স্মৃতি অনুধ্যানে শাহ আবদুল করিম
রুবেল সাইদুল আলম || রাইজিংবিডি.কম
জীবিত শিষ্যের স্মৃতিকথা
১১ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যাবেলা। আমি এবং আমার ওস্তাদের ছেলে শাহ নূর জালাল সিলেটের নুর জাহান ক্লিনিকে (শাহ জালাল রহঃ এর মাজারের সামনে) আমার মুর্শিদ শাহ আব্দুল করিমের শয্যা পাশে বসে আছি। ওস্তাদের খুব শাসকষ্ট হচ্ছিল। তাঁর ছেলে ডাক্তার ডাকার জন্য বাহিরে গেলেন। ওস্তাদ আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরালেন, আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি তাঁর মাথার কাছে গিয়ে বসলাম। আমার মাথায় তিনি হাত বুলালেন। এত কষ্টের মাঝেও একটু হাসার চেষ্টা করলেন। আমার জন্য দোয়া করলেন আর বললেন— কাজ-কর্ম ফেলে রেখে আমার কাছে হাসপাতালে বসে আছিস। গানকে তুই ভালোবাসিস। মানুষ তোকে ভালোবাসবে। আমার মাথা থেকে হাতটি পরে গেল। এর মধ্যে ডাক্তার আসলেন। আমার ওস্তাদকে দ্রুত আইসিইউতে নিয়ে গেলেন। সারারাত আইসিইউতে থাকার পর ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে আমার মুর্শিদ আমাদের মায়া ছেড়ে ওই পাড়ে চলে গেলেন। কথা বলছিলাম শাহ আবদুল করিমের সুদীর্ঘ ২৭ বছরের শিষ্য বাউল আবদুর রহমানের সাথে। তার কণ্ঠ ভার হয়ে আসছিল। তিনি আরো বললেন, যৌবনের শুরুতেই আমার ওস্তাদের সাথে টানা ৩/৪ বছর ছিলাম। আমি ছিলাম অবিবাহিত, বাবা -মায়ের এক ছেলে। জমি-জিরাতও কিছু ছিল। একদিন ওস্তাদ আমাকে বললেন, তুমি বিয়ে করো। তারপর আবার আমার কাছে আসো। আমি বিয়ে করে আমার ওস্তাদের কাছে যাই এবং তাকে মুর্শিদ রূপে গ্রহণ করি। তিনি জানান, ওস্তাদ আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তাই আমাকে মৃত্যুর আগে দোয়া করে গেলেন। বাউল আবদুর রহমান গানের ছন্দে বললেন, আসলে পীর-মুর্শিদ সহজে কয়না মনের কথা, সঠিক শিষ্য হইলে তাঁর বিহনে পায় ব্যথা, খাঁটি হইলে দেয় কিছু তত্ত্ব, নইলে যে বিলাইবে যত্রতত্র।
তিনি আরো জানালেন, প্রথমে ওস্তাদের জানাজা হয় হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর মাজার প্রাঙ্গণে। দ্বিতীয় জানাজা হয় সিলেট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। তৃতীয় জানাজা হয় দিরাই উপজেলা কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে। প্রত্যেক জানাজায় হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হন। কিন্তু কোনো একসময় আমার মুর্শিদকে গান গাওয়ার অপরাধে ঈদের জামাত থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তারপর আমরা আমাদের ওস্তাদকে নিয়ে রওনা দেই ওনার গ্রামের দিকে, আমার সাথে ছিলেন ওস্তাদের আরেক শিষ্য রণেশ ঠাকুর সহ অনেকে। এইতো আর কিছুদিন। আবার চলে এলো মুর্শিদের ওফাত দিবস। আমরা সারারাত ওনার বাড়িতে ওনার গান গাইবো। কিন্তু মুর্শিদ আমার আর আমাদের সাথে গাইবেন না— কথাগুলো বলে আর কিছু বলতে পারলেন না তিনি। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
প্রয়াণ দিনের আবেগঘন মুহূর্ত
ময়ূরপঙ্খী নাওয়ের ছইয়ের উপর আতর- গোলাপ চুয়া-চন্দন মেখে সাদা মার্কিন কাপড়ে গা মুড়িয়ে আজ থেকে বার বছর আগে এই দিনে (২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর) হাওরের আফলের কান্না, নানান রঙের নাও আর শীতল বাতাস ভেদ করে উজানধল গ্রামের দিকে শেষবারের মতো তাঁর নাও ভাসিয়েছিলেন ভাটির পুরুষ কালনাই তীরের মহাজন শাহ আবদুল করিম। সেই যাত্রায় ছিল দশটি নৌকা/ নাও। দুটি সামনে, বাকিগুলো পেছনে। সেদিন বিস্তীর্ণ হাওড় ছিল ভাটির মহাজনের শোকে নিস্তব্দ। আশে পাশের সবার দৃষ্টি ছিল সর্বাগ্রের নাওয়ের ছইয়ের দিকে, ছিল না আফালের কোনো গর্জন। বাউল আবদুর রহমান আর রণেশ ঠাকুর নাওয়ের ছইয়ের উপর সাদা মার্কিন কাপড়ে মোড়ানো গুরুর পাশে বসে সুর তুললেন, ‘কেনে পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু, ছাইড়া যাইবাই যদি…।’ এই সুর যেন ছড়িয়ে পড়লো চারপাশের নাও ভেদ করে পুরো হাওড়ে। সবার আবেগে কাঁপন ধরলো, সবার চোখ ভিজে উঠলো, গলা ভেঙে আসলো কারণ প্রাণনাথ যে আজ সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। আসলে সময় এক ঘূর্ণয়মান গতির খেলা। সেই ঘূর্ণিতে ঘুরে আবার ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ ১২ সেপ্টেম্বর। প্রয়াণ দিবসে আপনার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা কালনী তীরের হে মহাজন।
শাহ আবদুল করিমের জন্মকথা, শৈশব ও যৌবন
সিলেট অঞ্চলে অনেক গীতিকবি ও শিল্পীদের জন্মস্থান। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে এক কৃষক পরিবারে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, শাহ আবদুল করিম এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইব্রাহিম আলী এবং মাতার নাম নাইওরজান। অভাব-অনটনের মাঝে বেড়ে ওঠলেও সংগীতের মায়া তিনি ত্যাগ করতে পারেননি। দিনে রাখালের কাজ করে রাতে পড়াশোনা শিখতে নৈশ-বিদ্যালয়ে যেতেন। তিনি ছিলেন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন স্বশিক্ষিত একজন মানুষ। তিনি খুব ছোটবেলায় তার গুরু বাউল শাহ ইব্রাহিম মাস্তান বকশ থেকে সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা নেন। তিনি আফতাব-উন-নেসাকে বিয়ে করেন, যাকে তিনি সরলা নামে ডাকতেন। সরলাকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সরলা না থাকলে আমি বাউল শাহ আব্দুল করিম হতে পারতাম না। সরলা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমার বাউল জীবনের মুর্শিদজ্ঞান সরলা।’ তিনি ১৯৫৭ সাল থেকে তার জন্মগ্রামের পাশে উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন। এ সময় তিনি গুরুদের সঙ্গে বর্ষা মৌসুমে হাওড় অঞ্চলে গান গেয়ে বেড়াতেন।
শাহ আবদুল করিমের সহজ দর্শন ও সমকালীন বাস্তবতা
মাথার চুল পেকে গেছে, চোখের জ্যোতি কমে গেছে, মুখের দাঁত নড়ে গেছে। সময় এখন শেষ। রং তামাশায় মন এখন আর চলে না, এ দেহে আলস্য দেখা দিয়েছে। কথা বলতে এখন ভুল হয়ে যায়, আগের মতো খাওয়াও যায় না, বেশি খেলে হজম হয় না। আগের সেই বাহাদুরি এখন আর নাই। কিন্তু যৌবনে রঙ্গিলা বাড়ৈ নানান খেলা খেলতো, আমার সঙ্গে থেকেও সে রিপুর তাড়নায় আমার কথা শুনতো না। তার নিজের গিয়ারে এই দেহ নামের গাড়ি চলতো। একদিন এই দেহ খাঁচা অকেজো হয়ে যাবে, গাড়ি পুরোদমে থেমে যাবে। ব্রেক করবে শেষ স্টেশনে, প্রকৃত মালিকের কাছে ধরা দেবে। এই করিমকে মানুষ তখন খুঁজে পাবে শুধুই গানে আর সুরে- তাঁর বিভিন্ন গানের সারমর্ম বা তত্ত্ব নিয়ে বলেছিলেন শাহ আবদুল করিম। ভাবনায় এখন আসে যে, সঠিক কথাটাই বলে গিয়েছিলেন এই সাধক। মানুষ ঠিকই তাঁকে খুঁজে তাঁর গানে আর সুরে। শত বছর পেরিয়েও এখনো কত সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক তাঁর গান, সুর আর দর্শন। গ্রামের বাজারের চায়ের দোকান কিংবা মহানগরের গ্লোরিয়া জিন্স, গাছের নিচের বাঁশের মাচা কিংবা পাঁচ তারকা হোটেলের লবি, বয়স্ক কিংবা তরুণ, গ্রাম কিংবা আধুনিক শহর- সর্বত্র সব প্রজন্মের কাছেই আছে তাঁর প্রাঞ্জল উপস্থিতি। গ্রাম-শহর, উঁচু-নিচু, কুলীন-কায়স্থ এই দুই কূলের সমন্বয় গড়ে তুলেছেন শাহ আবদুল করিম তাঁর গান আর সুরে। এজন্যই তিনি এক ব্যতিক্রমী বাউল। বর্তমানে পয়লা বৈশাখের দিন, নববর্ষের আয়োজন ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গান ছাড়া জমে না; তেমনি বসন্তের প্রথম দিন শাহ আবদুল করিমের ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে’- আজকাল তরুণ প্রজন্মের বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে। তিনি বাউল সংগীতকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এজন্যই তিনি প্রজম্নের কাছে বাউল সম্রাট হিসেবে গণ্য হয়েছেন।
শাহ আবদুল করিম ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ প্রকৃতির মানুষ! একবার সুনামগঞ্জে তাকে সংবর্ধনা সভায় মাইকে ঘোষণা আসলো, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের হাতে তুলে দেওয়া হবে তিন লাখ টাকার চেক। তিনি বোধহয় কানে ভুল শুনলেন। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তিনি পাশে বসে থাকা তার একমাত্র সন্তান জালালকে বললেন, জালাল ইতা কিতা কয়! তিন হাজার টাকা! এ তো অনেক টাকা! এত টাকা দিয়ে আমি কি করতাম! আবদুল করিমকে আস্তে করে জানানো হলো, তিন হাজার নয়, টাকার অংকটা তিন লাখ! শাহ আবদুল করিম অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি হতভম্ব। তিনি বললেন, তিন লাখ? সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলো নিয়্যা আমরা কিতা করমু? আমরার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড় প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল, বলেই তিনি বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন।
সংগীত, সাধনা ও প্রতিকূলতা
ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি শরীয়তি, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীতসহ বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন। তাঁর গুরু ছিলেন নেত্রকোনার বিখ্যাত দিকপাল বাউল রশিদ উদ্দিন। তিনি (শাহ আবদুল করিম) লালন ফকির, হাছন রাজা, রাধারমন, দূরবীন শাহ, উকিল মুন্সী, আরকুম শাহ, শিতালং শাহ কে মনেপ্রাণে লালন করে গান বুনেছেন, গান গেয়েছেন। সে সব গান দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। অথচ একসময় গান গাওয়ার অপরাধে ঈদের নামাজের জামাত এমনকি পরে গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন শাহ আবদুল করিম। শাহ আবদুল করিম ছিলেন ধীর-স্থির কিন্তু দৃঢ়চেতা একজন মানুষ। গ্রামবাসীর একজন ঈদের জামাতে হঠাৎ উঠে ইমাম সাহেবকে বললেন যে, করিম যদি গান-বাজনা না ছাড়ে, তাইলে আমরা তার সাথে একই জামাতে নামাজ পড়ব না। তার এইসব কর্মকাণ্ড বেদাত। আমরা তার গানের জন্য রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। তখন ইমাম সাহেব শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তিনি গান বাজনা ছাড়বেন কিনা। নইলে তিনি এই ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে পারবেন না। শাহ আবদুল করিম প্রথমে নিশ্চুপ! ইমাম সাহেব আবারো একই কথা জিজ্ঞেস করলেন। এদিকে মুসুল্লিরা একটু উত্তেজিত হচ্ছেন। এমন সময় শাহ আবদুল করিমের এক শুভাকাঙ্খী তাঁকে বললেন, আরে মিয়া আপাতত বলে দাও যে আর গান-বাজনা করব না। পরেরটা পরে দেখা যাবে। আজ ঈদের দিন। কোনো গণ্ডগোল করো না। কিন্তু শাহ আব্দুল করিম সোজা উঠে দাঁড়ালেন। স্পষ্ট করে সেই ঈদের জামাতে বললেন, আমি গান-বাজনা ছাড়া বাঁচতে পারবো না এবং গান-বাজনা ছাড়ব না। এই বলে তিনি সেই ঈদের জামাত ত্যাগ করলেন। একই কারণে তাঁর স্ত্রী সরলা খাতুনের জানাজা পড়াতে রাজি হয়নি গ্রামবাসী ও গ্রামের সেই মসজিদের ইমাম। আজ পুরো বাঙালির অন্তরে জায়গা নিয়েছে তাঁর দর্শন, কণ্ঠে স্থান পেয়েছে তাঁর গান। শাহ আবদুল করিম এখন শুধু বাংলাদেশেই চর্চার বিষয় নয়, এখন পৃথিবী ব্যাপী আলোচনায় আছেন ভাটির পুরুষ কালনীর ঢেউয়ে বেড়ে উঠা এই মহাজন। ইতিমধ্যে তাঁর ১০টি গান বাংলা একাডেমি কর্তৃক ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে এবং তাঁর গান নিয়ে আরো কাজ চলছে। তার রচিত দেড় হাজার গানের মধ্যে সংগ্রহে আছে মাত্র ৬শ’। শাহ আব্দুল করিম মালজোড়া, বিচ্ছেদ, ধামাইল, জারি, সারি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি ও গণ সংগীতসহ নানা ধারার গান রচনা করেছেন। এর মধ্যে— আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, গাড়ি চলে না চলে না, কেনে পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, বসন্ত বাতাসে সই গো, প্রাণনাথ ছাড়িয়া যাইওনা মোরে, আগের বাহাদুরি এখন গেল কই, বন্ধে মায়া লাগাইছে, আমার বন্ধুয়া বিহনে গো, বসন্ত বাতাসে সইগো, মাটির পিঞ্জিরার সোনা ময়না রে, কোন মেস্তরি নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়, আইলা না আইলা নারে বন্ধু, মানুষ হয়ে তালাশ করলে মানুষ হওয়া যায়, সখি কুঞ্জ সাজাওগো, তুমি বিনে আকুল পরাণ, আমি তোমার কলের গাড়ি তুমি হও ড্রাইভার, আমি কূলহারা কলঙ্কিনী, কেমনে ভূলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া, রঙের দুনিয়া তোরে চাই না, বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে, তুমি রাখ কিবা মার, ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও, তোমার কি দয়া লাগে না, আমি এই মিনতি করিরে, মানুষ হয়ে তালাশ করলে, আমি বাংলা মায়ের ছেলে, আমি কূলহারা কলঙ্কিনী, কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া, মন মিলে মানুষ মিলে সময় মিলে না, সখী তোরা প্রেম করিওনা, দেখা দেওনা কাছে নেওনা, মন মজালে ওরে বাউলা গান, আমার মাটির পিনজিরার সোনার ময়নারে, আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু, আমি তোমার কলের গাড়ি, তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো, গান গাই আমার মনরে বুঝাই, দয়া কর দয়াল তোমার দয়ার বলে, আমার মন উদাসি, আমি তোরে চাইরে বন্ধু, বন্ধুরে কই পাব সখি গো, আসি আসি বলে বন্ধু আইলনা, খুজিয়া পাইলাম নারে বন্ধু, ভব সাগরের নাইয়া ইত্যাদি গান দেশে-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
দেশপ্রেমিক শাহ আবদুল করিম
শাহ আবদুল করিম শুধু একজন গানের বাউলই নন। অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ হয়ে উঠতো প্রতিবাদী এবং হাতের বেহালা কাজ করতো অস্ত্রের ন্যায়। ঊনিশ শতকের বড় বড় আন্দোলনে সক্রিয় চরিত্র হিসেবে দেখা গেছে তাঁকে। এর মধ্যে আছে ৫৪ এর নির্বাচন, ৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থান, ৭০ এর নির্বাচন ও ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। তার গণসংগীতে জেগেছিল জনতা। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কাগমারী সম্মেলনে গানে গানে যোগ দিয়েছেন তিনি। ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়পাত্র।
শাহ আবদুল করিমের প্রকাশিত গ্রন্থ
বাউল শাহ আবদুল করিমের এ পর্যন্ত ৭টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হলো—আফতাব সংগীত,
গণ সংগীত, কালনীর ঢেউ, ধলমেলা, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে, শাহ আব্দুল করিম রচনাসমগ্র। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তাঁর রচনাসমগ্র (অমনিবাস)-এর মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এছাড়াও সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত শাহ আবদুল করিম স্মারকগ্রন্থ (অন্বেষা প্রকাশন) তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয় সুমনকুমার দশের ‘শাহ আবদুল করিম: জীবন ও গান’ বইটি। বইটি একটি প্রামাণ্য জীবনী হিসেবে বোদ্ধামহলে স্বীকৃতি পেয়েছে।
প্রাপ্ত পদক
বাউল শাহ আবদুল করিম বাউল গানে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাউল গানের জগতে তাঁকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। শাকুর মজিদ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ভাটির পুরুষ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। এছাড়াও সুবচন নাট্য সংসদ তাঁকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা মহাজনের নাও নাটকের ১০৭টি প্রদর্শনী করেছে। শাহ আবদুল করিমের প্রাপ্ত অন্যান্য সম্মাননা হলো—
কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী পদক (২০০০), রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০), লেবাক অ্যাওয়ার্ড (২০০৩), মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা (২০০৪), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস আজীবন সম্মাননা (২০০৫), বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা (২০০৮), হাতিল অ্যাওয়ার্ড (২০০৯), এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা (২০০৯)।
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সাথে শেষ কথা
শাহ আব্দুল করিম একদিন আরেক বাউল শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে বলছিলেন, ‘আচ্ছা, তুমি তো গান গাও, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো...ধরো তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে কিন্তু গান শুনতে কোন মানুষ আসে নাই। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে...গাইতে পারবে...?’
কালীপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন—
‘না, পারবো না…’
শাহ আবদুল করিম হেসে বললেন—
‘আমি পারবো।
কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই। সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক, নাম না থাকুক, সেই আদর্শটা থাকলেই হলো।’
কালিকাপ্রসাদ জানতে চাইলেন সেই আদর্শটা কী? শাহ আব্দুল করিম সহজভাবে উত্তর দিলেন, ‘এই পৃথিবী একদিন বাউলের হবে!’
বাউল সম্রাটের প্রয়াণ ও আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি
শাহ আবদুল করিমের স্ত্রী সরলা মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৭ সালে। শাহ আবদুল করিম সরলার কবর তাঁর শোবার ঘরের সামনে দিয়েছেন। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী শাহ আবদুল করিমকে সরলার কবরের পাশে দাফন করা হয়। আজ এই প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইলো প্রাণপ্রিয় সাধক, গান-সুরের মহাজন শাহ আবদুল করিমের স্মৃতি ও আত্মার প্রতি।
লেখক: কবি, বাউল গবেষক ও ডেপুটি কমিশনার অব বাংলাদেশ কাস্টমস
ঢাকা/শান্ত