সরেজমিন অনুসন্ধান : উপকূলীয় বেড়িবাঁধ- ১
বাঁধের ফাঁদে উপকূলজীবন
রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে নাজুক বেড়িবাঁধ ধ্বসে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। আশাশুনির কুড়িকাহুনিয়ার ছবি
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ দেওয়া হয়েছে যাতে সাগরের লোনা পানি ঢুকতে না পারে; ক্ষেত-খামার, জীবন-জীবিকার ক্ষতি করতে না পারে। আবার ওই উপকূলীয় অঞ্চলেই মৎস্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যাতে সাগরের লোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না এই দুটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে দেশের পশ্চাৎপদ উপকূলবাসীর কল্যাণের কথা ভেবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত দুটি কি স্ববিরোধী মনে হচ্ছে না? একদিকে যে লোনা পানি ঠেকাতে দেওয়া হচ্ছে বাঁধ, অন্যদিকে সেই লোনা পানি টেনে এনে করা হচ্ছে চিংড়ি চাষ! তবে এ সংক্রান্ত বিধি-বিধান, আইন-কানুন ঘেঁটে বোঝা যায়, বিষয়টি স্ববিরোধী নয়, বরং সুসমন্বিত। বাঁধের জায়গায় বাঁধ থাকবে, চিংড়ির জায়গায় চিংড়ি। নিয়ম অনুযায়ী সব হবে। বিধি বা আইনে কথাগুলো বলা আছে। কিন্তু ‘কে শোনে কার কথা’র এই দেশে নিয়ম-নীতি সব আছে কাগজে-কলমে, বাস্তবে চলছে সীমাহীন অরাজকতা।
গত ২০ মে রাতে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানার পর ২ জুন থেকে ১০ জুন পর্যন্ত- ৯ দিন উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাসুনি এবং খুলনার কয়রা ও পাইকগাছা- ৪টি উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ১৯টি গ্রামে সরেজমিন অনুসন্ধানে অরাজকতার চিত্র উঠে এসেছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থে। বিত্তবান ও প্রভাবশালীরা ইচ্ছেমতো বাঁধ কেটে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। নাজুক বাঁধ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় অসংখ্য জায়গায় ধসে পড়েছে। ভেসে গেছে উপকূলবাসীর জান-মাল। নীতি-নির্ধারকরা ছুটে গেছেন পরিদর্শনে। ফিরে আসার পর প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বিপুল টাকার। কিন্তু সেখানে বিস্ময়করভাবে উপেক্ষিত থেকেছে মূল সমস্যার সমাধান- শক্তপোক্ত, উঁচু ও টেকসই বেড়িবাঁধ। বাঁধ সংস্কারের নামে বরাদ্দ মিলেছে সামান্য। সেখান থেকেও বাকিটা চলে গেছে অন্য প্রকল্পে। আবার বাঁধ সংস্কার কাজেও চলেছে অবাধ দুর্নীতি-অনিয়ম-লুটপাট। এভাবে জোড়াতালির বাঁধ আর ঠিক হয়নি। তাই বঙ্গোপসাগরে এখন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মানেই বাঁধ ভেঙে উপকূলবাসীর জীবন-জীবিকার সর্বনাশ। ঘূর্ণিঝড় আম্পান সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল।
জোড়াতালির সংস্কার কাজ। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা থেকে তোলা ছবি
‘বাঁধটার জন্যি ভিখারি হয়া গেলাম’
খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হাজতখালী গ্রামটি আগে কখনোই ভাঙনের মুখে পড়েনি। গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট খাল। কপোতাক্ষের সঙ্গে ছিল স্লুইজগেট। কলকল শব্দে ওঠানামা করতো পানি। সেই ভাঙা স্লুইজগেটটাই যে গ্রামসুদ্ধ মানুষকে নিঃস্ব করে দেবে- কে জানতো! ঘূর্ণিঝড় আম্পানে প্রবল বেগে পানি ঢুকে খালের দুই পাড় ভাসিয়ে দিয়েছে। ফলে পুরো গ্রাম পানির নিচে। গ্রামবাসী আশ্রয় নিয়েছে বাঁধের ওপর। ৬৫ বছর বয়সী সুকুমার চন্দ্র বাউলিয়া জানালেন, এমপি সাহেব ইলেকশনের আগে এসেছিলেন। তারা একটা দাবিই তুলেছিল- বাঁধ বানিয়ে দিন। তিনি কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু কথা রক্ষা করেননি। চোখ মুছতে মুছতে সুকুমার বলেন, ‘বাবা, আমাইগের তেরান (ত্রাণ) লাগবে না, বাঁধখান বান্দি দাও। বাঁধটার জন্যি ভিখারি হয়া গেলাম।’
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের তালতলা বাজারে হোমিও চিকিৎসক আবদুল আজিজের ওষুধের দোকানে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রলয় নিয়ে কথা উঠতেই তাঁরা তুললেন বাঁধের প্রসঙ্গ। কুড়িকাহুনিয়ার বাসিন্দা ৭৩ বছর বয়সী ফজর আলী গাজী বললেন, ‘কত ঝড় গেল! প্রত্যেক ঝড়ে ধুয়ে যায় বাঁধের মাটি। ঝড় না হলেও বাঁধ ক্ষয়ে যায়। ৫০-৬০ বছর আগের বাঁধে নতুন করে আর মাটি পড়েনি। বাঁধ টিকবে কী করে?’
কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাটে উঠতেই ভয়াবহ ভাঙনের দৃশ্যটি চোখে পড়ে। লঞ্চঘাট লাগোয়া বাঁধের ৪টি স্থানে অন্তত এক হাজার ফুট ধ্বসে গিয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। ঝড়ের পর স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে রিং বাঁধ দেওয়া হলেও জোয়ারের পানির চাপে তা আবার ধ্বসে গেছে। কেন এখানে বাঁধ ধ্বসে গেল? প্রশ্ন করতেই এলাকার বাসিন্দাদের এক জবাব- পুরানো বাঁধ। সেই কোন কালে বাঁধে মাটি দিয়েছে; আর খবর নাই! স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল কাদের উল্টো প্রশ্ন তুললেন- ‘এটাকে বাঁধ বলা যায় না, বলতে পারেন জমির আইল। এত বড় ঝড়ে আইল টেকে?’
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর যেসব এলাকার নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম লেবুবুনিয়া গ্রাম; সাতক্ষীরার শ্যামনগরে। দূর থেকে দেখেই মনে হলো এটি কোনো দ্বীপ। চারদিকে পানি থইথই। জানা গেল, আম্পানের আঘাতে প্রায় ৫০ ফুট বাঁধ ধ্বসে যায়। কারণ সেই একই- বাঁধ ছিল খুবই নাজুক। বাঁধের একপাশে ছিল নদীর পানি, অন্যপাশে চিংড়ি ঘের। বাঁধের সঙ্গে ছিল আরেকটি খাল। মাটি ক্ষয়ে বাঁধ অনেকটা নিচু হয়ে গিয়েছিল। কপোতাক্ষের পানি প্রায় সময়ই বাঁধ ছুঁইছুঁই থাকতো। শেষমেশ আম্পানের প্রবল ধাক্কা আর সামাল দিতে পারেনি।
বেড়িবাঁধ নাজুক থাকায় এভাবেই ভেসে যায় উন্নয়ন কাজ। আশাশুনির প্রতাপনগরের একটি সড়ক
বাঁধের ফাঁদে সাড়ে ৪ কোটি জীবন
বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্র উপকূলবর্তী ১৯টি জেলা নিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল। দেশের তিন ভাগের এক ভাগজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষের বাস। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা-অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ষাটের দশকে নির্মিত হয় (১৯৬১ সালে শুরু হয়, শেষ হয় ১৯৭১ সালে) ৪ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। দুঃখের বিষয়, বেড়িবাঁধ নির্মাণ হওয়ার পর থেকে স্বার্থান্বেষী মানুষদের ছোবলে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে বাঁধটি। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, উপকূলীয় এলাকার ৫ হাজার ৭৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অর্ধেকের বেশিই আজ ঝুঁকিপূর্ণ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার স্বীকার করেছেন, বাঁধগুলো অনেক পুরনো। উচ্চতা আছে তিন-সাড়ে তিন মিটার। এগুলোর কেবল সাধারণ জোয়ার ঠেকানোর ক্ষমতা আছে। আম্পান বা সিডর-আইলার মতো বড় ঘূর্ণিঝড় ঠোকানোর সামর্থ্য এই বেড়িবাঁধের নেই। গত ২১ জুন এই সচিব বলেন, ‘এই বাঁধ উঁচু ও চওড়া করে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।’
নোনাপানির তলায় জোড়াতালির উন্নয়ন
অনুসন্ধান চালানো ওই চার উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সেই ষাটের দশকে আদি বাঁধ নির্মাণের পর এ ধরনের আর কোনো মূল বাঁধ এ অঞ্চলে নির্মাণ হয়নি; হয়েছে শুধু সংস্কার-মেরামত। আর বাঁধ বলতে যেটি করা হয়েছে, তা হলো যেখানে ভেঙেছে সেখানে রিং বাঁধ দেওয়া।
প্রতি বছর জুন মাসে স্থানীয় সংসদ সদস্যের মাধ্যমে যেসব স্থানে বেড়িবাঁধ দুর্বল, স্থানগুলো উল্লেখ করে একটি আনুমানিক বরাদ্দ পাউবো এমপির ডিও লেটারের মাধ্যমে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেখানে যদি চাওয়া হয় ৩ কোটি টাকা, বরাদ্দ আসে দেড় কোটি। জানা যায়, শ্যামনগরে প্রতিবছর ৬০-৭০টি পয়েন্টের নাম উল্লেখ করে বরাদ্দ চাওয়া হয়। এ উপজেলায় পোল্ডার সংখ্যা দুটি- ৫ ও ১৫ নং পোল্ডার আর বেড়িবাঁধ আছে ১৭৩ কিলোমিটার। আমাদের অনুসন্ধান চালানো চারটি উপজেলার ৮৫৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজের জন্য প্রতিবছর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে যে বরাদ্দ আসে; তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি আসে অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকে যেগুলোতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থ খুবই কম। এর প্রমাণ মিলবে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিটি ইউনিয়নে কয়েক বছরের সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ের ফিরিস্তি ঘাঁটলে।
পিচের রাস্তা ভেঙে প্রবেশ করছে জলোচ্ছ্বাসের পানি। শ্যামনগরের কাশিমাড়ীর ছবি
শ্যামনগরের কাশিমাড়ী ইউনিয়নের ডুবন্ত গ্রাম তরফদার পাড়ার বাসিন্দা ৮৩ বছর বয়সী রইস উদ্দিনের সাফ কথা: ‘অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা-অবহেলার ফাঁদে পড়ছি আমরা। বাঁধ শক্ত করে বেঁধে দিলে আমাদের এই দুর্দশা হতো না। আমাদের এই দুর্দশা মানুষেরই সৃষ্টি। কারও না কারও অপরাধের দায় আমরা বয়ে চলেছি। এভাবে কী বাঁচা যায়? আমরা কী অপরাধ করেছি? আমাদের কী শান্তিতে বসবাসের অধিকার নেই? আমরা কী এদেশের নাগরিক না?’ শেষ দিকে ক্ষোভ ঝরে রইস উদ্দিন তরফদারের গলায়। যেন পানিবন্দি জীবনটা আর টেনে নিতে পারছেন না এই বৃদ্ধ। তার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে বিপন্ন এলাকার অসংখ্য মানুষের মুখে। তাঁরা আজ গলা ফাটিয়ে প্রশ্ন তুলছেন- কেন শক্ত বাঁধ হচ্ছে না? আমরা কেন এভাবে বিপন্ন থাকবো? আমাদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার দায়িত্ব কে নেবে?
এসব প্রশ্নের প্রতিধ্বনি কানে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহারকে শোনাই সে কথা। তিনি বারবারই বলেন, ‘টাকার অভাব।’ (উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহারের পূর্ণ সাক্ষাৎকার ছাপা হবে এই ধারাবাহিকের শেষ পর্বে)।
গত ২৯ জুলাই পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী (প্ল্যানিং) ও বাস্তবায়িত কাজের টাস্কফোর্সের প্রধান মনিটর কাজী তোফায়েল আহমেদও বললেন, মূলত টাকার অভাবেই অতি পুরনো এই বেড়িবাঁধ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়নি। আমরা যা চাই, তা পাই না। ৩-৪ হাজার কোটি টাকা চাইলে পাই খুব সামান্য। তা দিয়ে সারা দেশের বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের উন্নয়ন ফিরিস্তি দেখলে কে বলবে টাকার অভাব? প্রায় শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে গত ৫ বছরে। অথচ বেড়িবাঁধটা মজবুত থাকলে এতো কিছু করতেই হতো না একথা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সব হারানো সুফিয়া আশ্রয় নিয়েছে আশাশুনির কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাটে
জোড়াতালিতেও লুটপাট
বাঁধ সংস্কারের নামে যেটুকু কাজ হয়, সেখানেও সারা দেশের উন্নয়ন ঠিকাদারির মতো রয়েছে আমলা-কর্মকর্তা-জনপ্রতিনিধি-ঠিকাদার মিলিয়ে সরকারি তথা জনগণের অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র।
শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার নাপিতখালী গ্রামে সংস্কার কাজের সাইনবোর্ডে দেওয়া তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি থেকে সেখানে ২৫০ মিটার, অর্থাৎ ৮২০ ফুট বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হওয়ার কথা। সিডিউল অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার কথা ২১ মে। তবে এলাকাবাসী বলছেন, কাজ শুরু হয় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের মাস দু’য়েক আগে। পরে ২০ মে আম্পানের আঘাতে মূল কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আবার সেখানে কাজ শুরু হয়েছে। এলাকাবাসী এই প্রকল্পের কাজে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বলেছেন, পুরনো বেড়িবাঁধের ওপরে ৩ ফুট উঁচু করার কথা। কিন্তু এক ফুটও উঁচু হয়নি। পাশে ১৪ ফুট চওড়া করার কথা ছিল। কিন্তু চওড়া ১৩ ফুটের বেশি হবে না। নিয়ম অনুযায়ী বেড়িবাঁধ ১৫ ফুট উঁচু হলে বাইরে নদীর তীরের অংশে ঢাল দিতে হয় এর তিনগুণ, অর্থাৎ ৪৫ ফুট। কিন্তু এখানে নদীর তীরে ঢাল ৩০ ফুটও হবে না। অন্যদিকে ১৫ ফুট উঁচু বাঁধের ভেতরের অংশে ঢাল দিতে হয় ৩০ ফুট। সেখানেও অর্ধেকের বেশি ঢাল দেওয়া হয়নি। কম দামের জিওব্যাগ দেওয়ার অভিযোগও আছে।
নাপিতখালী গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান মোড়ল বলেন, ‘চার বছর আগে ওই এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কাজ ঠিকঠাকমতো হলে এবার আম্পানে আমাদের এলাকার এই অবস্থা হতো না।’
নাপিতখালীতে সংস্কার কাজে অনিয়ম প্রসঙ্গে পাউবো সাতক্ষীরা-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলাম। খোঁজ নেব।’ চার বছর আগের সংস্কারে অনিয়মের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা তো অনেক আগের কাজ। ফাইলপত্র না দেখে বলা যাবে না।’
অভিযোগের বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার গত ২১ জুলাই দাবি করেন, এ মন্ত্রণালয়ের কাজে যে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, তা আগের চেয়ে অনেকটাই কমে এসেছে। দুর্নীতি রোধে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
উপকূলীয় ১৯ জেলার মানচিত্র
এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, ‘আসলে কাজগুলো করতে সময় লাগে। টাকা দিয়ে দিলে তো হবে না। আমরা কাজ শুরু করেছি। চুরি যাতে না হয়, সেদিকে আমাদের নজর আছে।’
টেন্ডারে কাজ পেয়ে মূল ঠিকাদার নিজের লাভটা রেখে কাজটা বিক্রি করে দেন আরেকজনের কাছে। এভাবে হাতবদল হলে কাজের মান খারাপ হতে বাধ্য- প্রসঙ্গটি তুললে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কাজ বিক্রির অভিযোগ আমার মাথায় আছে। আমি বলে দিয়েছি কোনো ঠিকাদার কাজ বিক্রি করতে পারবে না। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এমন নির্দেশনা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে পাউবো সাতক্ষীরা-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের গত ২৭ জুলাই বলেন, ‘এমন কোনো আদেশ আসেনি।’ তবে ঠিকাদারের কাজ বিক্রি প্রসঙ্গে আবুল খায়ের বলেন, ‘কাজ হস্তান্তরের কোনো বিধান নেই, প্রমাণও নেই। আমরা যাকে কাজ দেই, তার কাছ থেকেই বুঝে নেই। তার নামেই চেক হয়। চিঠিপত্র কিংবা কাজের বিষয়ে যোগাযোগ- সবই ওই ঠিকাদারের সঙ্গে হয়। কাজ হস্তান্তরের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমরাই কাজ করছি। অন্য কাউকে মাঠে কাজ করতে দেখলে সে বলে, লেবার সর্দার কাজ করছে। এক্ষেত্রে তো তার বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে যাওয়া যায় না।’ কাজ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ঠেকাতে পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এমন পদ্ধতি বের করতে হবে, যাতে ঠিকাদার কাজ হস্তান্তর করতে না পারে। জানান আবুল খায়ের।
উপকূলীয় অঞ্চলের ভালো-মন্দ দেখভালের জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার। তার সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে বেড়িবাঁধ নিয়ে সরকারের চিন্তা-ভাবনা ও কর্মসূচির কথা। পড়ুন নিচের লিংক থেকে:
** ‘সিডর আইলা আম্পান ঠেকানোর সামর্থ্য উপকূলীয় বেড়িবাঁধের নেই’
আগামীকাল পড়ুন : সর্বনাশের ষোলকলা চিংড়িতে
ঢাকা/তারা