ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কত সনদ থাকলে এ দেশে স্বীকৃতি পাওয়া যায়?

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১১, ৭ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কত সনদ থাকলে এ দেশে স্বীকৃতি পাওয়া যায়?

আব্দুল জলিল শেখ

শরীরে বহন করছেন বুলেটের চিহ্ন।  এই চিহ্ন সারাজীবনের গৌরব বলে তিনি মনে করেন।  কারণ তিনি মুক্তিযোদ্ধা।  অংশ নিয়েছেন একাধিক সম্মুখযুদ্ধে।  যুদ্ধ একসময় শেষ হয়।  স্বাধীন হয় দেশ। তিনিও ফিরে আসেন মুক্তজীবনে।  জীবিকার প্রয়োজনে কাজ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে।  সেখানে গার্ডের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

হঠাৎ আসে ইতিহাসের সেই কলঙ্কময় দিন।  ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট।  হামলার আগে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।  পরদিন সকালে জানতে পারেন তার প্রিয় নেতা নিহত হয়েছেন সপরিবারে।  এরপরই তার জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়।

বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গার্ড- শুধু এই কারণে ১ বছর ৪০ দিন তাকে জেল খাটতে হয়েছে।  তাতেও তার দুঃখ নেই।  জীবনের এই শেষ লগ্নে এসে এখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না।  ভাবেন সেদিন যদি কোনো উপায়ে প্রিয় নেতাকে বাঁচানো যেত।  কিন্তু হায়! বাঙালির ইতিহাসের কালো অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে সেই মৃত‌্যু।  এই শোক ভোলার নয়।

 

পিছনে দাঁড়িয়ে আব্দুল জলিল শেখ (গোল চিহ্নিত)

ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার আব্দুল জলিল শেখের শোকের দিন আজও ফুরায়নি।  তিনি বর্তমানে রাজধানীর পুরোনো ঢাকার একটি ভবনে গার্ডের চাকরি করে দুঃসহ দারিদ্রে‌‌ দিন কাটাচ্ছেন।  তারচেয়েও বড় দুঃখ মুক্তিযোদ্ধা জলিল শেখ আজও পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

মুক্তিযোদ্ধার প্রমাণ হিসেবে আব্দুল জলিল শেখের কাছে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী স্বাক্ষরিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র।  আরো রয়েছে ১৯৭২ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার মুক্তিবাহিনীর দলপ্রধান এ কে এম সাহজাহান মিয়া স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্র।  ১৯৭২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৩০ রাউন্ড গুলিসহ ৪১৪১ নম্বর রাইফেল ফেরত দেয়ার সার্টিফিকেটও রয়েছে জলিল শেখের কাছে।  এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের দেয়া প্রত্যয়নপত্র তো রয়েছেই।  আরো রয়েছে একটি গ্রুপ ফটোগ্রাফ।  যেখানে দেখা যাচ্ছে রণাঙ্গন থেকে ফিরে অস্ত্রসহ কমান্ডার এ কে এম সাহজাহানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। 

এত প্রমাণ থাকার পরও আব্দুল জলিল শেখ পাননি মুক্তিযোদ্ধার সম্মান।  এজন্য তিনি হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন।  কোর্ট কাগজপত্র যাচাই করে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেন।  কিন্তু তারপরও ঘুম ভাঙেনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের।  এই মন্ত্রণালয় থেকে তিনি আজও স্বীকৃতি পাননি।

দুইবার মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আব্দুল জলিল শেখকে ডেকেছেন।  কিন্তু জীবন্ত সাক্ষী হাজির করতে না পারায় তার আবেদন খারিজ হয়ে যায়।  প্রত্যয়নপত্রগুলো থেকে জানা যায়, জনাব আব্দুল জলিল শেখ, পিতা আব্দুল জব্বার শেখ, গ্রাম মকরমপটি, থানা ভাঙ্গা, জেলা ফরিদপুর।  তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

 

জলিল শেখের প্রত‌্যয়নপত্র

জলিল শেখের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যুদ্ধের আগে থেকেই তিনি পুলিশের চাকরিতে ছিলেন।  একাত্তরের মার্চে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে ছুটি নিয়ে গ্রামে চলে যান।  ২৫ মার্চ ছিল চাকরিতে যোগদানের তারিখ।  কিন্তু দেশের এমন পরিস্থিতি এবং পারিবারিক কারণে তিনি সেদিন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারেননি।  তিনি যুদ্ধ করেছেন ভাঙ্গা থানার মুক্তিবাহিনীতে।  কমান্ডার ছিলেন শাহজাহান খান। 

বঙ্গবন্ধুর মৃত‌্যুর পর জলিল শেখ রাগে ক্ষোভে সরকারি চাকরি করেননি।  ব্যক্তিজীবনে তার তিন ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে।  তারা সবাই গ্রামের বাড়ি বসবাস করেন।  তিনি ছেলের সবাই অটো রিকশা চালক।  তিনি যে টাকা পান তা দিয়েই কোনোমতে জীবন নির্বাহ করেন।  ছেলেরা সবাই পৃথক সংসার করছেন।

দুঃখ আর ক্ষোভ নিয়ে জলিল শেখ বলেন, ‘আমার বর্তমান বয়স ৮৩।  শেষ জীবনে এখনো সুস্থ আছি। আমার টাকার মোহ নেই।  শুধু চাই, শেষ জীবনে যে দেশের জন্য যুদ্ধ করলাম সেই দেশের স্বীকৃতি। স্বীকৃতির জন্য হাইকোর্টে গিয়েছি।  হাইকোর্টের নির্দেশের পরও আমি আমার প্রাপ‌্য পাচ্ছি না। ’

জলিল শেখ এই প্রতিবেদকের কাছে দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানতে চান- বলতে পারেন আর কত সনদ থাকলে এ দেশে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া যায়?



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়