শতাব্দীকাল ধরেই ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যে অন্যতম সেরা গ্রন্থ
হাসান মাহামুদ : নিবন্ধের শিরোনাম হতে পারতো, শতাব্দীকাল ধরেই ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যে অন্যতম সেরা ‘কাব্যগ্রন্থ’। তাহলে অন্তত অগ্নিবীণার শিল্পমান, বৈশিষ্ট্য এবং কাব্যগুণকে খাটোই করা হতো। শুধু কাব্যগ্রন্থ বলে একে শ্রেণিভুক্ত করার দুঃসাহস কার আছে?
অগ্নিবীণা যে শুধুমাত্র কয়েকটি কাব্যের সংকলনে একটি গ্রন্থ নয়- একটি জাতির আবেগ, ইতিহাস, স্বকীয়তা, এমনকি একটি শতাব্দির গতিময়তার নিয়ামকও। অগ্নিবীণা, কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক কাব্যিক উচ্চারণ। পরাধীন জাতির হীনমন্যতা, মানসিক দাসত্ব উৎপাটনে সমকালের এক সঞ্জীবনী টনিক। বিপ্লবের গোপন মেনিফেস্টো, ইশতেহার।
কবি হেলাল হাফিজ বলেছেন, ‘মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে, তার সৃষ্টির মাধ্যমে’। তেমনি যুগ যুগ ধরে এই বঙ্গের অসংখ্য মনীষী ইহলোক ত্যাগ করেও অমর হয়ে আছেন। সেই কবে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুয়ে আছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু তিনি আজও বেঁচে রয়েছেন তাঁর কর্মের মাধ্যমে, সৃষ্টির মাঝে।
কাজী নজরুল ইসলাম অনন্য হন প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই। সে দৃষ্টিকোণ থেকেও অগ্নিবীণার গুরুত্ব বাংলা সাহিত্যে অত্যধিক। জনপ্রিয়তার দিক থেকে এ কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে তুল্য খুব কম গ্রন্থই বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যাবে। রবীন্দ্র সাহিত্যের স্বর্ণযুগে নজরুলকে স্বতন্ত্র যুগস্রষ্টা কবির মর্যাদা এনে দিয়েছে এই গ্রন্থ। সাহিত্যের আসরে স্থায়ী আসন নিতে অনেক কবিকেই দীর্ঘকাল সাধনা করতে হয়েছে। নজরুল সেই আসনটি অধিকার করেছেন অতি অল্পকালের মধ্যে। এটি হয়তো নজরুল জীবনের বহু বিস্ময়ের একটি মাত্র দিক। যার সাথে জড়িয়ে আছে এই অগ্নিবীণা।
এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই নজরুলের হাত ধরে এক নতুন যুগের বারতা ঘোষিত হয়। নজরুলের এই অকুন্ঠ মানব মুক্তির আহ্বাণ বিশ্ব সাহিত্যেরও অমূল্য সংযোজন। পরাধীন জাতির তিমিরাচ্ছন্ন ভাগ্যাকাশে যেন এক দীপ্ত সূর্য।
আজ থেকে ৯৫ বছর আগে ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশ হয় ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি। বাংলা সাহিত্যে যুগোত্তীর্ণ কবিতাগ্রন্থগুলোর অন্যতম এটি। এই একটি গ্রন্থের মাধ্যমেই নজরুল একটি প্রবল ধাক্কা দিয়েছিলেন সমাজে। সর্বমহলে তার প্রতিকম্পন হয়। অগ্নিবীণা হয়ে উঠে বাংলা সাহিত্যের সেরা জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। নজরুল পরিণত হন যুগের এক মহানায়কে।
কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর জন্যে সেটা সহনীয় ছিল না। এ সময়ে দুটি কবিতার প্রকাশনার দায়ে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং কুমিল্লা থেকে কবিকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীনতা ও স্বাধীন চেতনার স্বপক্ষে এটিই কোন বাঙালি কবির প্রথম কারাবরণ। ১৯২৩ সালে জানুয়ারি মাসে বৃটিশ আদালত নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করে। নজরুল ছাড়া পান ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। ততোদিনে তিনি গোটা জাতির স্বাধীনসত্ত্বার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
সব কিছুর মধ্যেই এই গ্রন্থের অন্যতম ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বলিষ্ঠ প্রত্যয়টি বিভিন্ন মাত্রায় বিকশিত হতে থাকে। ‘অগ্নিবীণা’ পর্যালোচনা করলে এই সারসত্য আরও প্রবলভাবে ধরা পড়ে। ‘অগ্নিবীণা’ যেন স্বাধীনতা প্রত্যাশার মন্ত্র দিয়ে ঠাসা। কোন ঘুম পারানিয়া সুরে রচিত নয় এ গ্রন্থের কোন কবিতা। নজরুল স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতা এবং মুক্তি জাতির জন্য অপরিহার্য।
অগ্নিবীণার অন্যতম সংযোজন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। রবীন্দ্র সাহিত্যের স্বর্ণযুগে নজরুলকে স্বতন্ত্র যুগস্রষ্টা কবির মর্যাদা এনে দেয় এই কবিতা। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই কবিতা রচনারও আলাদা একটি প্রেক্ষাপট আছে। সাহিত্য জগতে পদার্পণ করেই নজরুল বুঝতে পারেন পরাধীনতার গ্লানি কতটা ভয়ঙ্কর করে তুলেছে সাহিত্যের অঙ্গনকে। সেই প্রেক্ষাপটে নজরুল রচনা করেন ‘বিদ্রোহী’।
অগ্নিবীণায় প্রকাশের আগে ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে কবিতাটি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায়। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এ কবিতা নিয়ে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়। শুরুতেই কবিতাটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গ্রন্থভুক্ত হওয়ার পূর্বেই সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় এ কবিতা।
বাস্তবতার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসার এক দ্রোহী অনুভব ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় এই কবিতায়। এরই সঙ্গে যুক্ত হয় পরাধীন জাতির স্বাধীনতার স্পৃহা। কবি লিখেন-
‘বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!’
শুধু আত্মজাগরণের অনুভবই বিদ্রোহী কবিতার মূলসুর নয়। প্রথাগত আত্মজাগরণের ভাবোচ্ছ্বাস থেকে বেরিয়ে আসাই যেন এই কবিতার মূলবার্তা। ব্যক্তিগত অনুভবের পরিতৃপ্তি নয়, সামগ্রিক এক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় আন্দোলিত দ্রোহী চেতনার স্ফুরণ ঘটেছে এ কবিতায়। একটা, গোটা জাতির অবদমিত বিপন্নপ্রায় সত্তা যেন নড়ে উঠেছে বিদ্রোহী কবিতার তরঙ্গায়িত প্রতিটি পংক্তিতে। আছে মিথ ও ঐতিহ্যের অসাম্প্রদায়িক ব্যবহার। বহুমুখী বিস্ময় আছে এ কবিতার গঠন শৈলীতেও।
বাংলা সাহিত্যে ছাপার হরফে নজরুলের আত্মপ্রকাশ ১৯১৯ সালে। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় (শ্রাবণ-১৩২৬)। সাহিত্যে আগমনের মাত্র তিন চার বছরের মধ্যেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন বইয়ে দেন। এই আলোড়ন কোন সাময়িক পরিতৃপ্তির নয়, যা অনেকেই ধারণা করেছিলেন। কেননা যতদিন গিয়েছে নজরুলের জনপ্রিয়তা, স্বকীয়তার পূর্ণতা সকলকেই কেবল বিস্মিত করেছে। আজও সেই বিস্ময়ের শেষ হয়নি। নজরুলের জনপ্রিয়তারও কোন কমতি ঘটেনি। চির স্বাধীনচেতা বাঙালির জাতীয় কবি কাজী নজরুলের এই হচ্ছে বিশেষত্ব।
অগ্নিবীণা গ্রন্থে মোট বারোটি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলো হচ্ছে- ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’, ‘আগমণী’, ‘ধূমকেতু’, কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’, ‘রণভেরী’, ‘শাত-ইল-আরব’, খেয়াপারের তরণী’, কোরবানী’ ও মোহররম’। এছাড়া গ্রন্থটির সর্বাগ্রে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ-কে উৎসর্গ করে লেখা একটি উৎসর্গ কবিতাও আছে।
‘অগ্নি-বীণা’ প্রচ্ছদপটের পরিকল্পনা ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এঁকেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন। বইটির তৎকালীন মূল্য ছিল ৩ টাকা। ৭ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন থেকে গ্রন্থকার কর্তৃক গ্রন্থটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। প্রাপ্তিস্থান হিসেবে গ্রন্থে লেখা ছিল: ‘আর্য পাবলিশিং হাউস, কলেজ স্ট্রিট, মার্কেট (দোতলায়)’। গ্রন্থটি দ্বিতীয়বার ছাপা হয় মেটকাফ প্রেস, ৭৯ নম্বর বলরাম দে স্ট্রিট, কলিকাতা থেকে। দাম এক টাকা। গ্রন্থটির উৎসর্গ হচ্ছে- “বাঙলার অগ্নিযুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু”। নিচে লেখা আছে “তোমার অগ্নি-পূজারী -হে- মহিমাম্বিত শিষ্য-কাজী নজরুল ইসলাম”। অরবিন্দ ঘোষের ভ্রাতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বাংলা তথা ভারতের বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন। বিপ্লবে বিশ্বাসী নজরুল তাই নিজেকে বারীন্দ্রকুমারের ‘-হে-মহিমান্বিত শিষ্য’ বলে উল্লেখ করে তাঁকেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন।
অগ্নিবীণা’র প্রথম সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন স্বয়ং গ্রন্থকার। দু’হাজার কপি ছাপা হয়। গ্রন্থটি প্রকাশের পর, নজরুল ‘রাজদ্রোহ-অপরাধে’ কারাগারে বন্দি। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ পরের বছর করে কলকাতা কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে আর্য পাবলিশিং হাউস। তারাও দু’হাজার কপি ছাপে। প্রকাশক শরচ্চন্দ্র গুহ নিবেদনে লেখেন: ‘অগ্নি-বীণার দ্বিতীয় সংস্করণ বার হল। প্রথম সংস্করণের দু’হাজার বই ক’মাসের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গেছে।… কবি নজরুল ইসলাম আজ রাজদ্রোহ-অপরাধে বন্দী। তাঁর অবর্তমানেই বর্তমান সংস্করণটি আমাদের বার করতে হ’ল।’
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (মাঘ ১৩২৯) গ্রন্থটির আলোচনা প্রসঙ্গে লেখা হয়- ‘…এতদিন বাংলার কাব্যকুঞ্জে প্রেমের কবিতাই অজস্র ফুটিত; বীর-বীণার ঝঙ্কার কচিৎ শুনা যাইত। কিন্তু ‘অগ্নিবীণা’র প্রতিটি কবিতাই বীরত্বব্যঞ্জক – মরণোন্মুখ জাতির প্রাণে নব উদ্দীপনার সঞ্চার করিবে। নৃত্যদোদুল ছন্দের লীলায়িত ভঙ্গিমা-বিকাশে কবি অপূর্ব গুণপনা দেখাইয়াছেন।… হিন্দু ও মুসলমান শাস্ত্র-সিন্ধু মন্থন করিয়া কবি যে-সব অনুপম উপমা সংযোজন করিয়াছেন, তাহাতে মুগ্ধ হইতে হয়। জাতীয় জাগরণের দিনে অগ্নিবীণার বীরোদাত্ত বাণী বাঙালি জাতি আদরের সহিত গ্রহণ করিবে বলিয়াই বিশ্বাস।… শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত প্রচ্ছদখানি পুস্তকের শোভা বৃদ্ধি করিয়াছে।’
প্রবাসী পত্রিকায় (মাঘ, ১৩২৯) লেখা হয়- ‘এই কবির বিশেষত্ব তাঁহার ছন্দের বৈচিত্র্যে, উপল-বিষম ঝর্ণাধারার মতন শব্দের ঝঙ্কারে, অগ্নিগিরির উচ্ছ্বাসের মতন আবেগময় ভাবের উদ্দাম প্রবাহে, বন্যাস্রোতের মতন প্রবল আগ্রহে, বলিবার শক্তিমান ভঙ্গিতে এবং হিন্দু-মুসলমানের সাহিত্য-ইতিহাস-ধর্ম ও সভ্যতার ধারার ও চিন্তাপ্রণালীর সঙ্গে সুপরিচয়ে দুইয়ের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় ঘটাইবার অসাধারণ শক্তিতে। এই বইখানির নাম অগ্নিবীণা সার্থক হইয়াছে -।’
আজ থেকে ৪১ বছর আগে ১৯৭৬ সালের আজকের দিনে (২৭ আগস্ট) দ্রোহ ও প্রেমের কবি, বিদ্রোহী কবি এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন। মানবতার জয়গানে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। তাইতো ৪১ বছর পরেও কবির জনপ্রিয়তা যেন একটুও কমেনি। কমেনি নজরুলের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধাও। অগ্নিবীণার মাধ্যমে যে পথ চলা শুরু, সেই পথে তিনি শিখিয়ে গেছেন সংগ্রামী চেতনা, মানবমুক্তির দূর্মর অপরাজেয় আন্দোলন। নজরুলের বিকল্প কেবলই নজরুল।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ আগস্ট ২০১৭/হাসান/এনএ
রাইজিংবিডি.কম