পাখির নাম ‘রঙিলা দোয়েল’
শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম
লেখক ছবিটি ঢাকা বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে তুলেছেন
স্মৃতির ভাণ্ডার হাতড়ে যখন সুন্দর কিছু সামনে চলে আসে সেটা প্রকাশ করার মধ্যে আলাদা তৃপ্তি কাজ করে। স্মৃতি রোমন্থনে আবেগ তাড়িত হয়ে উঠি আমরা। এমনই একটি পাখি নিয়ে আজকের লেখা।
আজ থেকে ৭ বছর আগের কথা। মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে কয়েকজন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের মতো আমিও নতুন কোনো পাখির সন্ধানে গিয়েছিলাম। সবাই মিলে বোটানিক্যাল গার্ডেনের গোলাপ বাগানসংলগ্ন বাঁশঝাড়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় একটি বিশালাকার গুইসাপের দেখা পেলাম। আমরা সবাই গুইসাপের ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ে একটি গাছের ডালে বসা পাখিটির উপর। পাখিটি নিচে নেমে বাঁশঝাড়ের শুকনা পাতা উল্টিয়ে খাবার খেতে শুরু করলো। ক্যামেরা তাক করতেই নিমিষের মধ্যে পাখিটি উড়ে গেল। এর আগে পাখিটি দেখিনি। ফলে আগ্রহ বেড়ে যায়। পাখিটি খুঁজতে শুরু করি। এমন সময় পাখিটি ঝোপের ভেতর থেকে মাথা উঁচু করলে উত্তেজনা বেড়ে গেল। ক্যামেরা তাক করার আগেই আবার সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।
আমিও নাছোড়বান্দা! পাখিটির জন্য অপেক্ষায় রইলাম। সঙ্গে থাকা ফটোগ্রাফাররা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন নতুন পাখির দেখা পেলাম কিনা? সময়টি ছিল ২০১৪ সালের জানুয়ারি। সতীর্থদের বললাম একটা পাখির দেখা পেলাম, অথচ ছবি তোলার সুযোগ দিচ্ছে না। বারবার লুকোচুরি খেলছে। আমার কথায় সবাই পাখিটিকে খোঁজা শুরু করল। এমন সময় পেছনে তাকিয়ে দেখলাম খোলা জায়গায় পাখিটি খাবার খাচ্ছে। সতীর্থরা বুঝে ওঠার আগেই বেশ কয়েকটি ক্লিক করলাম। শাটারের শব্দে সবাই জানতে চাইলো কি পাখির ছবি তুলছি? ইশারায় পাখিটি দেখিয়ে ছবি তুলতে বললাম। যে যার মতো ছবি তুলল। এমন সময় একজন পাখিটির পরিচয় বলল। নাম জানার পর আনন্দে মনটা ভরে উঠল।
যে পাখির কথা এতক্ষণ বলছিলাম সেটি হলো রঙিলা দোয়েল। প্রায় ২৬ সে.মি. দৈর্ঘ্য এবং ৯৫-১০৫ গ্রাম ওজনের এই পাখি Zoothera বংশীয় Turdidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। মাছের আঁশটের মতো পালকে বাদামী পায়ের উভচর পাখি। এরা চকচকে জলপাই-বাদামি রঙের পাখি। গলা থেকে পেটজুড়ে কালো রঙের বাঁকা রেখা রয়েছে। মাথার তালু, পিঠ ও লেজের উপরিভাগে ছোট ও মাঝারি মাপের কালচে পালক রয়েছে। লেজের পেছনে আড়াআড়িভাবে কালচে-বাদামি রেখা টানা। ডানার প্রান্তে ও কানের পাশে একটা করে কালো টিপ বসানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ এবং আগার দিকটা কালচে। পা ও নখের রং গোলাপি রঙের।
চিত্রিত বাদামি দামা বা রঙিলা দোয়েল বনের বনতলের গুল্মলতায় বিচরণ করে। তবে পানির ধারের পত্রগুচ্ছ এদের বেশি পছন্দ। এরা সচারচর একা বা জোড়ায় থাকে। মাটিতে ঝরাপাতা ও আবর্জনায় ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার খোঁজে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে পোকা, পোকার লার্ভা ও রসালো ফল। খুব ভোরে ও সূর্য ডোবার আগে এরা বেশি কর্মচঞ্চল হয়। মূলত এই দুই সময়ে খাবারের সন্ধানে খুবই ব্যস্ত থাকে। এপ্রিল মাস থেকেই প্রজননের জন্য প্রস্তুতিমূলক গানের সুরে ডাকতে থাকে। মার্চ থেকে অক্টোবর মাস এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে ঝোপের ভেতর ডালে শ্যাওলা, পাতা, ঘাস ও মূল দিয়ে বাটির মতো চওড়া বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখিটি ৩-৪টি ডিম পাড়ে। উভয়ে মিলে ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোঁটায়। ছানাদের পরিচর্যা ও সংসারের যাবতীয় কাজ দুজনে মিলে করে।
রঙিলা দোয়েল বাংলাদেশের অনিয়মিত পাখি। শীতে ঢাকা ও সিলেট বিভাগে দেখা যায়। এ ছাড়াও ভুটান পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারসহ দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এরা বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত।
বাংলা নাম: চিত্রিত বাদামি দামা বা রঙিলা দোয়েল
ইংরেজি নাম: Scaly Thrush/ Golden Mountain Thrush
বৈজ্ঞনিক নাম: Zoothera dauma (Latham, 1790)
হাসনাত/তারা
- ৩ বছর আগে বন্য হাতির ধাওয়া খেয়ে পেলাম বুনো টুনির দেখা
- ৩ বছর আগে বাচ্চা হারিয়ে মা দুধরাজ পাখির হাহাকার
- ৩ বছর আগে পুকুর পাড়ে পেলাম ‘কালোবুক দামা’র দেখা
- ৩ বছর আগে যেভাবে খুঁজে পেলাম ‘কালো বাজ’ পাখি
- ৩ বছর আগে অনেক অপেক্ষার পর দেখা পেলাম নীল ফক্কির
- ৩ বছর আগে সীমানা নির্ধারণ করে বাস করে জল মোরগ
- ৩ বছর আগে হঠাৎ দেখি সুরেলা কণ্ঠের সাদা লেজ রবিন!
- ৩ বছর আগে প্রজননকালে গান গায় ‘লালডানা কোকিল’
- ৩ বছর আগে উড়ন্ত পোকা ধরায় পটু নীলগলা চুটকি
- ৩ বছর আগে ডুপ্লেক্স বাসা বানায় ছোট নীলচটক পাখি
- ৩ বছর আগে মহাবিপন্ন পাখি ‘বন বাচকো’
- ৩ বছর আগে ‘নীল শিসদামা’র কণ্ঠে বাঁশির সুর
- ৩ বছর আগে গৃহপালিত হাঁসের পূর্বপুরুষ নীলশির হাঁস
- ৩ বছর আগে বিপদ দেখলেই শুয়ে পড়ে শাবাজ ট্রিটি
- ৩ বছর আগে টুপি মাথায় ‘মৌলবি হাঁস’