আজ তিনি নেই, আছে তার গান

নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা, সর্বনাশা পদ্মা নদী, হলুদিয়া পাখী, মেঘনার কূলে ঘর বাঁধিলাম, এই যে দুনিয়া, দোল দোল দুলুনি, দুয়ারে আইসাছে পালকি, কেন বা তারে সঁপে দিলাম দেহ মন প্রাণ, মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়- মন কেড়ে নেওয়া এসব গান এখনো মানুষকে আবেগাপ্লুত করে। এসব গান আজো মনে করিয়ে দেয় গানের পাখি আবদুল আলীমকে।
কণ্ঠস্বরের অসাধারণ ঐশ্বর্য্য নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন। লোকসংগীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, ইসলামি ইত্যাদি গানের শিল্পী হিসেবে আজো তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
বাংলাদেশের অমর লোকসংগীত শিল্পী আবদুল আলীমের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। কালজয়ী এই শিল্পী মাত্র ৪৩ বৎসর বয়সে ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে (বিএসএমএমইউ) মৃত্যুবরণ করেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই শিল্পীর জন্ম। পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সংগীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক।
মাত্র তেরো বছর বয়সে তার গানের প্রথম রেকর্ড হয়। কিশোরকালেই গান শুনিয়ে শেরে বাংলার মন কেড়ে নিয়েছিলেন এই শিল্পী।
ঐতিহাসিক সে ঘটনাটি এ রকম- ১৯৪২ সাল। তখন উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বড় ভাই শেখ হাবিব আলী সেই অনুষ্ঠানে আব্দুল আলীমকে নিয়ে গেলেন।
ধীর পায়ে মঞ্চে এসে গান ধরলেন আবদুল আলীম, ‘সদা মন চাহে মদিনা যাব।’ মঞ্চে বসে গান শুনে ‘শেরে বাংলা’ শিশুর মতো কেঁদে ফেলেন। কিশোর আলীমকে জড়িয়ে নিলেন তার বুকে। উৎসাহ দিলেন, দোয়া করলেন এবং তখনই বাজারে গিয়ে পাজামা, পাঞ্জাবি, জুতা, টুপি, মোজা সব কিনে দিলেন।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা এলেন। পরের বছর ঢাকা বেতারে অডিশন দিলেন। অডিশনে পাশ করলেন। ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে তিনি বেতারে প্রথম গাইলেন, ‘ও মুর্শিদ পথ দেখাইয়া দাও।’
বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো ‘লালন ফকির’। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির মতো গান রেকর্ড হয়েছিল তার।
তিনি জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সংগীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।
আবদুল আলীম সম্পর্কে বরেণ্য গীতিকার অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল তার এক নিবন্ধে লেখেন, ‘আবদুল আলীম পূর্ব বাংলার মানুষ ছিলেন না। পশ্চিম বাংলা থেকে এসেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু তার গলায় ছিল পূর্ব বাংলার নদীর কল্লোল। শুধু বেতারে গান শুনেই বাংলাদেশের মানুষ তাকে আত্মীয় হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আব্বাসউদ্দীনের পরে আমাদের লোকসংগীতের ইতিহাসে আবদুল আলীম এক অবিস্মরণীয় নাম। বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের অন্তর থেকে উৎসারিত গানে এত দরদ আর কেউ কখনো মেশাতে পারেননি। বর্ষার উচ্ছ্বসিত পদ্মা-মেঘনা-যমুনার তরঙ্গের মতো আবদুল আলীমের ভরাট গলার স্বর শ্রোতার চৈতন্যের তটভূমিতে ভেঙে পড়ত অবিরল।’
আজ আবদুল আলীম নেই। কিন্তু আছে তার গান। তিনি সংগীতপিপাসু মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।
ঢাকা/টিপু