গুলশান ভুলে গেছে ভোলা গ্রামের কথা
জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম
গ্রামটি পরিচিত ছিল ‘ভোলা গ্রাম’ নামে। করাচির এক শহরের আদলে গ্রামটি তৈরি করতে গিয়ে নতুন নামকরণ হয়- গুলশান অর্থাৎ ফুলের বাগান। কিন্তু এখনো গুলশানের একটি মসজিদ ধরে রেখেছে পূর্বের সেই ভোলা নাম।
আজকের গুলশান রাজধানীর বুকে যেন বিদেশের কোনো চাকচিক্যময়, আধুনিক শহর। কিন্তু গত শতকের পঞ্চাশের দশকেও জায়গাটি ছিল ছায়াঘেড়া শান্ত। মূল ঢাকার বেশ বাইরে ছিল এর অবস্থান। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে ভোলা গ্রামের দিকে নজর পড়ে সৌখিন মানুষের। দৃষ্টি দেয় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীও।
‘সাত দশকে ঢাকার স্মৃতি’ গ্রন্থে নাজির হোসেন নাজির লিখেছেন: ‘আশির দশক পর্যন্ত গুলশান ছিল ছিমছাম আবাসিক এলাকা। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লেক গুলশানকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়। কিন্তু নব্বই দশকে এসে সেই আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক বিশাল অট্টালিকা।’ ভোলা গ্রাম থেকে গুলশান হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন: ‘ঢাকার কাছের এই জায়গায় ভোলা দ্বীপ থেকে মানুষ এসে চাষবাস করত বলেই ঢাকার লোকজন একে ভোলা গ্রাম নাম দিয়েছিল।’
গুলশানের সেই ভোলা গ্রামের অতীত খুঁজতে গিয়ে বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে স্থানীয় তহশিল অফিসের পুরনো দলিল ঘেঁটে ‘ভোলা সামাইর’ নামে গ্রাম খুঁজে পাওয়া যায়। দলিলপত্র থেকে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে গ্রামটি অধিগ্রহণ করে সেখানে ১৯৬১ সালের দিকে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেন ডিআইটির (ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট) প্রথম চেয়ারম্যান পাকিস্তানি আমলা জিএ মাদানি। পাকিস্তানের করাচিতে ছিল গুলশান নামের একটি অভিজাত এলাকা। মাদানি মনস্থির করেন, ঢাকাস্থ অভিজাত এলাকাটির নামও রাখা হবে গুলশান। এসব কারণে গুলশানে শতবর্ষী কোনো স্কুল-কলেজের সন্ধান পাওয়া যায় না।
নাজির হোসেন নাজির লিখেছেন, লোকজন মহাখালী থেকে গুলশানে হেঁটে আসতো। কোন ব্রিজ ছিল না। সেই সময়ে মাত্র গুলশানের দুটি বাজারের কাঠামো নির্মাণ শুরু করা হয়, যা আরো পরে চালু হয়। বাস, সেতু, সড়কবাতি, থানা-পুলিশ, নিরাপত্তা, স্কুল-কলেজ, বাজার কোন কিছুই ছিল না ষাটের দশকের গুলশানে।
‘ঢাকা পুরান’ গ্রন্থে মীজানুর রহমান লিখেছেন: ‘১৯৬৪ সালের দিকে ছোট বাঘ বা মেছো বাঘের দেখা মিলত গুলশানের ঘন বন-জঙ্গলে। ষাটের দশকের আদি গুলশানে পাখির কলকাকলি আর রাত হলেই পুরো এলাকা হয়ে যেত ঘোর অন্ধকার। আজ যে জায়গায় নিকেতন আবাসিক এলাকার বিস্তৃতি সেটা ছিল দ্বীপ। চারপাশে বৃহৎ জলাশয়। এখানে ঢাকার আশপাশের মানুষ গরু চরাতে আসত। ধনকুবের জহুরুল ইসলাম জায়গাটি ভরাট করে আবাসিক এলাকায় রূপ দেন। গুলশানের শুরুর দিকে প্রায় ১ হাজার তিনশো প্লট ছিল। পুরনো অধিবাসীদের মধ্যে শতকরা প্রায় দশ ভাগ লোক ছিলেন বাঙালি। গুলশান দুইয়ের ৮০ নম্বর সড়কের কমপক্ষে দশটি বাড়ি এখনও গুলশানের সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। দোতলা পুরনো বাড়ি, সামনে খোলা লন বা বাগান কিংবা বাড়ির ভেতরে থাকা বড়ো গাছ জানান দেয় সেই পুরনো গুলশানের। কিন্তু তারও আগে ভোলা গ্রামের কোনো চিহ্নই চোখে পড়ে না একটি মসজিদ ছাড়া।
মসজিদটি এখন গুলশান এভিনিউয়ে অবস্থিত এবং ‘গুলশান জামে মসজিদ’ নামে পরিচিত। এর নামফলকে এখনও রয়েছে ভোলা গ্রামের চিহ্ন। সেখানে লেখা সাবেক ভোলা জামে মসজিদ। আনুমানিক ১৮৭৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ গোলাম রসুলের কাছ থেকেই জানা গেল, পাশেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। বিদ্যালয়টি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দক্ষিণ বাড্ডায়। নাম ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৫ সাল। গোলাম রসুলের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, জায়গাটির পুরনো বাসিন্দারা এখন আর কেউ নেই। বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ চলে গেছেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার আন্ধার মানিক গ্রামে। সম্ভবত তারা উচ্ছেদ হয়েছেন অথবা নিজেরাই ভোলা গ্রাম থেকে গুলশান হয়ে ওঠার সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়েছেন চলে যেতে। এবং সেই ইতিহাস সুখকর নয়।
যদিও ভোলা গ্রাম বদলে গেছে সহস্রগুণ। এখন সেখানে সড়কে লাল-নিল বাতি জ্বলে। উঁচু অট্টালিকার ভিড়ে দেখা যায় না খোলা আকাশ। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে গুলশান আজ ব্যাপক পরিচিত। গড়ে উঠেছে হোটেল-মোটেল-ক্লাব। গুলশানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত ক্লাব গড়ে উঠলেও সবচেয়ে অভিজাত হলো গুলশান ক্লাব। জিমনেসিয়াম, লাইব্রেরি, সিনেমা হল, সুইমিং পুল অথবা বার কি নেই এতে? দিনের বেলা সকাল থেকে শারীরিক কসরত আর ব্যায়ামে নিজেকে ঝালিয়ে নিতে আসেন জ্যেষ্ঠরা। মূলত বিকালের পর থেকে শুরু হয় তরুণ, মাঝ বয়সীদের আনাগোনা। কেতাদুরস্ত পোশাক আর দামী গাড়ি থেকে নামেন ক্লাবের সদস্যরা। রাত অবধি থাকেন ক্লাবে, আড্ডা আর আনন্দে সময় কাটে তাদের। গুলশান ক্লাবের সদস্য হতে আজকাল ১ কোটি থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়- এমন কথাও শোনা যায়। আজকের গুলশানে অত্যাধুনিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় সকল অনুষঙ্গই যথেষ্ট পরিমাণে মজুদ রয়েছে।
ভোলা গ্রামের খোঁজ এখন আর গুলশান রাখে না। ফলে তপ্ত কোন এক দুপুরে আন্ধার মানিক থেকে কোন এক বৃদ্ধ যদি গুলশানে ফিরে আসেন, খুঁজে ফেরেন তার পৈতৃক ভিটা, ফিরে আসেন তার প্রিয় আমগাছের ছায়া তলে। পাবেন কি তার সন্ধান? যদি আমগাছের সন্ধান তিনি পানও, দাবি করার সাহস পাবেন না। করলে তখন তাকেও হয়তো রবি ঠাকুরের সেই ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার মতো চোর বলে অভিজাত মালিকের তাড়া খেতে হবে। সেই বৃদ্ধের জন্য বরাদ্দ রইল এই দুটি পঙ্ক্তি:
‘আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’
ঢাকা/তারা
রাইজিংবিডি.কম