত তত দিন সংবাদপত্র বিক্রেতাদের আগের জায়গায় বসতে দেয়া দরকার। ‘গরিবদের দুই মেয়র পছন্দ করেন না’- এভাবেই হতাশার কথা বললেন গুলিস্তানের পত্রিকা হকার বাবুল।

হকারদের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমূখী সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতির সঙ্গে। সভাপতি মোস্তফা কামাল বলেন, আগে পত্রিকা মালিকরা আমাদের বেশ খোঁজখবর রাখতেন। এখন আর রাখেন না। তিনি আরো বলেন, আমাদের এ সংগঠনটি ১৯৬৬ সাল থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অবশেষে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে প্রায় ১৭ হাজার হকার এবং সাতশ স্টাফ নিরন্তর কাজ করছে। আমরা এই সমিতির আওতায় রাজধানী ঢাকাসহ গাজীপুর, কাপাসিয়া, মুন্সিগঞ্জ, মাওয়া, সাভার, জিরানী, বাইপেল, নারায়ণগঞ্জে পত্রিকা পাঠাই।

এই সমিতি থেকে হকারদের কী ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকেন জানতে চাইলে তিনি জানান, কোনো হকার মারা গেলে আমরা তার পরিবারকে নগদ ২৫ হাজার টাকা দেই। কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার সিংহভাগ আমরা দেই। এছাড়া কেউ নাবালক ছেলেমেয়ে রেখে গেলে আমরা তার লেখাপড়ার যাবতীয় ব্যয় বহন করি। হকারদের বর্তমান সমস্যা নিয়ে তিনি বলেন, এখন হকাররা পত্রিকা বিক্রি করার মতো জায়গা পান না। ১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ঢাকায় পত্রিকা বিক্রির জন্য কিছু জায়গায় ছাউনী নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন অনেকগুলোই ভেঙে ফেলা হয়েছে। ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি ও সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির তালিকায় পত্রিকা বিক্রেতা রয়েছেন ৯০ জন; যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে।’ এখন পত্রিকা বিক্রি কেমন হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘পত্রিকা মালিকেরা পত্রিকা প্রিন্ট দিয়েই খালাস কিন্তু দিনদিন পাঠক বৃদ্ধি করা কিংবা পাঠক ফোরাম করার কোনো চিন্তা তাদের মাথায় নেই। এতে বিক্রির পরিমাণ দিনে দিনে কমছে।’

এ প্রসঙ্গে সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘রাজধানীতে সাধারণ মানুষের কাছে পত্রিকা পৌঁছানোর অন্যতম পথ হচ্ছে ফুটপাতের ভাসমান পত্রিকার স্টল। জনসাধারণ চলার পথে এসব স্টল থেকে পত্রিকা কিনে থাকেন। এ সুযোগটা বন্ধ করে দিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন। ভাসমান পত্রিকা স্টল নিয়ে আমরা দুই মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছি। বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য সবাই আমরা বসব।’

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়