ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আরো ৪ বিপর্যয়
রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম
উপকূলে বেড়েছে জলোচ্ছ্বাস
একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস কীভাবে উপকূলবাসীকে বারবার নিঃস্ব করে দিচ্ছে, সরেজমিন অনুসন্ধানে ভুক্তভোগীদের মুখ থেকেই শোনা গেছে সেসব ঘটনার কথা :
ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় : খুলনার কয়রা উপজেলার হাজতখালী গ্রামের বাসিন্দা ফণীভূষণ সরকার (৭২) গত ৮ জুন বলেন, ‘ছোটবেলায় আমরা এত ঘূর্ণিঝড় দেখিনি। সিডরেও আমরা ভাসলাম, আইলাতেও ভাসলাম। আম্পানে কী করলো, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।’ পাশে দাঁড়ানো আরও কয়েকজন ঘূর্ণিঝড় ফণী, বুলবুলসহ ১৯৮৮ সালের একটি ঘূর্ণিঝড়ের কথাও মনে করিয়ে দেন। সাম্প্রতিককালে পশ্চিম উপকূলের ওপর দিয়ে কেন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় আসছে জানতে চাইলে দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ গওহার নঈমওয়ারা বলেন, ‘এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে একেক দশকে একেক এলাকায় ঘূর্ণিঝড়গুলোর গতিপথ ঠিক করতে দেখা যাচ্ছে।’
লবণাক্ততা বৃদ্ধি : শ্যামনগরের রমজান নগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের মোটরবাইক চালক জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে কথা হয় গত ৪ জুন। তিনি বললেন, ‘আগে নিজেদের জমিতে আবাদ করতাম। এর পরে অন্যের জমিতে। এখন কোনোটাই আর আবাদযোগ্য নাই। জমিতে লবণাক্ততা এতটাই বেড়েছে যে- এখন আর কোনো ফসলই হয় না।’
জানা গেল, কালিঞ্চি, কৈখালী, ভেটখালী, হরিনগরসহ আশপাশের এলাকার অধিকাংশ পুরুষ এক মৌসুম বাইরে কাজ করে। আম্পান-বিধ্বস্ত শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রার অধিকাংশ স্থানে একই অবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রথমত লবণ চাষের কারণে মাটিতে লবণ প্রবেশ করেছে। চিংড়ি ঘেরের লবণ পানি চুইয়ে চুইয়ে পুকুর, ডোবা এমনকি ফসলি জমিতে যাচ্ছে। এরপরে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে নাজুক বাঁধ ভেঙে ঢুকছে লবণ পানি। এসব কারণে লবণের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। জমিতে ফসল আবাদ দূরের কথা, কোনো এলাকায় মাটি কেটে নতুন বাড়ি করলেও দেখা যায়, গাছপালা মাথা তুলতে বছরের পর বছর লেগে যায়। অন্যদিকে খোলাপেটুয়া, কপোতাক্ষ, চুনা নদীসহ সুন্দরবনের আশপাশের নদীগুলোর পানিও আগের চেয়ে অনেক বেশি লবণাক্ত বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
উপকূলের নদীগুলোতে জোয়ারের পানি বেড়েছে
জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি : গত ৭ জুন কয়রার মদিনাবাদ লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে ৭২ বছর বয়সী ফজর আলী বলছিলেন, ওই যে ভেজা মাটি দেখছেন, ওই পর্যন্ত এখন পানি ওঠে। আগে কিন্তু এত দূর উঠতো না জোয়ারের পানি। একই প্রসঙ্গ তুলে গাবুরার হেমায়েত উদ্দিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন কিনা বলতে পারবো না। তবে পরিবর্তন আমরা স্পষ্টই লক্ষ্য করছি। পানির উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। আর এর চাপ পড়ছে বাঁধের ওপর। বড় ঘূর্ণিঝড়ে বাঁধ ছুটে গেলে সবার নজরে পড়ে। কিন্তু নাজুক বেড়িবাঁধ নিয়ে আমরা কীভাবে লড়াই করছি, সেটা কেউ দেখে না। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় আমাদের ভয় নদীর ঢেউ। আতঙ্ক থাকে ঢেউয়ের ছোবলে ভেসে যেতে পারে ঘরবাড়ি।
জোয়ারের পানির চাপ বাড়ার কারণে এ বছর বর্ষা মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামনগরের গাবুরা, কয়রার সদর ইউনিয়ন, উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের বেশ কিছু স্থানে বেড়িবাঁধ মেরামত কাজ শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দারা। কয়রা সদর ইউনিয়নের গোবরা-ঘাটাখালীর বাসিন্দা ওজিয়ার রহমান শেখ (৪৯) গত ১৭ জানুয়ারি বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, এই নাজুক বাঁধ আর এই আমার ঘর। বাঁধ ছুটে গেলে আমার আর রক্ষা নাই। তখন নিজের জীবনের টানাটানি, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কথা তুলে আক্ষেপ করছিলেন তিনি।
গত ৭ জুন গোবরা-ঘাটাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাইক্লোন শেল্টারে আবার দেখা সেই ওজিয়ার শেখের সঙ্গে। করুণ মুখে জানালেন মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে তার সেই আশঙ্কা সত্যি হওয়ার ঘটনা। ঘূর্ণিঝড় আম্পান তার বাড়ির ঠিক সামনে ধাক্কা দিয়ে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। শুধু ওজিয়ার নন, এমন আরও অনেকে রয়েছেন। জোয়ারের পানির উচ্চতা যে বেড়েছে, তা এলাকার মানুষ স্পষ্টই বুঝতে পারছেন। আর নাজুক বেড়িবাঁধ সেই ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে।
বাড়ছে ভাঙনের তীব্রতা : শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ছোট চন্ডিপুর গ্রামের শাহজাহান মিয়া (৪৫) বলছিলেন, এই যে কপোতাক্ষ দেখছেন, এ নদ ছিল আরও অনেক দূরে। এখন অনেক কাছে চলে এসেছে। এর অর্থই হলো নদী ভেঙে বাড়ির কাছে চলে এসেছে। ফসলি জমি, বাড়িঘর, চিংড়ির ঘের, অনেক কিছুই গিলে খেয়েছে নদী। গাবুরার লেবুবুনিয়া গ্রামের মাওলা গাজীর স্ত্রী সূর্য বিবি (৫৫) বললেন, আমরা এপারে, ওপারে কয়রা। মাঝখানে কপোতাক্ষ। ছোটবেলায় আমরা এই নদী দেখেছি অনেক ছোট। দুই পাড় ভাঙছে। ভাঙতে ভাঙতে নদী এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। এর শেষ কোথায় জানি না।
ঢাকা/তারা