ঢাকা     সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১০ ১৪৩১

‘মানুষ নদীভাঙা বলে গালি দেয়’

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৪ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘মানুষ নদীভাঙা বলে গালি দেয়’

‘এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা’— হ্যাঁ, প্রকৃতির এই খেলার নীরব দর্শক এ দেশের নদী পাড়ের অসংখ্য মানুষ। কারো সাধ্য নেই তা বদলায়। কিন্তু প্রকৃতির এই খেলায় অনেকের ভাগ্যই বদলে যায়। সব হারিয়ে হয়ে পড়েন নিঃস্ব।

ভাগ্য বিড়ম্বিত পারুল বেগম তাদেরই একজন। লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগরের চর কালকিনির বাসিন্দা। আট বছর আগে স্থায়ী বসবাস ছিলো তার। কিন্তু চারবারের নদীর ভাঙন তাকে নিঃস্ব করেছে। ‘আগুনে পুড়লে, ভিটা-মাটি থাকে, তখন আবার ডেরা বেঁধে থাকা যায়। নদীতে পাঁচ ভাঙা দিছে। পথের ভিখারি অই গেছি। আটা খেয়ে থাকি, ঘরে এখন আটাও নাই। কেউ খোঁজ নেয় না। কেয়ারও করে না।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কথাগুলো বলেন পারুল বেগম। নদীতীরে অস্থায়ী ডেরা বেঁধেছেন চল্লিষোর্ধ এই নারী।

পারুল বেগমের অভিযোগ অনেকের কণ্ঠেই শোনা যায়। ‘কেউ খোঁজ নেয় না’, ‘মেম্বার, চেয়ারম্যানরা ফিরেও তাকায় না’, ‘ত্রাণের চাল আসে আমরা পাই না ক্যান’- অভিযোগের যেন শেষ নেই! কমলনগরের পথে পথে এমন হাজারো পারুল বেগমের দেখা মিলবে। যাদের চুলোয় আগুন জ্বলে না আগের মতো। ধার-দেনা, নদীভাঙনে যাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
 


পারুল বেগম এখন চর কালকিনির নাছিরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা। এখন যেখানে থাকেন সেটি ভাড়া করা জায়গা। এখানেও কতদিন থাকতে পারবেন জানেন না। কারণ মেঘনা ধেয়ে আসছে। শঙ্কায় কাটছে দিন-রাত, হয়তো পঞ্চমবারের মতো ঘর ছাড়তে হবে তাকে। পরবর্তী গন্তব্য কোথায়? জবাব মেলে না। বাকরুদ্ধ পারুল বেগম। বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন এই নারী। তবুও পারুল বেগম স্বপ্ন দেখেন, নদীতে বাঁধ হবে, সরকার পাশে দাঁড়াবে।

পারুল বেগমের প্রতিবেশী বিবি কুলছুম। বয়স তেমন একটা হয়নি, ২৫ বছর। এ বয়সেই নদীতে ঘর সাতবার ভেঙেছে। ‘জায়গা-জমি অনেক ছিলো। এখন কিছুই নাই।’ নদীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলেন তিনি। একটু পরেই চোখ তুলে তাকান আকাশের দিকে। বলেন, ‘কত অভাবের মধ্যে আল্লাহ রাখছে! আমরা একটা সুতাও সাহায্য পাই নাই। উল্টা কিছু কইলে, মানুষ নদীভাঙা বলে গালি দেয়।’

এই এলাকায় যত সামনে এগুতে থাকি তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। আরেক বাসিন্দা মো. আবদুজ্জাহের নদীভাঙার চিত্র বর্ণনা করে বলেন, ‘মোট চার ভাঙা দিছে। প্রথমে ছিলাম পুরান কুমিরা, তারপরে বাংলাবাজার, তারপরে তালতলি, এখন নাছিরগঞ্জ।’ ভাঙনের কারণে আবদুজ্জাহেরের পেশার পরিবর্তন ঘটেছে। আগে ছিলেন কৃষক, ভাঙার পরে এখন জেলে। ৪ একর জমি ছিল। এখন নিঃস্ব। অন্যের জায়গায় ভাড়া করে থাকেন।
 


আবদুজ্জাহের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই হাজির হন আজিজুল হক। নদীর দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলেন, ‘তালতলির পুব সাইডে শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। তারপরে গোলাম ব্যাপারীগো ওখানে; ছিলাম ২-৩ বছর। হিয়ানতন ভাঙার পর খুরশিদ ব্যাপারীগো বাড়ি, তারপর অন নাছিরগঞ্জে। তিন কানি জমি আছিলো। সব ভাঙি শ্যাষ। অন গাঙে মাছ ধরি। দুইটা মাইয়া লই কোনো রকম দিন কাডাই। শরীর হেই আগের অবস্থাও নাই। খুব কষ্টে আছি।’

শেষ কথা হয় পেয়ারা বেগমের সঙ্গে। পেয়ারা বেগমের বাবা ও স্বামী দুজনই মারা গেছেন। স্বামীর চেয়ে বাবার শূন্যতা পেয়ারাকে বেশি কাঁদায়। কারণ বাবা থাকলে পেয়ারাকে এখন সংসারের ভার কাঁধে নিতে হতো না। সব কিছুর ধাক্কা এখন নিজেকেই সামলাতেই হয়। অথচ ধেয়ে আসছে মেঘনা। এই ধাক্কা তিনি সামলাতে পারবেন কিনা জানেন না।

 

ঢাকা/মারুফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়