ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৭ ১৪৩১

বিয়ে মহব্বতের কাজ, পবিত্র কাজ: ঘটক পাখি ভাই

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিয়ে মহব্বতের কাজ, পবিত্র কাজ: ঘটক পাখি ভাই

‘লাভ গুরু’ হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। যদিও তার আসল নাম চাপা পড়ে গেছে অনেক আগেই। প্রতিনিয়ত মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে ভূমিকা রাখছেন তিনি। বলা চলে এই কাজে দীর্ঘ ৪৫ বছরের অভিজ্ঞতা তার। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম ঘটকালিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে বিয়ের ঘটকালি পেশার পথিকৃৎ ঘটক পাখি ভাইয়ের মুখোমুখি হয়েছেন ছাইফুল ইসলাম মাছুম।

মাছুম: বিয়ের ঘটকালি মহৎ কাজ। ঠিক কোন ভাবনা থেকে এই পেশা বেছে নিয়েছেন?

ঘটক পাখি ভাই: আমি বরিশালের মানুষ। এই পেশায় আমি ইচ্ছে করে আসিনি। আমি তখন খুলনায় চাকরি করতাম। অনেকে জানতে চাইতো- আমার বোনটা বড় হয়ছে, আপনার পরিচিত ছেলে আছে কিনা কিংবা আমার ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছি- আপনার পরিচিত ভালো কোনো মেয়ে আছে কিনা? তখন টুকটাক এর-ওর ঘটকালি করতাম। তবে সেটা দাওয়াত খাওয়া কিংবা পয়সাকড়ি পাওয়ার জন্য নয়।

পাকিস্তান আমলে আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। অন্য কাজ করার মতো আমার শারীরিক অবস্থা ছিল না। তখন চিন্তা করলাম, আমি যেহেতু ঘটকালি ভালো বুঝি, সুতরাং এখানে একটু মনোযোগ দেই। তারপর ১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা চলে আসি। তখন মানুষ আমাকে চিনতো না, অফিসে অফিসে যেতাম, অবিবাহিত ছেলে-মেয়ের খোঁজখবর নিতাম। তখন কেউ এভাবে কাজ করত না। কাজ করতে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেলাম! ঢাকায় আমার থাকার জায়গা ছিল না। নবাবপুরে সাবিনা হোটেলে থাকতাম। হোটেলে থেকেই কাজকর্ম করতাম। সবাইকে হোটেলের টেলিফোন নাম্বার দিতাম। প্রতিদিন এতো ফোন আসতো যে, হোটেল ম্যানেজার আমার উপর খুব বিরক্ত হতো। এরপর আমি নিজেই আলাদা টেলিফোন নাম্বার নেই। এরপর ইস্টার্ন প্লাজায় ‘ঘটক পাখি ভাই’ নামে অফিস নিয়েছি। সময়টা ১৯৮৫ সাল। মজার ব্যাপার এই কাজ শুরু করতে গিয়ে আমার তেমন কোনো পুঁজি লাগেনি। হোটেলের সেই টেলিফোন বিক্রি করে ইস্টার্ন প্লাজায় অফিস নিয়েছিলাম। তখন অবশ্য ভাড়াও খুব কম ছিল।


মাছুম: আপনার নাম ‘ঘটক পাখি ভাই’ কীভাবে হলো? নিশ্চয়ই ছেলেবেলায় এই নাম ছিল না!

ঘটক পাখি ভাই: আমার আসল নাম কাজী আশরাফ হোসেন। বিয়ের ঘটকালি যখন বেশি বেশি করতে শুরু করলাম, তখন এ-বাড়ি, ও-বাড়ি যেতাম। পরিচিত লোকজন লক্ষ্য করতো আমি একটু আগেই এ-বাড়িতে ছিলাম, অথচ হঠাৎ অন্য বাড়িতে চলে গেছি। তখন তারা বলতো- পাখি চড়ে ডালে ডালে, আর তুমি চলো মানুষের বাড়ি বাড়ি! একজন একদিন বললো, তুমি এতো দ্রুত পাখির মতো এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যাতায়াত করো, তোমার নাম ‘পাখি ভাই’ নাকি? এভাবে মানুষের মুখে মুখে আমার নাম ‘ঘটক পাখি ভাই’ হয়ে গেছে। এখন কেউ আমাকে আশরাফ হোসেন নামে চেনে না।

মাছুম: আপনি তো এক জীবনে অনেক বিয়ের ঘটকালি করেছেন! সংখ্যাটা কত হবে?

ঘটক পাখি ভাই: বিয়ে মহব্বতের কাজ, পবিত্র কাজ। দীর্ঘ ৪৫ বছরে প্রায় ১৯ হাজার বিয়ের ঘটকালি করেছি। আমি এই পেশায় মিথ্যা কথা বলে কখনো ঘটকালি করিনি। মানুষকে ধোঁকা দেব, মিথ্যা বলে টাকা নেব- এভাবে আমি কখনো করিনি। তাহলে এতো বছর আমি কাজ করতে পারতাম না।

মাছুম: স্বামী-স্ত্রী জুটি মেলানোর ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো আপনি লক্ষ্য করেন?

ঘটক পাখি ভাই: একটা ভদ্র ছেলে, ভালো ছেলে ছাড়া সংসার ভালোভাবে হয় না। ছেলে যদি একটু অন্যভাবে চলাফেরা করে, ওই ঘরে স্ত্রীর সুখ হয় না, শান্তি হয় না। এজন্য আমি মেয়েদের অভিভাবকদের বুঝাই, আপনারা সব সময় জেনেশুনে মেয়ের বিয়ে দেবেন। না জেনে হুট করে বিয়ে দিয়ে বিপদে পড়বেন না।

মাছুম: এটা তো মেয়ে পক্ষকে বুঝালেন, ছেলে পক্ষকে...

ঘটক পাখি ভাই: ছেলে পক্ষকেও বলি, আপনারা খোঁজখবর নেন। মেয়ের কোথাও কোনো অসুবিধা আছে নাকি? প্রেম পিরিতি করে নাকি? মেয়ের বাবা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে নাকি? এগুলো আগে জানতে হবে। না জেনে আত্মীয়তা করবেন না। দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে আমি ঘটকালি করিনি। দেশের বাইরেও আমি অনেক বিয়ের কাজ করেছি। বিশেষ করে লন্ডন, আমেরিকা, সৌদি আরবসহ যেখানে  বাঙালী বেশি রয়েছে।

মাছুম: আপনার এখানে পাত্র কিংবা পাত্রীপক্ষ কীভাবে আসে?

ঘটক পাখি ভাই: আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেই। বিজ্ঞাপন দেখে মানুষ আসে। এসেই বলে, আমার ছেলে বিয়ে করবে, একটা ভালো মেয়ে দরকার, একটা ভালো ফ্যামেলি দরকার। মেয়ে পক্ষ বলে, এই রকম একটা ছেলে দরকার। উভয় পক্ষের পছন্দ মিলিয়ে দুই পক্ষকে তথ্য, ছবি ই-মেইল করি। আমার অফিসে দুই পক্ষকেই ডেকে বসার ব্যবস্থা করে দেই।

মাছুম: ঘটকালি করতে গিয়ে কখনো বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন কিনা?

ঘটক পাখি ভাই: অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়েছি। অনেকে বিয়ে করেছে কিন্তু আমার পাওনা পরিশোধ করেনি। উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। যে মেয়েরা আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, তাদের কটূ কথা শুনিয়েছে। এটা হয়, এটা স্বাভাবিক। হাজার হাজার কাজ করি তো- দুই চারটা বিয়েতে এমন হতেই পারে। ব্যাপার না।

মাছুম: এক দুটি বিব্রতকর ঘটনার কথা যদি বলতেন...

ঘটক পাখি ভাই: বিয়ের আগে হয়তো ক্লায়েন্ট বলল, ‘ভাই এটা কোনো টাকাই না, বিয়ের পর আরো অনেক টাকা দেব-আপনি লিখে রাখেন।’ আমি লিখে রেখেছি, সেটা লেখাই আছে, কিন্তু টাকার আর খোঁজ নেই। জিজ্ঞেস করলে বলে, এই টাকা তো দেয়ার কথা ছিল না। এ নিয়ে ঝগড়া, খারাপ ব্যবহার, বকাবকি- এমন কাহিনি অনেক আছে। 

মাছুম: ঘটকালির জন্য কত টাকা ফি নেন?

ঘটক পাখি ভাই: যাদের টাকাপয়সা কম, তাদের থেকে কম নেই। যাদের টাকাপয়সা আছে তাদের কাছে একটু বেশি নেই। অনেক বড় লোক আছে, বলতেও হয় না, তারা বুঝে নেয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের দুইটা অফিস, স্টাফদের বেতন এগুলো তো চালাতে হবে। ধরুন এই অফিস ভাড়াসহ মাসিক খরচ প্রায় দেড় লাখ টাকা। এছাড়া বেতনভূক্ত ছয়জন নারী স্টাফ রয়েছে। প্রতিদিন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হয়, নইলে মানুষ তো জানবে না- পাখি ভাই আছে নাকি মারা গেছে! কেউ ২০ হাজার, কেউ ৫০ হাজার দেয়। তবে সর্বনিম্ন রেট দশ হাজার টাকা। এর কম নিলে তো আমি চলতে পারবো না!

মাছুম: ঘটকালি তো বাণিজ্যিকভাবে করেন। এই ক্ষেত্রে আবেগ, অনুভূতি কাজ করে কিনা?

ঘটক পাখি ভাই: আবেগই তো সমস্যা। দেখা গেছে, দুই পক্ষের সম্মতিতে বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক করলাম। হঠাৎ কোনো এক পক্ষ কোনো এক কারণে মত ফিরিয়ে নিল। তখন আমার ভেতরে অনেক দুঃখ কাজ করে, মায়া কাজ করে। এতো কষ্ট করে এই বিয়ে ঠিক করলাম, এখন হচ্ছে না। বড় আফসোস লাগে! আবার ভালো লাগার ঘটনাও আছে। যাদের বিয়ে হচ্ছে না, কালো মোটা চিকন ছেলেমেয়ে, বয়স বেশি, দীর্ঘ দিন বিয়ে হচ্ছে না- এদের বিয়ে দিতে পারলে আমার খুব আনন্দ লাগে! পয়সার তো দরকার আছে চলার জন্য। তবে আনন্দটা বেশি লাগে।

মাছুম: ঘটকালি কি তরুণ প্রজন্ম পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে?

ঘটক পাখি ভাই: পারে মানে, অবশ্যই পারে। দেশে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই পেশা আমি শুরু করেছি। এখন অনেকে ঘটকালিকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে। দেশে ঘটক পাখি ভাইয়ের মতো প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় পাঁচ হাজার। অধিকাংশ কম বয়সি ঘটক, আমার বয়সি ঘটক একজনও নেই। তবে আগের যুগেও ঘটকালি ছিল, সেটা ব্যবসায়ীকভাবে না, তখন নিজের খেয়ে মানুষের উপকার করতো তারা।


মাছুম: এখন ‘পাত্রপাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতারণাও করছে!

ঘটক পাখি ভাই: হ্যাঁ। প্রলোভন দেখিয়ে দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। লেখা থাকে- সুন্দর মেয়ে আছে, বিয়ে করলে ইউরোপ আমেরিকা নিয়ে যাবে, বউ থাকলেও সমস্যা নেই ইত্যাদি। বিজ্ঞাপনে মোবাইল নাম্বার দেয়, ঠিকানা দেয় না। কল করলে বলে, টাকা বিকাশ করেন, অমুক জায়গায় আসেন। পরে দেখা যায়- সব প্রতারণা। এমন ঘটনা হাজার হাজার ঘটছে। কিন্তু আমি বিজ্ঞাপন দিলে পত্রিকায় আমার ছবি দিয়ে দেই। ছবি দেয়ার কারণ হচ্ছে, সবাই জানুক আমি অন্তত খারাপ লোক না।

মাছুম: প্রেম, ভালোবাসা বিষয়গুলো আপনি কীভাবে দেখেন?

ঘটক পাখি ভাই: ভালোবাসা তো আল্লাহর রহমত। বিয়ের পর একজন আরেক জনের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যায়। তবে একজনের প্রতি আরেক জনের ভালোলাগার পরেই ভালোবাসার শুরু হয়।

মাছুম: আপনি জীবনে অনেক তরুণ-তরুণী দেখেছেন। আপনার কাছে নারীর ভালোবাসা কেমন?

ঘটক পাখি ভাই: যে নারী ভালোবাসবে না, সেই সংসার টিকবে না। তার যদি মনের ভেতর থাকে- আমি জামাইকে আদর করবো না। তাহলে সেই নারী জামাইয়ের সেবা করবে না, যত্ন করবে না, অন্য দিকে তার নজর থাকবে। সেই সংসার টিকবে না। নারীর তার স্বামীর উপর ভালোবাসা থাকতেই হবে। মুখে মুখে না, মন থেকে ভালোবাসা থাকতে হবে।

মাছুম: অনেক ছেলে আছে তিন-চার বার বিয়ে করেছে। অথবা একাধিকবার বউ চলে গেছে। এই ধরনের কেউ এলে আপনি কীভাবে তাদের পুনরায় বিয়ের ব্যবস্থা করেন?

ঘটক পাখি ভাই: এসব ক্ষেত্রে আমরা ছেলের বায়োডাটা যাচাই করে মেয়েপক্ষকে জানাই। ছেলে মেয়ের দেখাদেখিও আমার এখানে হয়। আমি বলে দেই- দুই পক্ষের ভালো লাগলে আত্মীয়তা করবেন, নয়তো করবেন না।

মাছুম: আপনার কাছে সেলিব্রেটি কেউ বিয়ের জন্য আসে?

ঘটক পাখি ভাই: অনেকে আসে। আসার কারণও আছে। অনেক মেয়ে আছে যারা নাটক করে, সিনেমা করে। আবার অনেকে আসে বিপদে পড়ে। অভিনয় জগতের কাউকে হয়তো বিয়ে করছে, তারা খুব একটা ভালো না; বিয়ে টেকে না। তখন সংসার টেকানোর জন্য অনেকে সাধারণ পরিবারে বিয়ে করতে চায়। তখন আমার কাছে আসে।

মাছুম: ব্যক্তিগত বিষয়ে আসি। আপনার ছোটবেলা কেমন ছিল?

ঘটক পাখি ভাই: ছোটবেলা আবার কেমন থাকবে? বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি, এইট নাইন পর্যন্ত পড়েছি। ১৭ বছর বয়সে তো আমি বিয়েই করছি। পরে চাকরি নিয়েছি। তারপর তো এই পেশায় ঢুকলাম।

মাছুম: আপনার বিয়ের ঘটক কে ছিল?

ঘটক পাখি ভাই: আমার প্রথম বিয়েটা অভিভাবকদের পছন্দে করেছি। দ্বিতীয় বিয়েটা নিজের পছন্দে। অর্থাৎ নিজের বিয়ের ঘটকালি নিজেই করেছি। চট্টগ্রামের ভালো একটি পরিবারের মেয়ের ঘটকালির জন্য আমার কাছে আসে মেয়েপক্ষ। পাত্রী দেখে আমি নিজেই পছন্দ করে ফেলি। অবশ্যই আমার প্রথম স্ত্রী অসুস্থ ছিল এ কারণে।

মাছুম: পারিবারিক জীবনে আপনার কয় ছেলেমেয়ে?

ঘটক পাখি ভাই: প্রথম স্ত্রীর সংসারে চার ছেলে, দুই মেয়ে। দ্বিতীয় স্ত্রীর সংসারে এক মেয়ে।

মাছুম: আপনি তো দুটি মন জোড়া লাগান। ইদানিং সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ অনেক বেড়ে গেছে।

ঘটক পাখি ভাই: কারণ আছে। নিজে নিজে বিয়ে করে তারপর বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। ঘটকের মাধ্যমে বিয়ে হলে বিচ্ছেদ হতো না। ঘটকের মাধ্যমে বিয়ে হলে জেনেশুনে, যাচাই করে বিয়ে হয়।

মাছুম: আপনার অবর্তমানে ঘটক পাখি ভাই প্রতিষ্ঠানটি কে দেখবে?

ঘটক পাখি ভাই: আমার প্রতিষ্ঠানে অনেক মেয়ে চাকরি করে। তার মধ্যে একজন আছে, ও আমার কাছে বড় হয়েছে। আমি বিয়ে দিয়েছি। ওর জামাই যদি চায়, তাহলে আমার অবর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের হাল সে ধরবে।

ছবি: সাইমুন মুবিন পল্লব

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়