হারিয়ে গেছে প্রেমপত্র, নেই ডাকপিয়নের ডাকাডাকি
মোসলেম উদ্দিন, দিনাজপুর || রাইজিংবিডি.কম
আধুুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে হারিয়ে গেছে প্রেমপত্র আর ডাকপিয়নের ডাকাডাকি। বর্তমানে মানুষ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদান করছেন। কিন্তু একসময় ডাকপিয়ন ছিল মানুষের একমাত্র তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম।
এখন কম্পিউটার আর মোবাইলের যুগ। মানুষ যন্ত্রের মাধ্যমে সেকেন্ডের মধ্যে তার প্রিয়জনকে পত্র লিখে পাঠাতে পারছেন। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারিসহ সব ধরনের কার্যক্রম কম্পিউটার ও মোবাইলের মাধ্যমে করে থাকেন। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়।
১০ বছর আগেও ডাক বিভাগ ছাড়া পণ্য পরিবহন অসম্ভব ছিল। দেশের অভ্যন্তরীণসহ বিদেশেও এই মাধ্যমে যোগাযোগ করা হতো। দেশের অভ্যন্তরে চিঠি পৌঁছাতে ৩/৪ দিন কিংবা এক সপ্তাহ সময় লেগে যেত। প্রিয়জনরা প্রিয়জনদের খবর পেতে ডাকপিয়নের অপেক্ষায় বসে থাকতো। এখন যেমন মানুষ বিভিন্ন নেটওয়ার্কের সঙ্গে পরিচিত। আগের দিনে মানুষ নিজ নিজ এলাকার ডাকপিয়নের সাথে পরিচিত হতো।
তখনকার সময় একজন ডাক হকারের দায়িত্ব ছিল অনেক। তাদের কাঁধে চাপা থাকতো গুরু দায়িত্ব। মানুষের অপেক্ষার অবসান ঘটাতেন তারা। সকাল হলে চিঠির বস্তা কাঁধে নিয়ে ছুটে যেতেন দ্বারে দ্বারে। ওসব চিঠিপত্রে থাকতো প্রতিটি মানুষের দুঃখ, কষ্ট, আহাজারি আবার বয়ে আসতো সুখ আর আনন্দের বার্তা।
যুবক-যুবতিরাও তাদের প্রিয় মানুষের হাতের লেখা পত্রের জন্য প্রহর গুণতো। প্রতিটি মানুষ তাদের পোস্ট অফিসের পিয়নের নাম জানতেন এবং যেখানেই তাদের সাথে দেখা হত, জিজ্ঞাসা করতেন, তার নামে কোনো চিঠিপত্র আছে কিনা।
একসময় পোস্ট অফিসগুলোতে ছিল মানুষের সমাগম। স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ সবাই ছিল পোস্ট অফিসমুখী। কেউ চিঠি পাঠাতেন আবার নতুন ডাকের অপেক্ষায় অফিসে বসে থাকতেন।
বিরামপুরের স্থানীয় বাসিন্দা, ১৯৯৭ সালের এসএসসি ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাসুদ রানা বলেন, আগের দিনের প্রযুক্তি আর বর্তমান যুগের প্রযুক্তি রাতদিন তফাৎ। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ডাক বিভাগ। ডাকের মাধ্যমে আমরা সব খবরাখবর নিতাম। এখন অত্যাধুনিক যুগ, সেকেন্ডের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের খবর নেওয়া যায়।
৬০ বছর বয়সী প্রবাসী আক্কাস আলী বলেন, আমি সৌদি আরবে দীর্ঘ দিন ছিলাম, ২০০২ সালে একেবারে দেশে চলে আসি। তিন থেকে পাঁচ বছর পর পর দেশে ছুটিতে আসতাম। স্ত্রী সন্তান আর বাবা-মার সাথে কথা বলার জন্য বুকটা ছটফট করতো। কথা বলার কোনো উপায় ছিল না। চিঠির মাধ্যমেই কুশল বিনিময় হতো, তাও আবার একটা চিঠি আসা-যাওয়া করতে সময় লাগতো ১৫ থেকে ২০ দিন। এখন প্রবাসীদের কত সুবিধা, যখন ইচ্ছে তখন সবার সাথে কথা বলতে পারছে আবার ভিডিও কলে দেখাও যাচ্ছে।
বিরামপুরের আতিকুর রহমান বলেন, ১৯৯৫ সালের দিকে আমি যুবক ছিলাম, প্রেমপ্রীতি ভালোবাসা অনেক করেছি। এখনকার প্রেম আর আমাদের সময়ের প্রেম অনেক আলাদা। বছরের পর বছর প্রেমিকার সাথে দেখা বা কথা হতো না। চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হতো। প্রতি সপ্তাহে একটি করে চিঠি আসতো, তার আবার চিঠির মাধ্যমে জবাব দিতাম। আবার আত্মীয়স্বজনদের সাথেও ওই একই উপায়ে যোগাযোগ হতো।
হারুন উর রশিদ হারুন (হিরা) বলেন, তখনকার সময় আমাদের বিরামপুর পোস্ট অফিসের অতিপরিচিত এবং চিরচেনা ডাকপিয়ন আব্দুল আজিজ ভাই। শহরের এমন কেউ নেই যে তাকে চেনেন না। সবাই তাকে আজিজ ভাই বলে ডাকতেন। তিনিও এই শহরের অলিগলি এবং প্রতিটি মানুষ ও তার নাম জানতেন। চিঠিপত্র আসামাত্রই নিদির্ষ্ট স্থানের নির্দিষ্ট মানুষটির হাতে তার অতি কাঙ্ক্ষিত পত্রটি পৌঁছে দিতেন।
আনোয়ার হোসেন বুলু, হাকিমপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, এখন আধুুনিক যুগ, প্রযুক্তি ব্যবহার করে গণমাধ্যমকর্মীরা সহজেই সংবাদের কাজ করতে পারছেন। যেখানে যে অবস্থায় তারা অবস্থান করেন, সেখান থেকে মোবাইলের মাধ্যমে অল্প সময়ে সংবাদ লিখে নিজ অফিসে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এমন একসময় আমরা অতিবাহিত করেছি, তখন আধুুনিক কোনো প্রযুক্তি ছিল না। হাতে সংবাদ লিখে তা ডাকের মাধ্যমে অফিসে পাঠাতে হতো। তা আবার প্রকাশ হয়ে ডাকের মাধ্যমে আসতো। তবে কম্পিউটার আর মোবাইল ব্যবহারে মানুষ নিজ হাতের লেখাটাও ভুলে যাচ্ছে।
/মাহি/