কারা ঘুমিয়ে আছেন ‘তিন নেতার মাজারে’
অনিক আহমেদ (ছদ্মনাম)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী ক্লাস শেষ করে হলে ফিরছিলেন। দোয়েল চত্বরের উত্তর পাশে অবস্থিত তিন নেতার মাজার দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই মাজারে কাদের কবর রয়েছে? অনিক ঝটপট উত্তর দিলেন, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং ক্যাপ্টেন মো. মনসুর আলী। কিছুটা অবাকই হলাম! নামগুলো না-জানার কারণে নয়, বরং তার উত্তরের সাবলীলতায়।
এই বিভ্রান্তি শুধু অনিকের নয়। আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং পথচারীর কাছে জানতে চেয়েছি। খুব কমই সঠিক উত্তর পেয়েছি। কেউ বলেছেন, মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের নাম। আবার কেউ বলেছেন, তাজউদ্দীন আহমদ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নাম। আবার কেউ দুটি নাম সঠিকভাবে বলতে পারলেও তৃতীয় জনের নাম বলতে পারেননি।
প্রকৃতপক্ষে এই মাজারে স্বাধীনতা-উত্তর মৃত্যুবরণকারী জাতীয় চার নেতার কারো কবর নেই। এখানে শায়িত আছেন স্বাধীনতা-পূর্ব অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের তিন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তৎকালীন রাজনীতিতে এই তিন নেতার অবদান অবিস্মরণীয়।
আবুল কাশেম ফজলুল হক রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের কাছে ‘শেরেবাংলা’ এবং ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। ১৯৬২ সালে ২৭ এপ্রিল এই মহান নেতা ঢাকায় মারা যান।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিক ও আইনজীবী। তিনি রাজনৈতিক জীবনে কলকাতা কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র, ফজলুল হক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার শ্রম ও বাণিজ্য মন্ত্রী, খাজা নাজিমউদ্দীন মন্ত্রিসভায় বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী এবং পাকিস্তানে পঞ্চম প্রধানমন্ত্রীর মত গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। গণতান্ত্রিক রীতি এবং জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কারণে তাকে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। বরেণ্য এ নেতা ১৯৬৩ সালে ৫ ডিসেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতের একটি হোটেল কক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাঙালি রাজনীতিক খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে নাজিমুদ্দিন ব্রিটিশ আমলে দুইবার বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। ১৯৫১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। নানা কারণে তিনি বাঙালি হয়েও বাঙালি মহলে অজনপ্রিয় ছিলেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর তিনি মারা যান।
তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সাধারণের স্বার্থবিরোধী নানা কর্মকান্ডের পরও এ কে ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দীর পাশে তাকে সমাহিত করা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘সমাধি সৌধটির পরিকল্পনা যেহেতু পাকিস্তান আমলে হয়েছিল এবং সে সময়েই এটি নির্মিত হয়েছে, তাই সেটিতে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটেছে। তবে যেহেতু এই তিনজনই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকা রেখেছিলেন সেই বিবেচনা থেকেই তিনজনকে পাশাপাশি সমাহিত করা হয়েছে। এছাড়া আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনবিরোধী ভূমিকার কারণে নাজিমুদ্দীনের গ্রহণযোগ্যতা ওই সময়ে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ এবং ন্যাপ একসাথে আইয়ুব খানের বিরোধীতা করেছিল।’
নাজিমুদ্দীনের প্রকৃত ভূমিকা ইতিহাসে কিছুটা বিকৃত করে উপস্থাপন করে বাঙালির স্বার্থবিরোধী ভূমিকাকে সামনে আনা হয়েছে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি মনে করেন ‘এ কে ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দীর পাশে তার স্থান পাওয়ার কোন নৈতিক যৌক্তিকতা নেই।’
তিন নেতার মধ্যে প্রথম মৃত্যুবরণ করেন এ কে ফজলুল হক। তাকেই প্রথম সমাহিত করা হয় এখানে। তিন নেতার তিনজন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মারা গেলেও তাদের কবর দেওয়া হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একই জায়গায়। ১৯৬৩ সালে স্থপতি মাসুদ আহমেদ এবং এস এ জহিরুদ্দিন প্রখ্যাত তিন নেতার স্মরণে এটি নির্মাণ করেন। এটি মূলত মুসলিম স্থাপত্যরীতির স্থাপত্যিক ভাস্কর্য। এটি ঢাকার অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন। মাজারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দোয়েল চত্বরের উত্তর দিকে অবস্থিত।
তবে এ স্থাপত্যকলার বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, এখানে কারা চিরনিদ্রায় রয়েছেন। জানা না থাকলে হঠাৎ করে দেখে পথচারীদের এটি বোঝারও কোনো উপায় নেই। যে কারণে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত হলেও এখানে সমাহিত নেতাদের নাম নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে অনেকের। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, ‘এমনিতেই আমরা ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি। তাছাড়া কর্তৃপক্ষেরও যথেষ্ট অবহেলা রয়েছে। ফলে যারা জানেন না, তাদের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে। বাইরে থেকে দেখা যায় সেভাবে এই তিন নেতার নামফলক দিলে সহজেই পথচারীদের চোখে পড়বে।’
এছাড়া নাজিমউদ্দীন ব্যতীত বাকি দুই নেতার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এখানে কোন আয়োজন থাকলে এ সম্পর্কে সকলে জানতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা/তারা/নাসিম
রাইজিংবিডি.কম