ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

উইপোকার পেটে সরস্বতী

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২০, ১ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উইপোকার পেটে সরস্বতী

পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী নর্থব্রুক হল পাবলিক লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকাবাসীর গৌরবের ইতিহাস। সাহিত্যে নোবেল জয়ের পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এখানেই সংবর্ধনা দিয়েছিল ঢাকাবাসী। কালের পরিক্রমায় ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরিটি এখন ধ্বংসপ্রায়। মূল্যবান বইগুলো উইপোকার খাদ্যে পরিণত হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, লাইব্রেরির টেবিলে চকচকে পত্রিকা থাকলেও আলমারির ভেতর পুরোনো বইয়ে পড়েছে ধূলির আস্তরণ। অধিকাংশ বই উইপোকায় কাটা। লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখে শ্বেতপাথরের ধূসর স্মৃতিফলক। সেখানে লেখা: ‘বিশ্ব নাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় একাধিক সংগঠনের আমন্ত্রণে ঢাকা শহরে আসেন ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ফেব্রুয়ারি, ওই দিন বিকেলে লালকুঠিতে ঢাকা মিউনিসিপ্যালটির ও পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়ে মানপত্র পাঠ করা হয়। জবাবে কবি দেশসেবা, সম্প্রদায়-সম্প্রীতি বিশ্বশান্তির পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন।’

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেবার কবিগুরু পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ও অন্যান্যদের নিয়ে শেষবারের মতো ঢাকা আসেন। ঢাকা পৌঁছার দিন, অর্থাৎ ৭ তারিখ বিকেলেই কবিকে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এমনকি প্রথমবার ১৮৯৮ সালে কবি ঢাকা এলে তখনও এই নর্থব্রুক হলে ভোজসভায় তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন।

নর্থব্রুক হল একটি ইন্দো-সারাসেন ভবন, যেখানে মোগল এবং ইউরোপিয়ান রেনেসার স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। ভবনের বিশেষত্ব হলো এটি লাল ইটের তৈরি। যে কারণে ভবনটিকে অনেকে ‘লালকুঠি’ বলে। এর উত্তর দিকের প্রবেশপথে রয়েছে অর্ধগোলাকার ঘোড়ার পায়ের নালের আকৃতির তোরণ। ভবনটির উত্তর দিকে অবস্থিত চারটি অষ্টকোণ বিশিষ্ট মিনার, ছাদে অবস্থিত সজ্জিত তীক্ষ্ম চূড়া এবং নকশা করা পাচিল থেকেও মুসলিম ও মোগলদের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। ভবনটির দরজা, জানালা এবং দেয়ালের নকশা ইউরোপিয়ান কায়দায় করা হলেও ভবনের গম্বুজের নকশা করা হয়েছে মুসলিম স্থাপত্যের সঙ্গে মিল রেখে। তবে মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই দালানের নকশার আভিজাত্য চোখে পড়ার মতো। ভবনের দুই পাশে দুটি করে মোট চারটি মিনার আছে। মিনার থেকে খসে পড়ছে প্লাস্টার। সব মিলিয়ে পুরো ভবনটিরই জীর্ণ দশা। ভিতরেও জরাজীর্ণ অবস্থা। যে মিলনায়তনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে, একসময় যে মঞ্চে হয়েছে সংস্কৃতিচর্চা, সেই মঞ্চের আজ বেহাল দশা। এখানে সেখানে ভাঙা চেয়ারে জমেছে ধুলো। মঞ্চের পর্দা ছেঁড়া, মঞ্চটাও যেন বইতে পারছে না কালের ভার; ভেঙে পড়বে যখন তখন।

‘ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন লিখেছেন, ১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর থমাস জর্জ ব্যারিং এবং নিযুক্ত ভাইসরয় লর্ড নর্থব্রুক ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁদের ঢাকা সফরকে স্মরণীয় রাখতে রাজা রায়বাহাদুর, অন্যান্য জমিদারেরা এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা অনুদান প্রদান করেন। হলটি নির্মাণে সর্বমোট ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। অভয় চন্দ্র দাস ছিলেন কমিটির সচিব। ১৮৭৯ সালে হল নির্মাণের কাজ শেষ হলেও মহারানী ভিক্টোরিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে ১৮৮০ সালের ২৪ মে ঢাকার কমিশনার নর্থব্রুক হলের উদ্বোধন করেন। সেসময় নবাব আব্দুল গনির ‘অর্কেস্ট্রা’ নিয়ে আসা হয়েছিল উদ্বোধন উপলক্ষে অতিথিদের আনন্দ দেয়ার জন্য। ১৮৮০ সালের ২৫ জুন জুডিশিয়াল বিভাগের সেক্রেটারিকে লেখা কমিশনারের এক চিঠিতে একথার প্রমাণ মেলে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫০ সালে ব্রিটেনে লাইব্রেরি আইন পাসের পর স্থানীয় সরকার বিভিন্ন জায়গায় গণগ্রন্থাগার তৈরি করতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নর্থব্রুক হলের লাগোয়া ভবনে যুক্ত হয়েছিল একটি গণপাঠাগার। যার নামকরণ করা হয় ঢাকার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনসনের নামে। এটিই ঢাকার দ্বিতীয় পুরনো লাইব্রেরি। ১৮৮৮ সালে এই লাইব্রেরির জন্য লন্ডন থেকে ৬০০ টাকার বই আনানো হয়। নবাবসহ সেকালে ঢাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও জমিদার শ্রেণি যাদের পুস্তকাদি ও আর্থিক দানের পরিপ্রেক্ষিতে এই গ্রন্থাগারের সূচনা। তাঁদের নামাঙ্কিত কিছু আলমারি ও বইয়ের পাতায় তাঁদের সিলমোহর আজও গ্রন্থাগারটিতে বিদ্যমান রয়েছে।

লাইব্রেরিতে ১৭টি কাঠের আলমারি রয়েছে। প্রতিটি আলমারিতে রয়েছে বই। রানী ভিক্টোরিয়ার চিঠি থেকে শুরু করে বিলেতের ইতিহাস, সিপাহী বিপ্লব, প্রতাপশালী ব্রিটিশ শাসকদের জীবনী, ভারতবর্ষের সীমানা নির্ধারণ কমিটির প্রতিবেদন, ইংরেজি সাহিত্যের নানা বই থরে থরে সাজানো। শ’ দুয়েক বাংলা বইও আছে। সেগুলো পঞ্চাশ থেকে একশ বছরের পুরোনো। তবে বইয়ে হাত দেয়া নিষেধ। শুধু আলমারির কাচের বাইরে থেকে দেখার অনুমতি আছে। ছবি তোলারও অনুমতি নেই।

পাঠাগারে পত্রিকা পড়তে আসা কয়েকজন স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একসময় গবেষণা ও রেফারেন্স পুস্তক কলকাতা, আগরতলা এমনকি পাটনার খোদাবক্স লাইব্রেরিতে পাওয়া না গেলেও নর্থব্রুক হল লাইব্রেরিতে পাওয়া যেত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক বই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে শত শত মূল্যবান বই, জার্নাল, পত্রিকা উইয়ের পেটে গেছে। ছাদের ফাটল দিয়ে পানি পড়ে অনেক বই নষ্ট হয়েছে।

লাইব্রেরির কর্মচারীরা জানিয়েছেন, বর্ষাকালে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে ১৩টি আলমারির মধ্যে অনেকগুলো বই ইতোমধ্যে পড়ার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। গত তিন বছর আগে পরিত্যক্ত লাইব্রেরির ভবনের পাশে ওয়াসা পানির পাম্প ও জেনারেটর বসিয়েছে। জেনারেটরের শব্দে লাইব্রেরিতে বই পড়া তো দূরের কথা, বসে থাকাই মুশকিল! লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক জাহিদুল আমিনের ভাষ্যমতে, এখানে তেরোশ খ্রিষ্টাব্দে ছাপা অনেক বই রয়েছে, যা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। এসব বই ছাপানো হয়েছে লন্ডনে। বাংলাদেশে আর্কাইভ আছে। তাদের দিয়ে স্ক্যানিং করা হলে বইগুলো এখনও টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

দায়িত্বরত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন বলেন, নর্থব্রুক হল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান লিখিতভাবে বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়েছেন। সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এটি সংস্কারে ঢাকা বিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে প্রধান করে ডিএনসিসির সচিব ও বিশিষ্ট স্থপতিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা এটিকে আর্কাইভ বানাব। সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। পাঠাগারের দুরবস্থা প্রসঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, সব পাঠাগার পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সবাই আসলে চাকরিজীবী। বইপ্রেমী না হলে শুধু চাকরির মানসিকতা নিয়ে পাঠাগার পরিচালনা সম্ভব নয়।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়