ঢাকা     বুধবার   ১৫ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩১

মধুদা’র পরিবারের খোঁজে

খালেদ সাইফুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধুদা’র পরিবারের খোঁজে

জীর্ণ দেয়াল, ভেতরে কতগুলো কাঠের চেয়ার-টেবিল। খুব বেশি আড়ম্বর যে নেই দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু এই অনাড়ম্বর আয়োজন সগৌরবে টিকে আছে দশকের পর দশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা যে ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে মধুর ক্যান্টিন অন্যতম। বিশেষত দেশের ছাত্র রাজনীতির কথা বলতে গেলে সবার আগে উচ্চারিত হবে এই ক্যান্টিনের নাম। এক সময় তো দেশের রাজনীতি পরিচালিত হতো ছাত্র রাজনীতির সোচ্চার কণ্ঠের প্রতিবাদে, বিক্ষোভে। অর্থাৎ সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশের জন্ম পর্যন্ত নানা আন্দোলন সংগ্রামে রয়েছে ছাত্র রাজনীতির অবদান। এই মধুর ক্যান্টিন থেকেই ছাত্ররা গর্জন তুলেছেন। প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে শোষকের হৃদয়।

মধুসূদন দে। তাঁকে স্মরণ করে তাঁর নামে এই ক্যান্টিনের নামকরণ। কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদদের একজন। তারও আগে তিনি সবার প্রিয় মধুদা। মধুসূদন দে'র পূর্বে এখানে ক্যান্টিন চালাতেন তার বাবা। ৭১-এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেদিন জগন্নাথ হলের পার্শ্ববর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দচন্দ্র দেবসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের। একই দিনে হত্যা করা হয় মধুসূদন দে-কে। এখানেই নির্মমতা থেমে যায়নি। হত্যা করা হয় মধুসূদনের পরিবারের আরো তিন সদস্যকে। তাঁর স্ত্রী, বড় পুত্র ও পুত্রবধূকে। মধুসূদনকে গুলি করে আহত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় জগন্নাথ হলের মাঠে। সেখানে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় অত্যাচার করে। 

মৃত্যুর সময় ৫৫ বছর বয়সী মধুসূদনের ছিল ১১ সন্তান। ৫ পুত্রের মধ্যে বিয়ে হয়েছিল শুধু বড় ছেলের। ৬ কন্যার মধ্যে দুজনের বিয়ে হয়েছিল। তারা শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সবচেয়ে ছোট মেয়েটি তখন বড় বোনের বাড়িতে ছিলেন। পরিবারের বাকি সদস্যরা তখন বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। বাবা-মা, বড় ভাই আর ভাতৃবধূর হত্যাযজ্ঞ চোখের সামনে দেখে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন বাকি ভাই-বোনেরা। পরদিনই চলে যান গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর। কিন্তু সেখানে থাকাটাও কি নিরাপদ! এরপর যত দ্রুত সম্ভব পরিবারের সকলে মিলে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান ভারতে।

১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে মধুর পরিবারের সদস্যরা ফিরে আসেন। ততদিনে মুখর মধুসূদন দে'র ক্যান্টিনে নেমে এসেছে কবরের নীরবতা। লণ্ডভণ্ড সবকিছু। যেন ছাত্রদের প্রিয় মধুদাকে হত্যা করেও ক্ষোভ মেটেনি তাদের। ক্যান্টিনের সবকিছু তছনছ করেছে। সেই ভগ্নস্তূপের ওপর মধুসূদনের দ্বিতীয় পুত্র অরুণকুমার দে মাত্র এগারো বছর বয়সে ক্যান্টিনের দায়িত্ব তুলে নেন নিজ কাঁধে। পূর্বের কর্মচারীরাই কাজ করতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যান্টিনের সংস্কার করে দেয়। অরুণকুমার জানান, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত মধুর ক্যান্টিন যখন নতুন করে শুরু করি তখন তৎকালীন ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শেখ কামাল সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন।’

 

 

নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যান্টিন চালাতে থাকেন অরুণ। স্কুল শেষ করেই চলে আসেন ক্যান্টিনে, ফেরেন সব কাজ শেষ করে। এই নিয়মে শেষ হয় অরুণের মাধ্যমিক শিক্ষা। তারপর উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন ঢাকা সিটি কলেজে। ১৯৭৭ সালে পাস করার পর সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন ক্যান্টিনের প্রতি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মাস্টার্স প্রোগ্রামে। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় তা আর শেষ করা হয়নি।

পিতার মৃত্যুর পর অরুণকুমার শুধু মধুর ক্যান্টিনের দায়িত্বই নেননি, নিয়েছেন পুরো পরিবারের ভার। তিনি জানান, চার বোন ও তিন ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে ২ বোন সপরিবারে থাকেন ভারতে। দুই ভাই ও এক বোন বাস করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি ছাড়া দেশে আছেন শুধু এক বোন। এছাড়া দুই বোন ও এক ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে অকালে। তবে ভাইদের মধ্যে যে সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে তা অরুণের কথার সুরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অরুণ বলেন, ‘আমি শুধু পিতার আদর্শ ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সেবা করতে চেয়েছি। কিন্তু তারা পিতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাই তাদের সঙ্গে আপোষ করিনি।’

অরুণকুমার দে'র এক পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে। স্বাধীন দেশে জাতীয় রাজনীতির সাথে তাল মিলিয়ে নানা সময়ে নানা দিকে বাঁক নিয়েছে ছাত্র রাজনীতি। নানাদিকে বিস্তৃত হয়েছে এর শাখা-প্রশাখা। ছাত্র রাজনীতির পটভূমিতে বিভিন্ন পরিবর্তন-বিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন অরুণকুমার৷ রাজনৈতিক বাদানুবাদ, কিল-ঘুষি থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া ঘটেছে তার সামনে। তবে ছাত্র রাজনীতির আঁতুড়ঘরখ্যাত এই মধুর ক্যান্টিনের প্রতি সদা যত্নবান ছিলেন সব সংগঠনের ছাত্রনেতারা। মধুদার ছেলে হিসেবে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করেছে সবসময়। তিনিও তাই নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা দিয়ে চলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের। অরুণকুমার বলেন, ‘একদম ছেলেবেলা থেকে এই ক্যান্টিন আমি চালাচ্ছি। ছাত্র-শিক্ষকদের সেবাই আমার ব্রত। আর যাই হোক, বাবার নামকে অসম্মানিত হতে দিতে চাই না।’



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়