যে দেয়াল কথা বলে
টার্গেট ডাভ
গ্রাফিতি- তিন অক্ষরের সহজ এই শব্দটি অর্থের দিক দিয়ে বিশাল তাৎপর্য বহন করে। সাধারণভাবে গ্রাফিতি বলতে দেয়ালে আঁকা ছবি বা লেখা বোঝায়। তবে সাধারণ লেখা বা ছবির সঙ্গে গ্রাফিতির অর্থ বা তাৎপর্যের বিস্তর ফারাক রয়েছে। গ্রাফিতি হলো সেই দেয়াল লিখন বা অঙ্কন যা দিয়ে শিল্পী শৈল্পিক উপায়ে কোনো বিশেষ বার্তা বা জনগষ্ঠেীর অভিমত ফুটিয়ে তোলে।
গ্রাফিতির ইতিহাস বেশ পুরোনো। ধারণা করা হয় প্রাচীন গুহাচিত্রই আজকের গ্রাফিতি। অর্থাৎ মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে গ্রাফিতিও বিকশিত হয়েছে। সেই গ্রিক-রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আজ অবধি শিল্পীরা গ্রাফিতির মাধ্যমে সমসাময়িক রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিস্থিতি, অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধের পক্ষে কিংবা শান্তির বিপক্ষে নানান বার্তা দিয়ে থাকেন।
বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে বিখ্যাত সব গ্রাফিতি। এসব গ্রাফিতির কোনোটা ন্যায়ের পক্ষে কোনোটা অন্যায়ের বিপক্ষে কথা বলে। কোনোটা আবার শান্তির বার্তা পৌঁছে দেয়, তো কোনোটা যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরে। সাম্প্রতিককালের আলোচিত ৫ গ্রাফিতি হলো:
টার্গেট ডাভ
বাঙ্কসিতে আঁকা পৃথিবীর একটি বিখ্যাত গ্রাফিতি হচ্ছে ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের দেয়ালে আঁকা টার্গেট ডাভ। ধারণা করা হয় ২০০৪ সালে ইউরোপ আমেরিকার একাধিক শিল্পী ফিলিস্তিনি শিল্পীদের সঙ্গে মিলে এই দেয়াল চিত্র আঁকেন। টার্গেট ডাভ হলো জলপাই ডাল মুখে নিয়ে একটি উড়ন্ত কবুতর। কবুতরটি বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিহিত। মুখে একটি গাছের ডাল নিয়ে যাচ্ছে আর ইসরাইলী স্নাইপারের বন্দুকের ভিউপয়েন্ট তাকে অনুসরণ করছে। এ যেন অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের নির্যাতিত নিষ্পেষিত জনগণের করুণ পরিণতি ও প্রাণের আকুতি।
ক্রাক ইজ ওয়েক
নব্বইয়ের দশক। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নেশাদ্রব্য কোকেনের ভয়াবহ প্রভাবে যুব সমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। রিগান প্রশাসন কোকেনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ব্যানার ফেস্টুন টিভি প্রচারণা চলছে। এরই মাঝে ১৯৮৬ সালে নিউইয়র্ক সিটির প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটনের হার্লেন রিভার ড্রাইভের দেয়ালে দেখা গেল ক্রাক ইজ ওয়েক শিরোনামের এক গ্রাফিতি। এঁকেছিলেন কেথ হেরিং নামের এক শিল্পী। কোকেনের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা এই গ্রাফিতিটি ওই সময়ের যুব সমাজে প্রভাব বিস্তার করে মাদক আন্দোলনকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছিল। কোকেনের ভয়াবহ থাবা থেকে মুক্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের যুব সমাজ।
মাই গড হেল্প মি টু সারভাইভ দিস ডেডলি লাভ
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক অন্যায় অনাচার, দখলদার ও যুদ্ধবিরোধী মনোভাব, স্নায়ু যুদ্ধের কদর্য রুপের বিরুদ্ধে নীরব অথচ শক্তিশালী আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছিল বার্লিন প্রাচীরের দেয়াল। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি তথা ইউরোপকে বিভক্তকারী এই দেয়াল সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের দেয়াল হয়ে উঠেছিল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পৃথিবীর খ্যাতনামা আঁকিয়েরা এই দেয়ালের গায়ে এঁকে দিতেন শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতার ছবি, মানুষের মুক্তির কথা, সাম্য ও স্বাধীনতার কথা। বিশেষ করে পূর্ব পাশের দেড় কিলোমিটার জায়গাজুড়ে শোভা পেত এসব গ্রাফিতি। শত শত গ্রাফিতির মধ্যে রাশিয়ান শিল্পী দিমিত্রি ব্রুভেলের আঁকা মাই গড হেল্প মি টু সারভাইভ দিস ডেডলি লাভ শিরোনামের গ্রাফিতি সবার নজর কাড়ে। গ্রাফিতিটিতে সোভিয়েত নেতা লিওনড ও পূর্ব জার্মানির সেক্রেটারি ইরিক হনেচকারের চুম্বনরত ছবি ছিল। এটি ছিল পূর্ব জার্মানির শাসকগণের হটকারিতার বিরুদ্ধে নিন্দা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।
বেলুন গার্ল
গ্রাফিতি আঁকার একটি জনপ্রিয় ধরন হলো বাঙ্কসি। এই পদ্ধতিতে শিল্পীরা লেখা বা আঁকার জন্য স্টেনসিল বা ছিদ্রযুক্ত পাত ব্যবহার করে। এটাই পৃথিবীতে গ্রাফিতি আঁকার সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। যদিও কে বা কারা এই পদ্ধতির উদ্ভাবক তা নিয়ে চিরকালই বিতর্ক রয়েছে। তবে ধারণা করা হয় বাঙ্কসি হলেন লন্ডনের একজন চিত্রশিল্পী ও রাজনৈতিক কর্মী। যদিও কখনও তার সঠিক নাম পরিচয় জানা যায় নি। বাঙ্কসির সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রাফিতি এই বেলুন গার্ল। ২০০২ সালে লন্ডনের সাউথ ব্যাঙ্কে গ্রাফিতিটি আঁকা হয়। একটি ফ্রক পরা বাচ্চা মেয়ে যার চুল বাতাসে উড়ছে। তার হাত বাড়ানো দূরত্বে একটি লাল বেলুন। পাশে লেখা ‘দেয়ার ইজ অলয়েজ হোপ’ বা নিরাশ হইও না। গ্রাফিতিটির দুটি অর্থ করা হয়েছে। কেউ যদি মনে করে বেলুনটি মেয়েটির হাত ফসকে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে তাহলে তার অর্থ দাড়ায় শৈশবে যে সরলতা নিয়ে আমরা বাঁচি বয়সের সাথে সাথে সেই সরলতা আমাদের থেকে দূরে সরে গিয়ে সেখানে কুটিলতা ভীড় করে। আবার কেউ যদি মনে করে মেয়েটি বেলুনটি ধরতে যাচ্ছে তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় আপনার পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন কখনও আশাহত হওয়া উচিত নয়।
সুবোধ
বাংলাদেশে গ্রাফিতির ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন না হলেও বেশ সমৃদ্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা ন্যায় সঙ্গত নানা আন্দোলনে এ দেশে প্রচুর দেয়াল লিখন কিংবা চিত্র আঁকা হয়েছে। সেখান থেকে অনেক লিখন বা অঙ্কন কালজয়ী হয়ে আছে। তবে সাম্প্রতিক কালে একটি গ্রাফিতি এ দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। ২০১৮ সালের প্রথম দিকে ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে একটি দেয়াল চিত্র সকলের মনোযোগ কাড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে। মাথা ভরা উস্কখুস্ক চুল, রুগ্ন চেহারার এক যুবক হাতে খাঁচা বন্দি সূর্য নিয়ে বসে আছে,পাশে লেখা- সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে থাকে না বা তোর ভাগ্যে কিছু নেই কিংবা কবে হবে ভোর? বছর দুয়েক সুবোধ সিরিজের নানা লেখা ঢাকার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তবে কে বা কারা এর আঁকিয়ে তা আজও জানা যায় নি।
ঢাকা/তারা